হুমকি পেয়ে আতঙ্কিত পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দারা। (ডান দিকে) যজ্ঞনগরে হামলার চিহ্ন। (ইনসেটে) সভায় আব্দুল মান্নানের হুমকি। নিজস্ব চিত্র।
দাদার পরামর্শ ছিল ভোটের পাঁচদিন আগে থেকেই ‘অপারেশন’ চালাতে হবে!
কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী, সংবাদমাধ্যম, নজরবন্দি— এ সব কিছু থাকা সত্ত্বেও,‘দাদা’ অনুব্রত মণ্ডলের সেই নির্দেশ যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা শুরু হয়ে গিয়েছে জেলায় টের পেলেন বিরোধীরা। শুক্রবার থেকেই কোথাও প্রকাশ্য প্রচার সভায় চলছে হুমকি, তো কোথাও বিরোধীদের পোস্টার ছিড়ে, কর্মী-সমর্থকদের মারধরের অভিযোগ উঠল শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ চিত্র বীরভূমের। ‘অপারশেন’ যে এ দিনও হবে, তার ইঙ্গিত মিলল নানুরে দলের পার্টি অফিসে বসে। সে কথাই শোনা গেল কেষ্টর দশাননের এক মুখ থেকে। বললেন, ‘‘যা হওয়ার হয়ে যাবে। সকাল ১০ টার ভেতরেই। আমরা দলের কর্মী-সমর্থকদের সে কথাই জানিয়ে দিয়েছি।’’
শনিবার লাভপুর পশ্চিমপাড়ায় দেখা গেল অধিকাংশ বাসিন্দার চোখে মুখে চাপা আতঙ্ক আর আশঙ্কা। গ্রামের বুথে ভোট কর্মীদের সঙ্গে পৌঁচ্ছে গিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। ঢিল ছোড়া দূরত্বের থানা থেকে মাঝে মধ্যেই টহল দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। তা সত্ত্বেও এই আতঙ্ক। কারণ, শুক্রবার সন্ধেয় ওই গ্রামেই সভা করে তাঁদের বিপক্ষে ভোট দিলে কার্যত দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান। লাভপুর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী মনিরুল ইসলামের রাজনৈতিক গুরু মান্নানসাহেবের বাড়ি ওই গ্রামেই।
কী হয়েছিল শুক্রবার?
ওই দিন সন্ধেয় ওই গ্রামে সভা করে গ্রামবাসীদের কার্যত আব্দুল মান্নান হুমকি দেন বলে অভিযোগ। বক্তব্য রাখতে গিয়ে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘খুব পরিষ্কার ভাষায় বলছি, ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব। আমরা সিদ্ধান্তই নিয়েছি, তাঁর নাম আইবিএস (ইন্ডিভিজুয়াল বেনিফিসিয়ারি স্কিম) থেকে কেটে দেব। আইবোর (সেচ খনন সংক্রান্ত কাজ) থেকে তার নাম কেটে দেব। খুব পরিষ্কার করে শুনে রাখুন। তার নাম ধান প্রজেক্ট থেকে কেটে দেব, তার নাম অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, বিপিএলই বলুন আর এপিএলই বলুন আর জিআরএ-ই বলুন আর মিনিকেটেই বলুন— যে কোনও সুযোগ-সুবিধা থেকে আমাদের দলের পক্ষ থেকে সে পরিষ্কার বাদ পড়ে যাবে। সেই জন্য সবাইকে বলছি, সতর্ক করে দিচ্ছি, ভোটটা যেন আমাদের এ বারে তৃণমূলের বাক্সে পড়ে।’’
তিনি হুমকি দেন, ‘‘পরিষ্কার করেই বলি জোড়া-জোড়া ভোট দিতে যাবেন। একে অপরের ভোটটা দেখে যেন আমরা বুঝতে পারি যে ভোটটা কে কাকে দিল। কারণ সারা বছর আমি লালন পালন করে যাব, আর ভোটের সময় আমাকে বক দেখাবে, এই জিনিসটা কিন্তু আর আমরা মেনে নেব না।’’
কার্যত, এই হমকির পরই ওই গ্রামে আতঙ্ক ছড়ায়। এ দিন দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় রবিবারের ভোট নিয়ে আলোচনায় মশগুল বাসিন্দারা। আলোচিত হচ্ছে, মান্নানের বক্তব্য নিয়েও। গ্রামে ঢোকার মুখেই বাড়ি সিপিএমের মহুগ্রাম-ঠাকুরপাড়া শাখার সম্পাদক আব্দুল হাইয়ের, তিনি সম্পর্কে আব্দুল মান্নানের ভগ্নীপতিও। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মান্নানের মেজো বোন, আজিফা বিবি। আব্দুল হাই জানান, ‘‘গ্রামবাসীদের আতঙ্ক হওয়ায়ই স্বাভাবিক। এর আগে বহু ঘটনায়, মান্নান বিনা দোষে অনেককে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া করিয়েছে। তারপর যখন ওই সব পরিবারের মেয়েরা মান্নানের পায়ে পড়ে কান্না-কাটি করেছেন, তখন দু’চার দিন থানায় আটকে রাখার পর তৃণমূল করার কিংবা ভোট দেওয়ার শর্তে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তেমনই হবে না, কে বলতে পারে!’’
আজিফা বিবি বলেন, ‘‘দাদা এরকম কথা বলে, ঠিক করেননি। আমার স্বামীও এমন কথা বললে একই কথা বলতাম। মানুষ তাঁর ইচ্ছে মতো ভোট দিতেই পারে। কিন্তু এভাবে চাপ সৃষ্টি করা ঠিক নয়।’’
গ্রামের বুথ-লাগোয়া মান্নানের বাড়ির অদূরেও এ দিন দেখা গেল জটলা। সেখানেও চলছে ভোটের আলোচনা। কিন্তু চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নিজের নাম বলতে রাজি হলেন না। তবে তাঁরা জানালেন, গ্রামের গরিব মানুষেরা বাড়ি তৈরির টাকা পায়নি। নেতারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। বিধবাভাতা, বার্ধক্যভাতার ক্ষেত্রেও রাজনীতির রঙ বিচার করা হয়েছে। এখন তাঁরাও, নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে চান। কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে, যদি সব জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে হয়তো এরপরে গ্রামে টেকাই দায় হবে।
আব্দুল মান্নান অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘আমি সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’
সিপিএমের লাভপুরের জোনাল কমিটির সম্পাদক মানিক মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা আব্দুল মান্নানের ওই বক্তব্যের ফুটেজ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ভোটের কাজ করার জন্য এ দিনই ঠিবা গ্রামে দিলিপ মণ্ডল নামে আমাদের এক কর্মীকে মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দিয়ে তৃণমূলের কর্মীরা। তাঁকে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করেন লাভপুরের তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তরুণ চক্রবর্তী।
শনিবারও জেলার নানা প্রান্ত থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকটি ঘটনার খবর মেলে। তারই একটি নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের যজ্ঞনগরে জোট প্রার্থী সিপিএমের শ্যামলী প্রধানের দলীয় পতাকা ছেঁড়া এবং কর্মী-সমর্থকদের মারধরের অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, জংলা পোশাক পরে বিদায়ী বিধায়ক তৃণমূলের প্রার্থী গদাধর হাজরা অনুগামীরা ৩০টি বাইকে হুমকি দিচ্ছে এলাকায়। তারা ভয়ও দেখাচ্ছে। এই মর্মে স্থানীয় বোলপুর থানায় এবং নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছে সিপিএম। তৃণমূল অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে খবর, আনুষ্ঠানিক প্রচারের শেষ দিন সকালে নানুর কেন্দ্রের জোট প্রার্থী শ্যামলী প্রধান বাহিরী-পাঁচশোয়া পঞ্চায়েত এলাকায় গিয়েছিলেন। যজ্ঞনগরের বাসিন্দা শেখ সেন্টু, শেখ কুদ্দুস, শেখ সাজু, সখিনা বিবি, লাইলি বিবিদের অভিযোগ, শনিবার সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ জনা কুড়ি বাইক আরোহী যুবক জংলা পোষাক পড়ে এলাকায় দাপিয়ে বেরিয়েছে। সিপিএম এবং জোটকে ভোট দিলে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। বোলপুর-নতুনগ্রাম রাস্তার উপর পূর্ব পাড়ায় জোট প্রার্থীর একাধিক পতাকা ছিঁড়েছে। পুড়িয়েছে। এমনকী ওই পাড়ার বাসিন্দা সুলতান মামুদের খামারে লাগানো পতাকা রাস্তায় ফেলেছে। শেখ কামাল হাসান, শেখ মহব্বতকে মারধর করা হয়েছে বলে দাবি।
ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বাইরে বেরিয়ে ধাওয়া করায় তৃণমূলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা পালিয়েছে। ওই গ্রামের পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া, বৈরাগ্য পাড়া, দখিন পাড়া, ইসান পাড়া, সাঁওতাল পাড়া নিয়ে মোট ২১০০ ভোটারের বাস। স্থানীয় যজ্ঞনগর আংশিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে তিনটি বুথে সকলের ভোট দেওয়ার কথা আজ রবিবার। তাদের দাবি, বেশির ভাগ মানুষ সিপিএম কর্মী সমর্থক হওয়ায় তাদের কে বিদায়ী বিধায়ক গদাধর হাজরার অনুগামীরা শাসানি দিচ্ছে। ভয় দেখাচ্ছে। ঘটনার পর এ দিন বিকেলে দলের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় অভিযোগ জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
এ দিন ঘটনার খবর পাওয়ার পর, স্থানীয় বাহিরী সেক্টর অফিস থেকে শতাধিক আধা সেনা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এলাকায় টহলদারি বাড়ানো সহ নজরদারি বাড়িয়েছে পুলিশ এবং আধা সেনা।
সিপিএমের কর্মী সমর্থকদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নানুরের তৃণমূলের প্রার্থী গদাধর হাজরা। তিনি বলেন, “আধা সেনা, পুলিশ মোতয়েন থাকা সত্বেও কি ভাবে ৩০টি বাইকে শতাধিক লোক ওই এলাকায় তাণ্ডব চালাল, সেটাই তো বিস্ময়ের। সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy