Advertisement
১৮ মে ২০২৪

(সিন্ডিকেট) দাদারা চলেছে যুদ্ধে

গরমে গুড়-বাতাসা খেয়ে শরীর ঠান্ডা রাখার কথা বলেছে বীরভূম। উল্টো সুরে রাজারহাট-নিউ টাউন বলছে, গুড়-বাতাসা খেলে লড়াই করবে কী ভাবে? তাই আলু-বিরিয়ানি চাই, এনার্জি পাই। বীরভূম শুনিয়েছে ‘চড়াম চড়াম’ ঢাকের বাজনা। রাজারহাট-নিউ টাউন শুনছে, ব্যাঞ্জো আর কুড়কুড়ির বোল।

গ্রাফিক্স: প্রবাল ধর।

গ্রাফিক্স: প্রবাল ধর।

কাজল গুপ্ত ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২৭
Share: Save:

গরমে গুড়-বাতাসা খেয়ে শরীর ঠান্ডা রাখার কথা বলেছে বীরভূম। উল্টো সুরে রাজারহাট-নিউ টাউন বলছে, গুড়-বাতাসা খেলে লড়াই করবে কী ভাবে? তাই আলু-বিরিয়ানি চাই, এনার্জি পাই।

বীরভূম শুনিয়েছে ‘চড়াম চড়াম’ ঢাকের বাজনা। রাজারহাট-নিউ টাউন শুনছে, ব্যাঞ্জো আর কুড়কুড়ির বোল।

আলু-বিরিয়ানি ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। ব্যাঞ্জোও বাজতে শুরু করেছে। তবে রাতের বেলায়, বলছেন এলাকার বাসিন্দারা।

বীরভূম বলেছে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। রাজারহাট-নিউ টাউন বলছে, শেষ রাতের দরকারই হবে না। ভোটের আগেই ভোট শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু কাদের জন্য আলু-বিরিয়ানি, কারাই বা বাজাবে ব্যাঞ্জো-কুড়কুড়ি?

প্রশ্ন শুনেই হেসে ফেলছেন বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, এ তো সকলেই জানে! সিন্ডিকেটের ‘দাদা’রা থাকতে আর কারও ভোট করানোর সাধ্য আছে?

আগামী সোমবার রাজারহাট-নিউ টাউন, রাজারহাট-গোপালপুর, বিধাননগর— তিন বিধানসভাতেই ভোট ‘নিয়ন্ত্রণে’ ছক কষেছেন সিন্ডিকেটের এই ‘দাদা’রা। অভিযোগ তেমনই। এ কথা অস্বীকার করে তৃণমূল নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, সব ভিত্তিহীন। দলের সংগঠন যথেষ্ট মজবুত। বাসিন্দারা বলছেন, সিন্ডিকেটের ‘দাদা’রা এবং তাঁদের দলবল তো আদতে তৃণমূলেরই কর্মী। তাই বিষয়টা এ ক্ষেত্রে একই। মুদ্রার এ পিঠ যা, ও পিঠও তা-ই।

ভিন্ন সুরে ভোটের আগে সিন্ডিকেটের হয়ে সওয়াল করে বোমা ফাটিয়েছেন রাজারহাট-নিউ টাউনের তৃণমূল প্রার্থী সব্যসাচী দত্ত। তাঁর দাবি, সিন্ডিকেট বন্ধ করলে ‘সরকার’ উল্টে যাবে। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের কর্মীরাই তাঁর হয়ে প্রচারের দায়িত্ব সামলান। সে কারণেই ‘আত্মবিশ্বাসী’ সব্যসাচী বলেন, ‘‘৩০ হাজারের বেশি জয়ের ব্যবধান ঠিক হবে না। বড় লজ্জা করবে। তবে বিজেপি-র জামানত জব্দ করবই।’’

কিন্তু সব্যসাচীর এই আত্মবিশ্বাসের বাস্তব ভিত্তি কতটা?

দলের একাংশের কথায়, এটা নির্বাচনী চমক এবং কৌশলও বটে। বিপদ ঢাকা দিতেই এই আত্মবিশ্বাসের ‘গ্যালারি শো’ করছেন তৃণমূল প্রার্থীরা। সব্যসাচী কৌশল সামনে রেখে চলছেন, বাকিরা গোপন করছেন। এইটুকুই তফাত। বাসিন্দারা বলছেন, গত পাঁচ বছরে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এবং ভোট ‘দাদা’দের দাদাগিরি এতটাই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে যে, অনেকেই এঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

সূত্রের খবর, দলের ভিতরেও তৈরি হয়েছে বিভেদ। বিপদের গন্ধ সেখানেই। যেমন, সিন্ডিকেটের একটি বড় অংশ সব্যসাচী থেকে শুরু করে বিদায়ী বিধায়কদের বিরুদ্ধে রয়েছে। প্রয়োজনে তারা বিরোধী দলগুলির সঙ্গে গোপনে হাত মেলাতে পারে। এমন জল্পনা ক্রমশ ছড়াচ্ছে। ফলে ভিতরে-বাইরে মিলিয়ে তৈরি হয়েছে প্রবল চাপ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এ বার অন্য রকম। যার জেরেই এ বার যাবতীয় পরিকল্পনা বদল। নিজের বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কাউকেই কোনও গুরুভার দিচ্ছেন না ‘দাদা’রা। বদলে ফেলা হচ্ছে কৌশল। সেই মতো ঘুঁটি সাজাচ্ছেন ‘দাদা’রা।

যেমন সূত্রের খবর, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সমস্যা সামাল দিতে প্রার্থীর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীদের ভোট প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হবে। শোনা যাচ্ছে, তাপস চট্টোপাধ্যায়ের মূল আস্তানা যে ক্লাবটি, কার্যত সেটিরও দখল নিয়েছে সব্যসাচী-বাহিনী।

রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী, বিদায়ী কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু এবং সাংসদ দোলা সেনের আবার শুধু বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর আতঙ্কই নয়, নিজের অনুগামীদের মধ্যেও বিভেদ রয়েছে। সম্প্রতি জগৎপুরে অনুগামী সঞ্জয়ের খুনের ঘটনায় তা আরও বেড়েছে। তাই তাঁদের ভোটের দায়িত্ব পেয়েছেন এলাকার কাউন্সিলরেরাও। সব্যসাচী-বাহিনীও এই এলাকায় কাজ করবে। পাশাপাশি, অপারেশনে থাকতে পারে ‘আসানসোল’ বাহিনী। তৈরি থাকবে মহিলা বাহিনীও। শেষ বেলায় কাজে লাগানো হতে পারে লোকচক্ষুর ‘আড়ালে’ থাকা বাবাই বিশ্বাস ও তার দলবলকে।

বিধাননগর অবশ্য ব্যতিক্রমী। সেখানে সুজিতের সঙ্গে সব্যসাচী এবং এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর গোষ্ঠীর বিরোধিতা। গত পুর-নিগমের ভোটের গোলমাল চিন্তা বাড়িয়েছে তৃণমূলের। যদিও ‘শান্তিপূর্ণ’ ভাবে প্রথাগত প্রক্রিয়ায় ভোট পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল। তবে দলীয় সূত্রের খবর, সেটা লোকদেখানো। বাহিনী থাকবে গোপনে।

গত বিধাননগর পুরনিগমের ভোটের গোলমাল ভাবমূর্তিতে এতটাই কালি লেপেছে যে, এ বার প্রচারে কার্যত ‘ক্ষমা’ চাইতে হচ্ছে তাঁদের। এমনকী, সেই ‘ভুলে’র পুনরাবৃত্তি না হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। সুজিতবাবু বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে এলাকায় কাজ করি। মানুষ আমাকে চেনে। তাঁদের উপরেই বিশ্বাস রাখি। অন্য কোনও প্রথায় বিশ্বাস করি না।’’ তাঁদের দাবি, এ বার বহিরাগতেরা ভোট করবে না।

দলের একাংশের কথায়, গত পুরনিগমের ভোটে গোলমালের কারিগর ‘ছাড়’ পেল। আর দায় ঘাড়ে নিয়ে সুজিতদাকেই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে হচ্ছে। তাই দলের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকজনদের প্রচারে রাখলেও মূল ভোটের অপারেশনের দায়িত্ব দক্ষিণ দমদম পুরসভা এবং সল্টলেক, দু’জায়গাতেই তিনি দিয়েছেন নিজের বিশ্বস্ত কয়েক জন কাউন্সিলরকে।

বুথের মধ্যে আবার আঁধারে ‘পথ’ দেখাতে তৈরি নির্দলের ‘মোমবাতি’ এবং ‘হ্যারিকেন’। আর খিদে পেলে রয়েছে ‘পাউরুটি’। ওগুলোই নির্দল প্রার্থীদের প্রতীক। বুথের মধ্যে তাঁরাই তৃণমূলের শক্তি বাড়াবে। রাজারহাট-নিউ টাউনে সব্যসাচী ঘনিষ্ঠ সমীর ওরফে ভজাই সর্দার নির্দল প্রার্থী। বিধাননগরে ‘পাউরুটি’ প্রতীকে লড়বে তৃণমূল পরিচালিত অটো ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে পরিচিত পলাশ বিশ্বাস। আবার রাজারহাট-গোপালপুরেও ‘মোমবাতি’ প্রতীকে লড়ছেন তৃণমূলকর্মী বলে এলাকায় পরিচিত রঞ্জিতকুমার দত্ত।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

এ ছাড়াও সিপিএম কিংবা বিজেপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সেজে বসে পড়বেন তৃণমূলের ‘অমুক’ গাজী কিংবা ‘তমুক’ পালের দলবল।

বুথে ঢোকার আগেই যাতে ‘সামলানো’ যায় বিরোধীদের, তাই এখনই বিরোধী প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের তথ্য সংগ্রহ করা চলছে। ভোটের আগেই তাঁদের উপরে চাপ তৈরি করবে সিন্ডিকেট বাহিনী। ভোটের আগে বিরোধীদের ‘চাপে’ রাখা, ভোটে প্রয়োজনে বুথ দখল, কেন্দ্রীয় বাহিনী, বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমকে নাকানিচোবানি খাওয়ানোর জন্য তৈরি গোপন র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সও।

অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল নেতাদের পাল্টা দাবি, সংবাদমাধ্যমের একাংশের সহযোগিতা নিয়ে বিরোধীরা একটানা এই সব কুৎসা রটাচ্ছে। বিরোধীদের হুঁশিয়ারি, ভোট লুঠ কিংবা সন্ত্রাস হলে তার প্রতিরোধও হবে।

বাসিন্দারা অবশ্য তাকিয়ে নির্বাচন কমিশনের দিকে। তাঁদের একটাই প্রশ্ন, ‘ভোট দিতে পারব তো?’ বিধাননগরের কংগ্রেস প্রার্থী অরুণাভ ঘোষের আবেদন, কমিশন যেন এক দিনের জন্য শিরদাঁড়া না হারায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016 syndicate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE