Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কেষ্টকে ছাড়বে না কমিশন, বদলি বীরভূমের এসপি

বিরোধী দলের এজেন্ট আর ভোটারদের নাকি নিঃশব্দে ‘ভ্যানিশ’ করে দেবেন তিনি। তাঁর ‘ম্যাজিক’ নাকি কেউ ধরতেই পারবে না! বীরভূমে শাসক দলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের জাদুদণ্ড অবশেষে কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল নির্বাচন কমিশন।

কানে কানে। সিউড়ির চাঁদমারি ময়দানে তাঁর আস্থাভাজন কেষ্টর সঙ্গে শলাপরামর্শে ব্যস্ত দিদি। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

কানে কানে। সিউড়ির চাঁদমারি ময়দানে তাঁর আস্থাভাজন কেষ্টর সঙ্গে শলাপরামর্শে ব্যস্ত দিদি। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৪
Share: Save:

বিরোধী দলের এজেন্ট আর ভোটারদের নাকি নিঃশব্দে ‘ভ্যানিশ’ করে দেবেন তিনি। তাঁর ‘ম্যাজিক’ নাকি কেউ ধরতেই পারবে না! বীরভূমে শাসক দলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের জাদুদণ্ড অবশেষে কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল নির্বাচন কমিশন।

মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী বৃহস্পতিবার কলকাতায় জানিয়ে গেলেন, ‘‘সমস্ত বিরোধী দল ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেবে। আপনারা দ্রুত জেনে যাবেন।’’ এর পর এ দিন রাতেই বীরভূমের এসপি মুকেশ কুমার এবং ময়ূরেশ্বর, লাভপুর আর বোলপুর থানার ওসিকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ এসে যায়। অনুব্রতকে নিয়ে আলাদা কোনও নির্দেশ যদিও জেলা প্রশাসনের কাছে যায়নি। তবে কমিশন সূত্রের খবর, অনুব্রতর বিরুদ্ধে কমিশন সরাসরি এফআইআর দায়ের করতে পারে। ভোটগণনা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার জন্য ভিডিওগ্রাফির টিম রাখা হতে পারে। পাশাপাশি এফআইআরের ভিত্তিতে অতি দ্রুত তদন্ত শেষ করে অনুব্রতকে গ্রেফতারও করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত।

অনুব্রত নিজে নির্বিকার। এ দিনই সিউড়ির জনসভায় স্নেহের কেষ্টর প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘‘কমরেড মনে রেখে দিও, ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। অনুব্রত অ্যারেস্ট হলে অনেকেই কিন্তু অ্যারেস্ট হবে। আর অনুব্রতকে অ্যারেস্ট করে বীরভূম রোখা যাবে না। গায়ে হাত দিয়ে দেখো!’’ দিদির আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে অনুব্রত তাই হাসতে হাসতে নির্বাচন কমিশনারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন। জনপ্রিয় গানের কলি একটু পাল্টে বলছেন, ‘‘কে জৈদী? রাঙামাটির দেশে উকে মানাইছে না। ভোটের পর দিল্লি গিয়ে উকে সিউড়ির মোরব্বা খাইয়ে আসব।’’

নির্বাচন কমিশনে অনুব্রতর বিরুদ্ধে নালিশ নতুন নয়। বেশ কিছু দিন ধরে অনুব্রত গুড়-জল দিয়ে ভোট করানোর হুমকি দিয়ে আসছিলেন। আপত্তিকর মন্তব্য করছিলেন বিরোধী প্রার্থীদের সম্পর্কে। তা নিয়ে কমিশনের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু কমিশন অনুব্রতকে ভর্ৎসনা করেই রেহাই দেয়। তা নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে খানিকটা অসন্তোষ ছিলই। এরই মধ্যে বুধবার আনন্দবাজারে অনুব্রতর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। সেখানে অনুব্রত খোলাখুলি বলেই দেন, ‘‘কোনও বুথে বিরোধীদের এজেন্ট দেখা যাবে না। দিনের শেষে হা-হুতাশ করে সবাই বলবে অনুব্রত বুথ থেকে এজেন্ট তুলে নিতে বাধ্য করেছে। অথচ আমি যে কী করে বাধ্য করলাম সেটা কেউ বলতে পারবে না।’’ বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থক-ভোটার-কেন্দ্রীয় বাহিনী, সকলের খাতিরদারির জন্য ‘গুড়ের বাতাসা’ মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। গুড়ের বাতাসার রং নিয়ে আলোচনায় এর পরেই কালচে লাল মানে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের রং কি না, সে প্রশ্ন ওঠে। চোখ কুঁচকে কেষ্টদা বলেছিলেন, ‘‘আপনি বুঝে নিলেন। আমি কিন্তু বলিনি।’’

সূত্রের খবর, বুধবারই জৈদীর কাছে অনুব্রতর এই বিস্ফোরক বয়ানের খবর পৌঁছয়। তিনি রাজ্যের নির্বাচনী কর্তা সুনীলকুমার গুপ্তর কাছে খোঁজ নেন। সে দিন বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী প্রথমে কেষ্টকে শো-কজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করার কথাও ভাবা হয়। কিন্তু রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতর থেকে জেলাশাসককে বলে দেওয়া হয়, স্থানীয় স্তরে কিছু করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতরও কী করা হবে, তাই নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বিরোধীদের চাপের মুখে কমিশনের ফুল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার কলকাতা ঘুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এ দিন কলকাতায় জৈদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সরাসরি অনুব্রতকে গ্রেফতার করার দাবি জানান। তখনই জৈদী আরও দুই কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে অনুব্রতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বীরভূমের সাধারণ পর্যবেক্ষক এবং পুলিশ পর্যবেক্ষকও ওই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ কমিশনে জানান। পরে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে’র সঙ্গে বৈঠকে জৈদী বীরভূমের ভোট ও অনুব্রত প্রসঙ্গ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার পরেই রাতে জেলা পুলিশে বড় রকম বদলের নির্দেশ আসে। উত্তেজনাপ্রবণ তিনটি থানা— ময়ূরেশ্বর, লাভপুর এবং বোলপুরের ওসি-কে সরানো হয়। বীরভূমের এসপি-র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় মুকেশ কুমারকে। তাঁর জায়গায় আসছেন সব্যসাচী রমণ মিশ্র। বীরভূমে ভোটের তিন দিন আগে কমিশনের এই কড়া পদক্ষেপে খুশি হলেও বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ, সব্যসাচীও শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। একই সঙ্গে তাঁরা সবার আগে কেষ্টকে গ্রেফতারের দাবিতেও অনড়।

এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দাবিকেই আক্রমণ করে বলেন, ‘‘রোজ বলছে অনুব্রত মণ্ডলকে কেন গ্রেফতার করা হবে না? কেন অনুব্রত তোর করেছেটা কী?’’ ঠিক যে রকম দু’বছর আগে লোকসভা ভোটের সময় মুখ্যমন্ত্রী কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘‘কিছু চেয়েছিল, দিসনি নাকি?’’ সেই গলাই এ দিন শোনা গিয়েছে ফের। অনুব্রত আগের দিনই আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, দিদিকে না জানিয়ে তিনি কিছুই করেন না। দিদি কেষ্টর পাশে থেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘সেলিম, সুজনেরা অ্যারেস্ট হবে না? নন্দীগ্রাম কেসে বুদ্ধবাবুরা অ্যারেস্ট হবে না?’’ উত্তরে বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুলে যাচ্ছেন যে এটা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। তাঁর হুমকিতে কমিশন হাত গুটিয়ে থাকবে না। অনুব্রতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE