এক মালায়। মালদহের সুজাপুরের সভায় (বাঁ দিক থেকে) মৌসম বেনজির নুর, সনিয়া গাঁধী, অধীর চৌধুরী এবং আবু হাসেম খান চৌধুরী। বুধবার মনোজ মুখোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
ছেলেকে নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। মাকে নিয়ে নানা জল্পনা উস্কে দেওয়া হতো তৃণমূলের শিবির থেকে। রাজ্যে বিধানসভা ভোটের তৃতীয় পর্বের আগে প্রচারে এসে সে সব জল্পনাই ভেঙে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কড়া আক্রমণ করলেন সনিয়া গাঁধী।
সনিয়ার অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদী ও মমতা একই মুদ্রার এ পিঠ-ও-পিঠ। দু’জনেই স্বৈরাচারী। এবং দু’জনেই প্রয়োজনে পরস্পরকে রক্ষা করে চলেন!
তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে কংগ্রেস সভানেত্রীকে এমন কড়া কথা বলতে সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়নি! মালদহের সুজাপুর ও বীরভূমের মুরারইয়ে বুধবারের জোড়া সভায় সনিয়ার ভূমিকা দেখে জোট-শিবিরে স্বভাবতই উৎসাহের ঝ়়ড়। আর বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়েই সনিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে যেতে হয়েছে তৃণমূলকে!
বঙ্গে প্রচারে এসে এ দিন সনিয়ার সাফ কথা, আর এক দিনও মমতার সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই! মমতার মা-মাটি-মানুষের স্লোগানকেও এই প্রথম কটাক্ষে বিঁধেছেন সনিয়া। বলেছেন, ‘‘মা-বোনদের অবস্থা শোচনীয়! মাটি শুকিয়ে গিয়েছে। মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সরকারে এলে গরিবদের দেখবেন বলেছিলেন মমতা। তাই আমরাও তাঁর সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস ভেঙেছেন মমতা।’’ মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর জমানায় বাংলায় মহিলাদের নিরাপত্তা যে বেহাল, সেই অভিযোগও এনেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। আর সেই সঙ্গে অবধারিত ভাবেই টেনে এনেছেন, ‘‘বাংলায় দুর্নীতির কোনও সীমা নেই। গত পাঁচ বছরে বাংলাকে কী না সহ্য করতে হয়েছে!’’
প্রয়াত বরকত গনিখান চৌধুরীর খাসতালুকে দলের সভানেত্রীর আক্রমণাত্মক ভূমিকা দেখে ভোট-পর্বের মাঝে প্রবল উৎসাহিত প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। তাঁরা চাইলেও সনিয়া শেষ পর্যন্ত বাংলায় প্রচারে আসবেন কি না, তা নিয়েই কিছু দিন আগে পর্যন্ত ঈষৎ সংশয় ছিল। রাহুল এ রাজ্যে এসে মমতার সরকারকে তীব্র আক্রমণ করে যাওয়ার পরে সনিয়াও একই রাস্তায় হেঁটে প্রদেশ কংগ্রেসের হাতে বাড়তি রসদ তুলে দিলেন বলেই অধীর চৌধুরীরা মনে করছেন। বিশেষত, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বে যথাক্রমে মালদহ-সহ উত্তরবঙ্গ এবং মুর্শিদাবাদে ভোট। ঠিক তার আগে সনিয়ার ‘ভোকাল টনিক’ কংগ্রেস তথা জোট-শিবিরের আরও কাজে আসবে।
তৃণমূল নেত্রী বরাবরই বুঝিয়ে এসেছেন, ১০ জনপথবাসিনীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্কের কথা। গত বছরের শেষে সনিয়ার জন্মদিনেও ফুল হাতে শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়েছিলেন মমতা। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ এই সে দিন পর্যন্ত বিরোধী শিবিরে বিভ্রান্তি ছড়াতে দাবি করে গিয়েছেন, বামেদের সঙ্গে জোটের ব্যাপারে সনিয়ার উৎসাহ নেই! সুজাপুরে সেই সনিয়ার মুখেই এ দিন মমতা সম্পর্কে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘কিছু লোক ক্ষমতা দখলের পরে নিজেকে ভগবান মনে করে! ক্ষমতায় থাকতে থাকতে অনেকে অন্ধও হয়ে যায়!’’ পরে মুরারইয়ে আরও চ়ড়া সুরে বলেছেন, ‘‘ইতিহাস বলছে, অহঙ্কারীর পতন হয়। বাংলার এই সরকারও ১৯ মে জবাব পাবে!’’
রাহুলের মতোই সনিয়াও বলেছেন, ‘‘বাংলায় গরিবদের টাকা লুঠ করছে বেআইনি লগ্নি সংস্থাগুলি। মোদী-মমতা কেউ পদক্ষেপ করেননি। মোদী ব্যাঙ্ক লুঠেরাদের আরামে বিদেশে যেতে দিচ্ছেন। আর এখানে চিটফান্ড কারবারিরা মমতার মদত পাচ্ছে!’’ মালদহের সিপিএম জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র এবং প্রার্থী খগেন মুর্মুর উপস্থিতিতে কংগ্রেস সভানেত্রী আরও ব্যাখ্যা করেছেন, সংসদে মোদীজি’র দরকার হলে তৃণমূল তাঁর পাশে দাঁড়ায়। আর এখানে চিটফান্ডের সমস্যা থেকে বাঁচতে মমতা মোদীর সাহায্য নেন। অরুণাচল বা উত্তরাখণ্ডে মোদী সরকার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার সময়ে তৃণমূল টুঁ শব্দটিও করেনি। সনিয়ার তির্যক মন্তব্য, ‘‘এখানে যিনি নিজেকে দিদি বলেন, ওখানে যিনি নমো নমো করেন, তাঁরা একই!’’ ঠিক যে কথা বারবার বলে আসছেন সিপিএম নেতারা।
সনিয়ার এই বক্তব্য শুনে প্রায় তড়িদাহতের ভঙ্গিতে তৃণমূলের মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, ‘‘আপনার ক্ষেত্রে আমরা সব সময় সংযত থেকেছি। ভদ্রতা, সৌজন্য রেখেছি। কখনও আপনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি। কিন্তু এটা আপনি কী করলেন?’’ বাংলায় কংগ্রেসকে সিপিএমের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে কটাক্ষ করে তৃণমূলের পাল্টা অভিযোগ, জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসই বরং বিজেপি সরকারের সঙ্গে আপস করে চলে। সেই জন্যই গাঁধী পরিবারের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা ‘নিয়ন্ত্রণে’ আছে, ইউপিএ আমলের মন্ত্রী এবং সনিয়ার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের তদন্ত এগোয়নি!
গনগনে রোদ উপেক্ষা করে দুই সভাতেই ভিড় হয়েছিল ভাল। তবে বক্তৃতার শেষ ভাগে শুধু কংগ্রেস প্রার্থীদেরই জয়ী করার আবেদন জানিয়েছেন সনিয়া। তাতে কি জোট একটু বেসুরো হল? অম্বরবাবুর জবাব, ‘‘এটা জোটেরই সভা। আমরা চাই, তৃণমূলকে শূন্য করে দিতে। সনিয়াজি তো সেই কথাই বললেন। এটাই ঝড় তুলে দেবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy