বুথে বসে ভোটকর্মীরা।— নিজস্ব চিত্র
সকাল সকাল স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিয়েছিলেন মহম্মদ ইউসুফ আলি। ১৫০ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসার তিনি। কাগজপত্র গুছিয়ে বসেছেন বাকি ভোটকর্মীরাও। কিন্তু ভোটার কই। সাতটার কাঁটা আটটার ঘর পেরোয়। পাল্লা দিয়ে মাথার উপর সূর্য ওঠে। কিন্তু ভোটারের দেখা নেই। দেখা নেই বুথ এজেন্টদেরও। লোকগুলো গায়েব হল নাকি!
খানিক ইতস্তত করে বাইরে বেরিয়ে আসেন ইউসুফ। দু’একজন গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কী ব্যাপার জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘‘কেউ ভোট দিতে আসবে না বাবু। আমরা কেউ ভোট দিতে যাব না।’’ প্রতি কথায় অভিমান ঝরে পড়ে। ইউসুফ পাল্টা শুধোন, ‘‘কেন?’’
‘‘কেন ভোট দেব? কাকে ভোট দেব? সবাই এল, বড় বড় বোলচাল বলে গেল। কিন্তু আমাদের কিছু হল কই। তাই ভোট দেব না।’’
সত্যিই দিলেন না। ৩১০৯ জন ভোটারের একজনও বুথের পথে পা বাড়ালেন না। ফাঁকা পড়ে রইল চার চারটে বুথ। সারাদিনের অপেক্ষার পর খালি ইভিএম গুটিয়ে নিয়ে ফিরে গেলেন ভোটকর্মীরা। সমশেরগঞ্জের ওসি সুভাশিস ঘোষাল, বিডিও পার্থসারথী দাস-সহ একাধিক প্রশাসনিক কর্তার শত অনুরোধেও মন গলেনি। নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন সমশেরগঞ্জের অদ্বৈতনগর গ্রামের বাসিন্দারা।
কেন দিলেন না?
প্রশ্ন শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামবাসীরা। কথায় কথায় স্পষ্ট হয় বয়কটের কারণ। গ্রামবাসীরা জানান, সেই স্বাধীনতার পর থেকে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া অদ্বৈতনগরের দাবি একটি পাকা সেতুর। দাবি পানীয় জলেরও। তার জন্য স্থানীয় বিধায়ক, সাংসদ কারও কাছে যেতে বাকি নেই। সবাই আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আজও সেতু হয়নি। পানীয় জলের কষ্টও মেটেনি। তাই গ্রামবাসীরা এককাট্টা হয়ে এ বারের বিধানসভা ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের সেই অনড় মনোভাবের মুখে পড়ে প্রচারে এসে ফিরে গিয়েছিলেন একাধিক প্রার্থী। গ্রামে পড়েনি একটি পোস্টারও। দেওয়ালে পড়েনি কোনও আঁচড়।
১৫০ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসার মহম্মদ ইউসুফ আলি বলেন, “বুধবার রাতেই আভাস পেয়েছিলাম। তবু সকাল সকাল স্নান সেরে বুথে বসে পড়ি। কিন্তু কোনও দলেরই এজেন্টের না আসায় বাইরে বের হই। তখনই গ্রামবাসীদের মুখে শুনি তাঁরা ভোট দেবেন না।” ১৫৩ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসার তেঁতুলচন্দ্র সাহা বললেন, “ঝাড়খণ্ড লাগোয়া গ্রাম বলে কিছুটা ভয়ে ছিলাম। কিন্তু কেউই ভোট দিতে এলেন না। বিডিওকে বিষয়টা জানাতে তিনি আসেন। তাতেও চিড়ে ভেজেনি।’’ পাশের ১৫২ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসার হান্নান আলি বলেন, “ভোটার না আসায় সময় যেন কাটতেই চাইছিল না।” ১৫১ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সমীর সাহা বলেন, “গ্রামবাসীদের অনেক বোঝাই। কিন্তু জল নেই, সেতু নেই বলে কেউ বুথমুখী হননি।”
গ্রামের সিপিএম নেতা হিসেবে পরিচিত মহম্মদ আব্বাসউদ্দিন বলেন, “ভোট বয়কটের খবর পেয়ে বিডিও এসেছিলেন। তাঁকে গ্রাম ঘুরিয়ে দুর্দশার ছবিটা দেখিয়েছি। পানীয় জলের সঙ্কট, নদী পারাপারের সঙ্কট দেখে তার বলার মতো কিছু ছিল না।”
ষাটোর্ধ্ব আব্দুল মান্নান বলেন, “অদ্বৈতনগর থেকে ঝাড়খণ্ডের শুরু। মাঝে মাশনা নদী। নদী পেরিয়ে হাটবাজার, স্কুল। কিন্তু পাকা সেতু নেই। ফলে বর্ষাকালে ঘোর সমস্যায় পড়তে হয়।’’
প্রায় ১২৫ মিটার চওড়া মাশনা নদীর উপর সেতুর দাবি দীর্ঘদিনের। সমশেরগঞ্জের ভাসাই পাইকর থেকে অদ্বৈতনগর আসার সহজ পথ মাশনা পেরিয়ে বড় জোর ৫০০ মিটার। পাশেই ভাসাই পাইকর হাইস্কুল। হাটবাজার, এমনকী ভাসাই পাইকর গ্রাম পঞ্চায়েত কার্যালয়ও। কিন্তু সেতু না থাকায় প্রায় ৭ কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয় গ্রামবাসীদের। গ্রামের বাসিন্দা ভাসাই পাইকর গ্রাম পঞ্চায়েতের কংগ্রেসের উপ প্রধান আব্দুল গফুর বলেন, “যেই আসেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। কিন্তু সেতু আর হয় না। তাই কেউ ভোট দিতে যাইনি।”
গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য উমেদুল্লা বলেন, “এখন নদীতে জল কম। মাচা বেঁধে পারাপার চলছে। শতাধিক ছেলেমেয়ে ওই মাচা পেরিয়ে স্কুলে যায়। কিন্তু ভরা বর্ষায় নদীতে জল থাকলে যাতায়াত দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘একটি সেতুর জন্য কত অনুরোধ করা হল। কিন্তু তাতে কিছুই হল না। তাই ভোট দিয়েও যা, ভোট না দিয়েও তাই। তাই ভোট দিইনি।”
বিধায়ক থেকে সাংসদ, ছয় দশক ধরে আর্জি জানিয়ে জানিয়ে ক্লান্ত ও হতাশ অদ্বৈতনগর তাই বৃহস্পতিবার বুথের পথে পা বাড়াল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy