Advertisement
E-Paper

খাটতেও পারে মেয়েটা, বলছে অবাক মাঠ-ঘাট

তেলচিটে হলুদ মাখা আঁচলটা দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিলেন এক বৃদ্ধা। দু’আঙুলে থুতনিটা নাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘জিতবি রে মা, জিতবি।’’মাথায় ঘোমটা, চোখে রোদচশমা। পায়ে স্নিকার্স। মৃদু হেসে পিচ গলা ঠা-ঠা দুপুরে সামনে এগিয়ে যান মহুয়া মৈত্র।

সুস্মিত হালদার ও কল্লোল প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৭

তেলচিটে হলুদ মাখা আঁচলটা দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিলেন এক বৃদ্ধা। দু’আঙুলে থুতনিটা নাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘জিতবি রে মা, জিতবি।’’

মাথায় ঘোমটা, চোখে রোদচশমা। পায়ে স্নিকার্স। মৃদু হেসে পিচ গলা ঠা-ঠা দুপুরে সামনে এগিয়ে যান মহুয়া মৈত্র। রোদে পুড়ে ফরসা রং প্রায় তামাটে। চোখের নীচটা পুড়ে কালো।

সে দিকে নজর দেওয়ার সময় কই? কর্মীদের নিয়ে মহুয়া পার হয়ে যাচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রাম। তাঁর সঙ্গে পা মেলাতে গিয়ে হাঁফিয়ে পড়ছেন তরতাজা কর্মীরাও। বিরোধী দলের কর্মীরাও বলে ফেলছেন, ‘‘খাটতেও পারে মেয়েটা!’’

মহুয়া যে খাটতে পারেন, তা আগে থেকেই জানত নদিয়ার মানুষ। ২০০৮ নাগাদ রাহুল গাঁধীর ‘আম আদমি কা সিপাহি’-র দায়িত্ব নিয়ে তিনি এসেছিলেন এই জেলায়। রোজ সকাল থেকে রাত কর্মীদের নিয়ে গড়ে ১০-১২টা করে বুথ মিটিং করেছেন। চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন যুব কংগ্রস কর্মীরাও। সেই মহুয়াকে করিমপুরে তৃণমূল প্রার্থী করা হয়েছে ওই সময়ে তাঁর প্রায় ছায়াসঙ্গী এক কংগ্রেস নেতা বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘লড়াইটা কিন্তু জমে গেল!’’

লড়াই— নিজদুর্গে সিপিএম + ঘরের ছেলে + বিশ্বস্ত কংগ্রেস বনাম মহুয়া মৈত্র।

একা মহুয়া।

একা, কেননা তৃণমূলের নেতাদের তিনি কার্যত কোনও নম্বরই দিচ্ছেন না। সেই নেতাদের, দলের ভিতরেই যাঁদের একাধিক উপদল। সারা বছর কোন্দল নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। বরং করিমপুরে পা রাখা ইস্তক বুথ স্তরের কর্মীদের নিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর অগ্রবাহিনী। এই খেলা তাঁর আগে থেকে জানা।

বিদেশে পড়াশুনা, বিদেশেই মোটা বেতনের চাকরি, সব ছেড়ে রাহুল গাঁধীর লড়াইয়ে সামিল হতে মহুয়া চলে এসেছিলেন দেশে। ‘আম আদমি কা সিপাহি’র দায়িত্ব নিয়ে বাংলার মাঠে নেমেছিলেন। বুঝে নিয়েছিলেন, নিচুতলার সংগঠন কী করে করতে হয়। করিমপুরে আসার দু’দিনের মধ্যে কেন্দ্রের সব বুথ কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা তিনি জোগাড় করে নিয়েছিলেন। তিনতলা ভাড়াবাড়ির নীচের তলায় একাধিক কম্পিউটার আর ল্যাপটপ বসিয়ে ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন ‘ওয়ার রুম’। সেখানে ১৫ জন কর্মী দিনভর কাজ করছেন। পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতি বুথের যাবতীয় তথ্য ও কর্মীদের ফোন নম্বর তাঁর কম্পিউটারে ‘লোড’ হয়ে গিয়েছে। বুথ কর্মীদের সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছেন।

তাঁদের থেকেই সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করছেন। মাঝে কোনও নেতা নেই। মহুয়ার ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, ‘‘এতে বুথ স্তরের কর্মীরাও চাঙ্গা হচ্ছে। সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে। ভোটটা তো তারাই করে।’’

এই কেন্দ্রে বুথের সংখ্যা ২৫৯। মহুয়া কিন্তু শুধু টেলিফোন করছেন না। প্রতিটি বুথে, প্রতি অলিগলিতে তিনি প্রচারও সেরে ফেলেছেন।
চেষ্টা করেছেন যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছে
যেতে। দুপুরে খাওয়ার জন্য আধ ঘন্টা বিরতি। ফের হাঁটা। মাত্র ১২ দিনে করিমপুর ২ ব্লকের ১০৪টি বুথ পায়ে হেঁটে ঘুরে ফেলেছেন। না করে উপায়ও নেই। করিমপুরে তৃণমূলের আছেই বা কী?

১৯৭৭ থেকে এই কেন্দ্রে একটানা জিতে আসছে সিপিএম। পরিবর্তনের বাজারে কংগ্রেসকে সঙ্গী করে তৃণমূল যাও বা লড়াই দিয়েছিল, পরের ভোটেই কুপোকাত। ২০১৩ সালে এই বিধানসভা এলাকার ১৪টি পঞ্চায়েতের মধ্যে একটিতেও তৃণমূল জিততে পারেনি। সিপিএম একাই ৯টি দখল করে। কংগ্রেস পায় ৩টি, আর একটি বিজেপি-কংগ্রেস যৌথ ভাবে দখল করে। করিমপুর-১ ও ২ পঞ্চায়েত সমিতি সিপিএমের দখলে। জেলা পরিষদে ৫টি আসনেই জয়ী হয় সিপিএম। পরে অবশ্য এক সদস্য তৃণমূলে যোগ দেন। কংগ্রেস ভাঙিয়ে একটি পঞ্চায়েতও দখল করে তৃণমূল। কিন্তু ওইটুকুই।

সংগঠনের এই বাড়বৃদ্ধির জোরে পরের বছর লোকসভা ভোটে ২৯ শতাংশ ভোট ধরে রাখতে পেরেছিল তৃণমূল। চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে তা মন্দ নয়। কিন্তু সে বার সিপিএম এবং কংগ্রেসের পাওয়া ভোট যোগ দিলে তৃণমূলের ধরা-ছোঁওয়ার অনেক বাইরে চলে যাবে। তার উপরে বিজেপি-ফেরত ভোট তো আছেই। লোকসভা ভোটে বিজেপির বাড়বৃদ্ধি যা হয়েছিল, তা মূলত সিপিএমের ভোটব্যাঙ্ক ধসিয়েই। সেই ভোটের একটা বড় অংশ যদি সিপিএমের দিকে ফিরে যায়, তৃণমূলের জেতার আশা আরও ক্ষীণ হয়।

তার উপরে আছেন ‘ঘরের ছেলে’ সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ। সকলের সমরদা। ভূমিপুত্র, বিদায়ী বিধায়ক, বছরভর এলাকায় পড়ে থাকা মানুষ। ফলে, জনপ্রিয়ও বটে। লালঝান্ডা কাঁধে তিনিও তো চষে ফেলেছেন গোটা তল্লাট। তিনি তো খোশমেজাজেই বলছেন, ‘‘তৃণমুল যদি বিজেপি-ভাঙা সব ভোটও পায়, তা হলেও এখানে ওরা হারবে।’’

লড়াইটা যে কঠিন, সম্ভবত তা বুঝেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনসভায় এসে বলেছেন, ‘‘মহুয়াকে জেতান। করিমপুরের উন্নয়ন আমি দেখব।’’ মহুয়া কিন্তু বলছেন, ‘‘দেখুন, এখানে যাঁরা এখনও কংগ্রেসটা করছেন, তাঁরা সব আদি কংগ্রেস। সিপিএমের কাছে মার খেয়েও দলটাকে ধরে রেখেছেন। তাঁরা সিপিএমকে ভোট দিতে পারবেন না।’’

অর্থাৎ মহুয়া পাখির চোখ করছেন ওই ১৬ শতাংশ ভোট, যা তাঁর দিকে চলে এলে খেলার রং পাল্টে যাবে। সম্প্রতি কংগ্রেস থেকে কয়েক জন নেতা তৃণমূলে চলে আসায় বাড়তি অক্সিজেনও পেয়েছেন তিনি।

আর একটা দিনের অপেক্ষা।

যুদ্ধে হারজিত থাকেই। ফল যাই হোক, করিমপুর মনে রাখবে মাথায় ঘোমটা, চোখে রোদচশমা।

পায়ে স্নিকার্স।

assembly election 2016 Mahua Mitra TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy