এখনও রাতে বাড়িতে থাকতে পারেন না তিনি। এ নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই দীনবন্ধু মণ্ডলের।
দীনবন্ধুবাবুই একসময়ে ছিলেন মিনাখাঁর দাপুটে পঞ্চায়েত প্রধান। শোনা যায় তাঁর আমলেও অনেকের হাল হয়েছিল এরকম।
কিন্তু সে দিন গিয়েছে। সোনাপুকুর-শঙ্করপুর পঞ্চায়েতের এককালের প্রধান দীনবন্ধু অবশ্য হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেই দলটা ছাড়েননি। জার্সিও বদল করেননি। সেই আনুগত্যের প্রতিদানও পেয়েছেন। মিনাখাঁয় এ বার তাঁকেই সামনে রেখে ভোটযুদ্ধে নেমেছে সিপিএম। কোটি কোটি টাকার মাছের ব্যবসা ঘিরে বোমাগুলির লড়াই যেখানে নিত্যদিনের ঘটনা।
যাঁর বিরুদ্ধে মূল লড়াই দীনবন্ধুর, সেই তৃণমূল প্রার্থী উষারানি মণ্ডল আবার সিপিএম প্রার্থীর আত্মীয়। দীনবন্ধুবাবুর বোনের বিয়ে হয়েছে ওই পরিবারে। উষারানির কথা উঠলেই তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কথা বলতেই হয়। ভূগোলের শিক্ষক মানুষটি তৃণমূলের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ। ব্লক তৃণমূল সভাপতি হিসাবে এক কথায় দোর্দণ্ডপ্রতাপই বলা চলে। এক সময়ে দীনবন্ধু-মৃত্যুঞ্জয় ছিলেন ইয়ার-দোস্ত। দীনবন্ধুর বোনের দেওর হলেন মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু হলে কী হবে। রাজনীতি ফাটল ধরিয়েছে পারিবারিক দুই বন্ধু, আত্মীয়ের মধ্যে।
দুই শিবিরের দুই প্রার্থীর আকচাআকচি বুঝতে গেলে চোখ রাখতে হবে সে দিকেও।
সেটা ২০০৯ সালের কথা। মৃত্যুঞ্জয় আর দীনবন্ধু দু’জনেই সিপিএম করেন। দীনবন্ধু পঞ্চায়েতের প্রধান। তৃণমূল নেতা হিসাবে এলাকায় দাপট কম নয় মৃত্যুঞ্জয়েরও। কিন্তু রাজনৈতিক ভিন্নতা দু’জনের বন্ধুত্বে ছায়া ফেলেনি তখনও।
ইতিমধ্যে প্রেক্ষাপট বদল হতে শুরু ককরে। ব্রাহ্মণচক গ্রামে খুন হন বিশ্বজিৎ মণ্ডল এবং দীপঙ্কর মণ্ডল। কুলটি খাল থেকে তাঁদের ক্ষতবিক্ষত দেহ মেলে। মাছের ব্যবসা নিয়ে গোলমালের জেরেই খুন, তদন্তে জানায় পুলিশ। কিন্তু ওই ঘটনায় অভিযোগ ওঠে দীনবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। এলাকা ছাড়া হন তৎকালীন প্রধান। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই জাঁকিয়ে বসেন মৃত্যুঞ্জয়। দীনবন্ধুর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করান। গাঁয়ের লোক বলাবলি করেছিল, স্রেফ টাকা আর ক্ষমতা লোভে নিজের আত্মীয়ের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ করলেন মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু তত দিনে দু’জনের জীবন দুই খাতে বইতে শুরু করেছে।
এলাকায় একরের পর একর জলাভূমিতে মাছচাষের উপরে আধিপত্য কায়েম হয় মৃত্যুঞ্জয়বাবুর। কোটি কোটি টাকার খেলা মাছের ব্যবসায়। শোনা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি তা-ও নাকি চলে আসে মৃত্যুঞ্জয়ের হাতের মুঠোয়। পঞ্চায়েতের ক্ষমতাও দখল করে তৃণমূল। সোনাপুকুর-শঙ্করপুর পঞ্চায়েতে ২০টির মধ্যে ১৯টি আসনেই জয়ী হয় তৃণমূল।
২০১১ সালে তৃণমূল ভোটের টিকিট দেয় মৃত্যুঞ্জয়বাবুর স্ত্রী উষারানিকে। গ্রামের সাদামাঠা বউ হলেও স্বামীর যোগ্য সহধর্মিনী হিসাবে রাজনীতির পাঠ পড়া হয়ে গিয়েছে তাঁর। তৃণমূল কর্মী হিসাবে এলাকায় নামডাকও হচ্ছে।
স্ত্রীকে ভোটে দাঁড় করালেও মূল লাগামটা থেকে যায় মৃত্যুঞ্জয়ের হাতেই। দীনবন্ধু তখনও এলাকা ছাড়া বলে তাঁর দাবি। জানালেন, জোড়া খুনের মামলায় সিআইডি চার্জশিট থেকে তাঁর নাম বাদ দিলে ফিরেছিলেন এলাকায়। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটর দিনই। আর ওই দিনই সকালে দীনবন্ধু ও আরও কিছু সিপিএম কর্মী-সমর্থকের উপরে বোমা-গুলি নিয়ে হামলা হয় ব্রাহ্মণচক গ্রামে। যার নেতৃত্বের ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়-উষারানি— অভিযোগ ওঠে এমনটাও।
পুলিশের চার্জশিটে অবশ্য মণ্ডল দম্পতির নাম বাদ যায়। কিন্তু দুই আত্মীয়ের পরিবারের মধ্যে শত্রুতার বীজটা পাকাপাকি ভাবে পোঁতা হয়ে যায়।
আর সেই সঙ্গে ভেড়ি বা ইটভাটার ব্যবসাকে ঘিরে লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাসের নতুন নতুন কাহিনী লেখা হতে থাকে মিনাখাঁর গ্রামে গ্রামে। গত কয়েক বছরে একাধিক ঘটনায় রক্তাক্ত হয়েছে মিনাখাঁ। সাধারণ মানুষের যেন কতকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে এই পরিবেশ।
কথা হচ্ছিল এলাকার বাসিন্দা খালেক মোল্লার সঙ্গে। বললেন, ‘‘আগে এ সব ছিল সিপিএমের গড়। পরে এল তৃণমূল (২০১১ সালে ভোটে জেতেন উষারানি)। কিন্তু এখানকার পরিবেশের বদল হল কই! এখনও গ্রামের বহু মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারেন না।’’
এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের সোনালি সর্দার, কাপালি মুন্ডা, রতন সোরেনরাও বিতশ্রদ্ধ। জানালেন, ইটভাটা আর মেছোভেড়ি তৈরি হয়েছিল গরিব মানুষকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোগানোর জন্য। কিন্তু গরিবের কথা আর কে কবে ভেবেছে! প্রতিবাদ করতে গেলে বোমা-গুলি ছুটে আসে। নয় তো ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরিবর্তনের জমানাতে এখন আবার শুরু হয়েছে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তার জেরেও বার বার অশান্ত হয় এলাকা।
ডান-বাম দুই প্রার্থীর বাড়িই ব্রাহ্মণচকে। সিপিএমের হাড়োয়া ১ লোকাল কমিটির সম্পাদক দীনবন্ধুবাবু বলেন, ‘‘তৃণমূলের অত্যাচারে এখানকার মানুষ তিতিবিরক্ত। যেখানে যাচ্ছি, মানুষের মুখে ওদের অত্যাচারের কথাই শুনছি।’’
উষারানি মিতভাষী। বললেন, ‘‘এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ সে দিকে তাকিয়েই ভোট দেবে।’’
উন্নয়নের মতো তথাকথিত ‘বায়বীয়’ জিনিস নিয়ে বেশি কথা বলেন না মৃত্যুঞ্জয়। বরং দীনবন্ধুর তোলা অভিযোগ খারিজের দিকেই তাঁর নজর বেশি। বললেন, ‘‘উনি মোটেই ঘরছাড়া নন। নিরাপদেই গ্রামে থাকছেন। প্রচারও করছে। মাঝে মাঝে কলকাতার বাড়িতে যান। আর বলেন, গ্রামে নাকি কেউ ঢুকতে দিচ্ছে না।’’ কিন্তু এলাকায় সন্ত্রাস, অত্যাচারের অভিযোগ— এ সব নিয়ে কী বলবেন? শিক্ষক মশাই কথায়-বার্তায় চৌকস। প্রশ্ন শেষ করার আগেই জবাব মেলে, ‘‘ও সব বাম আমলে হতো। দীনবন্ধুর সময়েই এ সব অভিযোগ উঠত। এখন শান্তি ফিরেছে।’’
বোমা-গুলির ধোঁয়ায় মাঝে মধ্যেই আচ্ছন্ন হয়ে ওঠা মিনাখাঁর গ্রামের মানুষের কাছে সারদা, নারদ কাণ্ড কিংবা রাজ্য জোড়া আরও পাঁচটা বিতর্কের তেমন আঁচ পড়ে না।
কিন্তু এরই মধ্যে এই সব বিষয়ে বিতর্ক উসকে দিতে চাইলেন বিজেপি প্রার্থী জয়ন্ত মণ্ডল? সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে লড়াই করা জয়ন্তবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমরা এখানে ভাল ফল করব।’’
তবে এটা ঠিক, তৃণমূল এবং সিপিএম প্রার্থী একে অন্যকে চেনেন হাড়ে-মজ্জায়। আর সেটাই মিনাখাঁর ভোটের লড়াইকে আরও টানটান করে তুলেছে। এলাকার লোকজনের অবশ্য একটাই বক্তব্য, ‘‘বামেরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চায় এখানে। কিন্তু তাতে ছা-পোষা গেরস্থের ঘরে শান্তি ফিরবে তো?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy