Advertisement
E-Paper

দিদি নন, ভাটপাড়ার ভোটে মুখ এ‌কা ‘অর্জুন ভাইয়া’

মরচে ধরা শব্দটাই ফের ব্যবহার করতে হল গঙ্গাপাড়ের প্রাচীন জনপদে দাঁড়িয়ে। উলটপুরাণ! আর পাঁচটা কেন্দ্রে ঘাসফুল ব্রিগেডের প্রচারের ছবিটাই গুলিয়ে যাচ্ছে এই ভাটপাড়ায় এসে।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৪
নিজের অফিসে অর্জুন সিংহ। — নিজস্ব চিত্র

নিজের অফিসে অর্জুন সিংহ। — নিজস্ব চিত্র

মরচে ধরা শব্দটাই ফের ব্যবহার করতে হল গঙ্গাপাড়ের প্রাচীন জনপদে দাঁড়িয়ে।

উলটপুরাণ!

আর পাঁচটা কেন্দ্রে ঘাসফুল ব্রিগেডের প্রচারের ছবিটাই গুলিয়ে যাচ্ছে এই ভাটপাড়ায় এসে। অন্যত্র কী হচ্ছে? দলনেত্রী নিজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘‘এখানে আমাদের দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া মানে আমাকেই ভোট দেওয়া। কী, আমায় ভোট দেবেন তো?’’ পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে তাতে সায় দিচ্ছেন প্রার্থীরাও।

কিন্তু ভাটপাড়া? এটা দিদি নয়, ‘ভাইয়া’র রাজত্ব!

এখানে দেওয়াল লিখন থেকে শুরু করে পোস্টার-ব্যানার সর্বত্র, ‘ভাইয়া’ই বিরাজমান। অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় দিদির মুখচ্ছবিও এ চত্বরে নেহাত নগণ্য। ভোটযন্ত্রে ঘাসফুল প্রতীকটা ‘ভাইয়া’র নামের পাশে থাকবে ঠিকই। কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সেটা স্রেফ নিয়মরক্ষা। কারণ দিদি বা দল নয়, এখানে আগাগোড়া ‘ভাইয়া’র জন্যই ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁর অনুগামীরা। আর ভাটপাড়ার ভোটাররাও জানেন, এখানে ভোটটা হচ্ছে সেই ‘অর্জুন ভাইয়া’— মানে অর্জুন সিংহের নামে!

রাজ্যের সব থেকে ছোট বিধানসভা কেন্দ্র ভাটপাড়া। আর সেখানকার ‘বেতাজ বাদশা’ অর্জুন। টানা তিন বারের বিধায়ক। প্রতি বারই ভোটে বাড়িয়েছেন ব্যবধানের অঙ্ক। এ বারও বলেছেন, ফের ভাঙবেন নিজের রেকর্ড। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। অর্জুনের থোড়াই কেয়ার। সদর্পে বলছেন, ‘‘ও সব অপপ্রচার।’’

নিজের দলের সঙ্গেও নানা সময়ে টানাপড়েন ঘটেছে অর্জুনের। তবু তিনি স্বমহিমায়। তাঁর অনুচরদের দিদিকে ছেড়ে এমন ‘ভাইয়া-ময়’ প্রচারের যুক্তি খুঁজতে গিয়ে অনেকে বলছেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে সর্বত্র যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে, সেটা বুঝেছেন অর্জুন। সম্ভবত তাই দলকে পিছনের সারিতে রেখে নিজের ভারেই ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন। সারদা, নারদ, উড়ালপুল ভাঙা কিংবা গুড়-জল নিয়ে যখন রাজ্য-রাজনীতি সরগরম, তখন দু’একটা পুরনো অভিযোগে অর্জুনের কিছু যায়-আসে না!

ভাটপাড়ার পুরপ্রধানও অর্জুন। তাঁর কটাক্ষ, গোটা পুর এলাকার ঝকঝকে রাস্তা, টলটলে পানীয় জল। চমৎকার নিকাশি ব্যবস্থা। গোটা এলাকায় ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট। আর কী চাই? অর্জুনের প্রচারে তাই শুধুই উন্নয়নের ধারাভাষ্য।

বিরোধী বাউন্সার অবশ্য আসছে। ‘‘সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, সাদা জুতো, কালো রোদচশমায় উনি তো হিন্দি সিনেমার ভিলেন’’— এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ। শুনে ‘ভাইয়া’র দলবল বলছে, ‘‘উনি সাদা পোশাকের রবিনহুড। ওঁর দানধ্যানের কাহিনী এখানকার বাতাসে ভাসে।’’ সিপিএমের অভিযোগ, বেনামে অর্জুনের নানা ব্যবসা ছড়িয়ে আছে শিল্পাঞ্চলের আনাচ-কানাচে। তাঁর চেলাচামুণ্ডাদের তোলাবাজিতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। বেআইনি বালিখাদান চালান অর্জুন, এমন অভিযোগও আছে। যা শুনে অর্জুনের ছোট্ট জবাব, ‘‘অভিযোগ যখন, প্রমাণ দিন!’’

এই দাপট কিন্তু তাঁর বাম আমল থেকেই। লোকে বলে, সিপিএমের সঙ্গেও অদ্ভুত বোঝাপড়া অর্জুনের। মুখে যতই নিন্দেমন্দ হোক, বাম আমলেও তো নিজের আসনে অটল ছিলেন অর্জুন। তাঁর এ বারের প্রতিপক্ষ— জোটের প্রার্থী জিতেন্দ্র সাউয়ের মনোনয়ন নিয়েও বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। এক সময়ে সিপিএমের টিকিটে পুরভোটে লড়া জিতেন্দ্র এ বার টিকিটই পাননি। পরে আলিমুদ্দিনে হত্যে দিয়ে নির্দল হয়ে জোটের সর্মথন জোগাড় করেছেন। জিতেন্দ্র অবশ্য বলেছেন, ‘‘এখানে প্রতীকের লড়াই হচ্ছে না। আমি এলাকার ছেলে। কিছু পাওয়ার জন্য নয়, সকলকে নিয়ে অন্যায়ের বিরু‌দ্ধে লড়তে নেমেছি।’’

বন্ধ মিলের শ্রমিক কলোনির কথা বলছেন জিতেন্দ্র। ন’টি কারখানার তিনটিই বন্ধ। বাকিগুলিতে কাজ চলছে তিন শিফটের মধ্যে দু’শিফট। বন্ধ এলাকার একটি টায়ার কারখানা-সহ আরও দু’টি মাঝারি কারখানা। এই চরম বেকারত্ব ঘুরপথে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বাড়িয়েছে। মারদাঙ্গা, চুরি-ছিনতাই, তোলাবাজি বেড়েছে বলেই অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। বাম-কংগ্রেস জোট বলছে, এ সবের থেকে মুক্তি পেতেই অর্জুনকে
সরানো দরকার।

হয়তো কাকতালীয়! আইন-শৃঙ্খলার অবনতির এত অভিযোগ যেখানে, সেই কেন্দ্রেরই বিজেপি প্রার্থী এক দুঁদে প্রাক্তন আইপিএস। বিজেপির প্রার্থী রুমেশকুমার হান্ডা গত লোকসভা ভোটে ব্যারাকপুরে হারলেও একমাত্র ভাটপাড়াতেই প্রায় তিন হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন। হান্ডা বলেন, ‘‘অর্জুনের বাবা সত্যনারায়ণ সিংহ যখন বিধায়ক ছিলেন, তখন আমি ব্যারাকপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন তিনি। আর তাঁর ছেলে সম্পূর্ণ উল্টো চরিত্রের।’’ একসুরে সব বিরোধীই বলছেন, ‘ভোট করানোর’ নিজস্ব মেশিনারি আছে অর্জুনের। জিতেন্দ্রর কথায়, ‘‘এখানে মানুষ তো ভোট দিতেই যেতে পারেন না। যদি ভোটটা ঠিকঠাক হয়, অনেক হিসেবই উল্টে যাবে।’’

অর্জুনের রাগ নেই। মুচকি হেসে বলছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন, আমি চাই সামরিক বাহিনী আসুক। কোনও অসুবিধে হবে না।’’

assembly election 2016 Arjun Singh Bhatpara
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy