Advertisement
E-Paper

সেনাপতির ইনকিলাব, জিন্দাবাদ ফেরাল জনতা

ট্রাফিক আইল্যান্ডের উপরে আড়াআড়ি একটা পোস্টার লটকে দেওয়া হয়েছে। ‘নন্দীগ্রাম গণহত্যার নায়ক হে মহান, তোমায় লাল সেলাম’! রাস্তার ধারে ধারে ইতিউতি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাইয়ের স্মৃতি উস্কে দেওয়ার আরও কিছু চেষ্টাও চোখে পড়ছে। এত দিন পরে প্রায় অবসৃত অধিনায়ক ক্রিজে নামছেন যখন, স্বাগত জানাতে বিপক্ষ কিছু বাউন্সার তো রাখবেই!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৪৬
সুজন চক্রবর্তী (বাঁ দিকে) এবং শতরূপ ঘোষকে পাশে নিয়ে প্রচারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রয়েছেন মধুজা সেন রায়ও। যাদবপুরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সুজন চক্রবর্তী (বাঁ দিকে) এবং শতরূপ ঘোষকে পাশে নিয়ে প্রচারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রয়েছেন মধুজা সেন রায়ও। যাদবপুরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ট্রাফিক আইল্যান্ডের উপরে আড়াআড়ি একটা পোস্টার লটকে দেওয়া হয়েছে। ‘নন্দীগ্রাম গণহত্যার নায়ক হে মহান, তোমায় লাল সেলাম’!

রাস্তার ধারে ধারে ইতিউতি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাইয়ের স্মৃতি উস্কে দেওয়ার আরও কিছু চেষ্টাও চোখে পড়ছে। এত দিন পরে প্রায় অবসৃত অধিনায়ক ক্রিজে নামছেন যখন, স্বাগত জানাতে বিপক্ষ কিছু বাউন্সার তো রাখবেই!

বিশাল বপুর মিছিল তাঁকে নিয়ে এগোচ্ছে ঢাকুরিয়া থেকে গড়িয়ার পথে। রাস্তায় বাঁধা কিছু মাইক তৈরিই ছিল। সুলেখার মো়ড়ের কাছে পৌঁছতেই তারস্বরে শুরু হল ‘হাসছে জঙ্গলমহল’ দিয়ে মমতা-জমানার পাঁচ বছরের সেই গুণকীর্তন। যা এ বারের ভোটে শাসক দলের থিম সঙ্গীত। প্রায় তখন থমকে গিয়েছে গোটা এলাকা। রাস্তার ধারে উৎসুক জনতা উসখুশ করছে।

অধিনায়ককে কিছু বলতে হল না। হঠাৎ বিদ্যুতের চমকের মতো নিজে নিজেই তৈরি হয়ে গেল জবাবটা! গোটা মিছিল থেকে একসুরে শুরু হল ‘চোর, চোর’ চিৎকার! মিছিলের মাথা, মাঝখানে প্রচারের গাড়ি ঘিরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, বহু পিছনে মিছিলের ল্যাজ— সব বিন্দু থেকে তখন একটাই আওয়াজ। ‘চোর, চোর’! নির্মল আনন্দে উৎসাহ দিচ্ছে রাস্তার দু’ধারের গ্যালারি। সমবেত চিৎকারের চোটে দ্রুতই বন্ধ হয়ে গেল মাইকের গুণ-গান!

এই রকম মেজাজের লাল মিছিল বহু কাল দেখেনি কলকাতা। এক অনিচ্ছুক সেনাপতি আর পরম ইচ্ছুক সেনাবাহিনীর সংযোগে যা দেখা গেল মঙ্গলবারের ভোট-বাজারে!

আলিমুদ্দিনের ঘেরাটোপের বাইরে বেরোতে এ বার সেনাপতির প্রবল আপত্তি ছিল। দলের মধ্যে একাংশের জোরাজুরিতে শেষমেশ রাজি হয়েছিলেন। তার পর যা ঘটল, একদম গল্পের মতো!

ঢাকুরিয়া সেতুতে গাড়ি থেকে অবতরণ ইস্তক সেনাপতি বন্দি হয়ে গেলেন তাঁরই সেনাবাহিনীর হাতে। সামনে, পিছনে, ডাইনে, বাঁয়ে হামলে পড়ছে সমর্থকদের আব্দার। কোনও ক্রমে ব্যারিকে়ড করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাঁকে তুলে দিল হু়ডখোলা জিপটার উপরে। যেখানে তাঁর সঙ্গী সুজন চক্রবর্তী, মধুজা সেন রায় ও শতরূপ ঘোষ। যাদবপুর, টালিগঞ্জ ও কসবা বিধানসভা কেন্দ্রের তিন সিপিএম প্রার্থী। প্রচার-গাড়ি যখন ঢাকুরিয়া ছাড়ব ছাড়ব করছে, তত ক্ষণে যাদবপুরের ৮বি বাসস্ট্যান্ড দখল করে নিয়েছে লাল পতাকা! ভিড়ে রাস্তার দু’টো চ্যানেলই তখন বন্ধ করে দিতে হয়েছে পুলিশকে।

লাল টি-শার্টে তরুণ-তরুণীদের মহাউৎসাহী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যাচ্ছে জিপের ঠিক আগে আগে। আরও অনেকটা আগে মহিলাদের আলাদা মিছিল। জিপের পিছনে অন্য একটি ম্যাটাডোরে বামফ্রন্টের অন্য নেতারা। তারও পিছনে আম কর্মী ও সমর্থকদের পদাতিক বাহিনী। বেশির ভাগের কাঁধে লাল ঝান্ডা, কিছু হাতে আবার তেরঙাও।

এই যদি চেহারার বর্ণনা হয়, এই মিছিলের বাঁধুনিও অন্য রকম। শিল্প নেই, নারীদের নিরাপত্তা নেই, সিন্ডিকেট আর দুষ্কৃতী-রাজের দাপট— এ সব চেনা কথা মিছিলের আগে মাইকে আছে ঠিকই। কিন্তু মিছিলের মনে এ সব নেই। তাদের নিশানায় শুধুই মাছের চোখ। তৃণমূল মানে চোরেদের দল! বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় আড়াই ঘণ্টার যাত্রাপথে শুধু চুরির তিরে তৃণমূলকে বিঁধেই পথ পেরিয়ে গেল দীর্ঘ একটা মিছিল!

যাদবপুর-গ়়ড়িয়া পেরোনের সময়ে পাঁচ বছর আগের স্মৃতি ফিরে আসছিল এ দিন। সে বার সেনাপতিই যাদবপুরের প্রার্থী। রোড-শো’য় সে দিনও ভেঙে পড়েছিল ভিড়। আর তার পরে ভোটে গিয়ে মণীশ গুপ্তের কাছে হার স্বীকার করতে হয়েছিল তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু এ বারের ভিড় কোথাও যেন আলাদা। ‘ও জেঠু, একটু সই করে দিন না’ আব্দার নিয়ে রাস্তা থেকে খাতা এগিয়ে দিচ্ছে পড়ুয়াদের কেউ কেউ। জিপের উপরে উঠে পড়ে হাত মিলিয়ে আসছে অগুনতি অচেনা হাত। সেলফি তোলার ধুম তো লেগেই আছে! কসবার সিপিএম প্রার্থী শতরূপের কথায়, ‘‘তখনও সরকার ছিল বলেই হয়তো সে বারের মিছিল অনেক সংগঠিত ছিল। এ বার কঠিন পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় মানুষ এগিয়ে এসেছেন।’’ সুজনবাবুর সংযোজন, ‘‘সে বার কেন্দ্রীয় মিছিল ছিল। এ বারেরটা শুধুই যাদবপুর, টালিগঞ্জের এলাকা নিয়ে। এটার স্বতঃস্ফূর্ততা অনেক বেশি।’’

তার প্রভাব স্পষ্ট ধরা পড়ল গড়িয়া মোড়ে। মিছিল শেষে যখন সেনাপতিই মাইকে স্লোগান তুললেন, ‘ইনকিলাব’! জনতার ভিড় থেকে ধেয়ে আসা ‘জিন্দাবাদে’ ডুবে গেল তাঁর গলা!

একটা মিছিলের ভালবাসা অনিচ্ছুক সেনাপতির তকমা ছুঁড়ে দিয়ে স্লোগানবাজ সৈনিক বানিয়ে দিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে!

assembly election 2016 Buddhadeb Bhattacharjee CPM
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy