এক দল জোটের বাইরে গিয়ে খাতায়-কলমে শূন্য! অন্য দল জোটের মধ্যে থেকেও বিপন্ন। দুই বাম দলের এ বারের নির্বাচনী ভাগ্যই ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিপর্যয়ের জন্য শুধু বাম-কংগ্রেসের জোটকে যাঁরা দুষছেন, হিসেব তাঁদের মিলছে না!
সেই ১৯৬২ সালের পরে এ বারই প্রথম বিধানসভায় দেখা যাবে না এসইউসি-কে। তাদের বরাবরের জোড়া ঘাঁটির মধ্যে কুলতলি হাতছাড়া হয়েছিল পাঁচ বছর আগেই। বিধানসভার ভিতরে একা কুম্ভ হয়ে পাঁচটা বছর লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন যিনি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অধ্যাপক তরুণ নস্কর এ বার জয়নগর থেকে পরাজিত। শুধু পরাজিতই নয়। জয়নগরে এসইউসি নেমে গিয়েছে তৃতীয় স্থানে। আসনটি জিতেছে তৃণমূল। আর কুলতলি এ বারও সিপিএম। রাজ্যে মোট ৩ লক্ষ ৬৫ হাজার ৯৯৬ ভোট পেয়েছে এসইউসি, শতাংশের বিচারে যা ০.৭।
তাদের তুলনায় অবস্থা কিঞ্চিৎ ভাল বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের। তারা এ বার নেমে এসেছে দু’টি আসনে, পেয়েছে ২.৮% ভোট। ফল খারাপ হওয়ার পরেই ফ ব রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ কংগ্রেসের সঙ্গে জোটকে দায়ী করতে শুরু করেছেন। যে দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরেই। দলের নেতা-কর্মীদের একাংশই উদাহরণ দিচ্ছেন, জোটটুকু না থাকলে এসইউসি-র অবস্থা হতে পারতো! নির্বাচনী বিশ্লেষণের জন্য আজ, সোমবার ফ ব-র রাজ্য কমিটির বৈঠকেও ঝড় ওঠার সম্ভাবনা।
মাঝে বামফ্রন্টের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে অংশ নিলেও ভোটের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে এসইউসি এবং সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন এ বার আলাদা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরিণামে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাদের। ১৯৭২ সালেও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল এসইউসি। কিন্তু মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া জিতে বিধানসভায় তারা সলতে জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছিল। এ বার সেটাও না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, সিপিএমের দাপট মোকাবিলা করে যারা জয়নগর-কুলতলি ছিনিয়ে আনত, তারা এখন তৃণমূলের হাওয়ায় দাঁড়াতে পারল না কেন?
প্রাথমিক পর্যালোচনায় এসইউসি নেতৃত্ব প্রকারান্তরে জোটকেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, জোট নিয়ে যত হইচই হয়েছে, তৃণমূলের পক্ষে তত ‘সাইলেন্ট স্যুইং’ হয়েছে! কুলতলি ও জয়নগরে গত লোকসভার তুলনায় এসইউসি-র ভোট কয়েক হাজার করে বেড়েছে। কিন্তু সাংগঠনিক ভোটের বাইরে ভাসমান ভোটারদের সমর্থন টানতে না পেরে আসন হাতছাড়া হয়েছে। দলের রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসুর কথায়, ‘‘ভোটের আগেই আমরা বলেছিলাম, তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরবে। তার পরে জোট নিয়ে প্রচার যত তুঙ্গে উঠেছে, মানুষের মনে ৩৪ বছরের আতঙ্ক ফিরে এসেছে। তৃণমূলের শত দুর্নীতি, অন্যায় সত্ত্বেও মানুষ সিপিএমকে ফিরিয়ে আনতে চাননি। সেই বিশ্বাসযোগ্যতা সিপিএম এখনও ফিরে পায়নি।’’
অর্থাৎ জয়নগরের মতো আসনেও এসইউসি-কে জেতানোর মতো ভাসমান ভোট মেলেনি বলে সৌমেনবাবুরা মানছেন। পরিসংখ্যান যদিও বলছে, তরুণবাবুর পাওয়া ৩৯ হাজার ৩৯৭ ভোটের সঙ্গে কংগ্রেস প্রার্থী সুজিত পাটোয়ারির ৪৯ হাজার ৫৩১ ভোট যোগ হলে জয়নগরে তৃণমূল (৬৪ হাজার ৫৮২ ভোট) জেতে না। কিন্তু আদর্শের কারণেই এমন জোট মানতে রাজি হয়নি এসইউসি, যারা ২০০৯-এর লোকসভা ভোট লড়েছিল তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে। যেখানে আবার কংগ্রেস ছিল তৃণমূলের সঙ্গে এবং তাদের সম্মিলিত ভোটই সে বার জয়নগর থেকে এসইউসি-র তরুণ মণ্ডলকে লোকসভায় পাঠিয়েছিল। এ বার আসন না পেলেও সৌমেনবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘এতে আমরা বিচলিত নই। আমাদের গণ-আন্দোসন জারি থাকবে।’’ বাম শরিক ফব অবশ্য যথেষ্টই বিচলিত। পরিবর্তনের ঝড়ে ৩৪টি আসনে লড়ে যারা ১১টি জিতেছিল, এ বার ২৪টিতে লড়াই করে তারা দু’টিতে জয়ী হয়েছে। ভরাডুবির জন্য রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ যে ভাবে জোটকে দুষছেন, তাতে ক্ষুব্ধ দলের অন্য অংশ। তাঁরা বলছেন, রামপুরহাটে কংগ্রেস জেলা সভাপতি সিরাজ সিরাজ জিম্মি প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বীরভূম জেলা নেতৃত্বের কথা অমান্য করে ফব-র কিছু রাজ্য নেতা যদি প্রার্থী চাপিয়ে না দিতেন, তা হলে নলহাটি ও দুবরাজপুর হারতে হত না। কংগ্রেসের সহযোগিতা সেখানে পাওয়া যেত। তাঁরা বলছেন, কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া চাকুলিয়া থেকে আলি ইমরান রাম্জ (ভিক্টর) জিততেন কি না, সে প্রশ্ন থাকছে সেখানে তৃণমূল ও বিজেপি-র গায়ে গায়ে ভোট পাওয়া দেখে! তাঁরা বলছেন, দিনহাটার বাসিন্দা যুব লিগের নেতা আব্দুর রউফকে টিকিট না দিয়ে অন্য কেন্দ্র থেকে অক্ষয় ঠাকুরকে সেখানে সরিয়ে এনে দু’টি আসনই হাতছাড়া হওয়ার দায় কি অন্য দলের? বলছেন, শ্যামপুকুর, পাঁচলা বা গলসিতে প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্তে দলের একটা অংশ যে বসে গিয়েছিল, তার দায়ই বা কার?
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট মানুষ মেনে নিয়েছেন কি না, তা নিয়ে আবার রবিবারই ৯ ঘণ্টার বৈঠকে দীর্ঘ বিতর্ক চলেছে সিপিআই রাজ্য পরিষদে। ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর প্রশ্নেও দ্বিধাবিভক্ত সিপিআইয়ের অন্দর মহল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy