Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Belpahari

Bengal Polls: এ বার কার পক্ষে সুপবন

২০১১-য় পালাবদলের ভোটেও বিনপুরে জেতা কাস্তে-হাতুড়ি-তারার দিবাকর হাঁসদা ২০১৬-য় আর গড় ধরে রাখতে পারেননি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১ ০৫:২৪
Share: Save:

পিঁড়ারে পলাশের বন, সেই বনেতে সুপবন বহে।

বেলপাহাড়ির পুলিশ ক্যাম্পে বুক-ডন মারছে বেঢপ উর্দির এক ঝাঁক ছেলে। অধিকাংশই বেপথু হয়ে মাওবাদীদের নানা স্কোয়াডে ভিড়েছিল। কয়েক জনের কপালে ভাঁজ। সঙ্গীদের দিকে যেন নজরই নেই। তাঁদেরই এক জন বুধন মান্ডি (নাম পরিবর্তিত)। এক সাঁঝে তাদের কুঁড়েঘর ঘিরে ফেলে গামছায় মুখ-ঢাকা অস্ত্রধরেরা। পরের জমি কুপিয়ে খাওয়া বাপটার বদ অভ্যেস ছিল— অবসরে মদ-মহুল না-খেয়ে লাল পার্টির নেতাদের পেছু পেছু ঘোরা। খেতমজুর সমিতির মেম্বার হয়ে নেতাদের বিলি করা পোস্টার সাঁটত গ্রামে। অস্ত্রধরেরা তাই তাকে ‘নিয়ে যেতে’ এসেছে। শাস্তি দেবে। মা-টা কাঁদল খুব, পায়ে পড়ল। সজনে গাছের আড়াল থেকে খালি গায়ে ইজের পরা বছর বারোর বুধন দেখল, চেক কাটা গামছায় তার বাপটার হাত বেঁধে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে গেল তারা। সেটা এগারোর এই মার্চেই। ছোট্ট বুধনকে নিয়ে সাড়ে তিন বছর খড়্গপুরে বস্তি বাড়িতে লুকিয়ে থেকেছেন ঘরছাড়া মা। লোকের বাড়িতে বাসন মেজেছেন। তার পরে এক দিন ভাঙা ভিটেয় যখন উঠলেন, কেউ আটকাল না। মাটির দেওয়ালে গোবরের লেপ পড়ল। উঠোনে পোঁতা চারায় লঙ্কা ধরল, ছাঁচিকুমড়ো-শশাও। শুধু বাপটা আর ঘরে ফিরল না।

সেই বুধনেরও নাম উঠেছে এনভিএফ-এর ট্রেনিংয়ে। তবে তার আশপাশে আজ পিটি-প্যারেড করছে যারা, তারাই এক দিন তার বাড়িতে চড়াও হয়ে বাপটাকে যে নিয়ে গিয়েছিল, এই সারসত্য সে ভোলে কী করে? বেলপাহাড়ির ক্যাম্পে একসঙ্গে ওঠবোস করে ঘাতক ও তাদের শিকারের ভাই-ছেলে-স্বজনেরা। সুপবন না দীর্ঘশ্বাস?

শুভঙ্কর মণ্ডলের দুই দাদা ‘চরম শাস্তি’ পেয়েছেন। তুলে নিয়ে যাওয়া কাকার খোঁজ মেলেনি। গুলিতে পঙ্গু বৌদি। চাষবাস করে খাওয়া গোটা পরিবারটার অপরাধ, তখনকার শাসক দলের সঙ্গে ছিল। মিছিলে হাঁটত, স্লোগান দিত। ঘরছাড়া হতে হয়েছে বাকি প্রাণগুলো বাঁচাতে। পালা বদলের পরে ২০১২-র ৮ অগস্ট মুখ্যমন্ত্রী বেলপাহাড়ির জনসভায় ঘোষণা করেন— শুধু বন্দুকধারীরাই নয়, মাওবাদীদের হাতে নিহতের পরিবার ও নির্যাতিতরাও প্যাকেজ পাবেন। তত দিনে ২০০-রও বেশি অস্ত্রধরের চাকরি হয়ে গিয়েছে। শুভঙ্কর মনে করান, “সেই সভা, যেখানে সারের দাম বাড়ছে কেন প্রশ্ন করায় ‘মাওবাদী’ বলে পুলিশ জেলে ভরেছিল শিলাদিত্য চৌধুরীকে।”

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে শুভঙ্করেরা থানায় গিয়েছেন, নবান্নয় গিয়েছেন, কালীঘাটেও। প্রশাসনের কর্তারা বলেন, নির্যাতিতের তালিকা নেই। কয়েক জন মিলে ঝাড়গ্রাম, লালগড়, বিনপুর, নয়াগ্রাম ঘুরে ঘুরে নিহত-নিখোঁজের তালিকা তৈরি করতে লাগেন। পাশাপাশি অস্ত্রধরদের গুলিতে, বেধড়ক মারে পঙ্গুদেরও। ২০১৭-য় গড়ে ওঠে ‘মাওবাদীর দ্বারা শহিদ, নিখোঁজ ও আহতদের যৌথ মঞ্চ’। সিপিএমের অফিসে অফিসে ঘুরে তালিকা পেয়েছেন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছেন মঞ্চের নেতারা। ১০ বছর ধরে নিখোঁজ ৮৭ জনের দরখাস্ত জমা পড়লেও ডেথ সার্টিফিকেট মেলেনি এখনও। নিহতদের থানা ডেকে মাঝে মাঝে টাকাটা-শাড়িটা দিলেও নিখোঁজদের ও-সব নেই। বুধন ভাগ্যবান, ট্রেনিংয়ের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এমন সুযোগ পাওয়া নির্যাতিতের সংখ্যা হাতে গোনা। তবে শুভঙ্কর জানান, তাঁরা ‘সরকারের সঙ্গেই’ আছেন। যুক্তি দেন, উপায়ই বা কি? ভোটের মুখে মঞ্চের সঙ্গে দুই ফুলের দর কষাকষি হচ্ছে বলে খবর। শুভঙ্করের ঘোষণা— “আমাদের মঞ্চ অরাজনৈতিক। আগে যা করেছি করেছি, এ বার ভোট আমরা নষ্ট করব না। যাদের সরকার গড়ার চান্স নেই, তারা এ বার ভোট পাবে না। তবে দিদির উপর এখনও আস্থা রাখছি।”

২০১১-য় পালাবদলের ভোটেও বিনপুরে জেতা কাস্তে-হাতুড়ি-তারার দিবাকর হাঁসদা ২০১৬-য় আর গড় ধরে রাখতে পারেননি। এ বারেও তিনিই প্রার্থী। তবে, লোকে বলছেন এ বার টক্কর দুই ফুলে— জোড়া ফুলের দেবনাথ হাঁসদার সঙ্গে মাঝি-মাড়োয়া সংগঠনের নেতা পদ্মের প্রার্থী পালন সোরেনের। বিজেপির সদ্যপ্রাক্তন জেলা সভাপতি সুখময় শতপথী বলছেন, “পালনকে প্রার্থী দেওয়াটাই মাস্টারস্ট্রোক। আর নয়াগ্রামে ২০১৬-তেই দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন পদ্মের বকুল মুর্মু। গত বারের প্রথম জোড়াফুলের দুলাল মুর্মুকে টপকে এ বার তাঁর এক নম্বরে আসাটা সময়ের অপেক্ষা।” লোকসভা ভোটেও নয়াগ্রামে এগিয়ে ছিল পদ্ম। সুখময়ের দাবি, “ঝাড়গ্রাম জেলার ৪টে আসনেই ২ মে গেরুয়া আবির উড়বে।” জোড়াফুলের ছত্রধর মাহাতো মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিনপুরে লোকসভা ভোটে কিন্তু তৃণমূলই এগিয়ে ছিল। আর বিধানসভা ভোটে চারটি আসনেই বিজেপির আসল প্রতিপক্ষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুতরাং... খেলা হবে।

কনকদুর্গা মন্দিরের চত্বর সেজে উঠেছে রাজ্য সরকারের অনুদানে। মন্দির থেকে জাম-কালো রাস্তা ডুলুং নদী টপকে এক বাঁকে পৌঁছে গিয়েছে চিল্কিগড়ের রাজবাড়িতে। শীর্ণ ডুলুং বর্ষা এলেই ভরভরন্ত, কোমর-জল তখন খলবলায় রাস্তায়। এখানে সেতুর দাবি চিরন্তন। হয়নি বলে রাগ আছে মানুষের। সেখান থেকে গিধনি, বেলপাহাড়ি, ওদোলচুঁয়া ছুঁয়ে পাহাড়ি শালবনের মধ্যমণি কাঁকড়াঝোড়।

হোম-স্টে চালানো প্রদীপ মাহাতোর সতর্কবার্তা, “চলাফেরা সাবধানে! চোখকান খোলা রেখে।” মাওবাদী? হাসেন প্রদীপ। “গণেশঠাকুর। দল বেঁধে ঘোরেন তো!” হাতির পাল।

ভোটের হাওয়ার মধ্যেও বসন্তের হাওয়া শহুরে মন ফের টানছে কাঁকড়াঝোড়। ফের সেজে উঠেছে ডিনামাইটে উড়িয়ে দেওয়া পর্যটক আবাস। ঝাঁপ খুলেছে একের পর এক হোম-স্টে। আর একটু এগিয়েই বাঁয়ে বেঁকে আমলাশোল। ২০০৪-এ গর্বের বাম আমলের গালে কালো ছোপ ফেলা সে-ই আমলাশোল। অনাহার আর অপুষ্টিতে সে বার মারা গিয়েছিলেন জঙ্গলের তেন্দুপাতা কুড়িয়ে, বাবুই ঘাসের দড়ি বানিয়ে দিন গুজরান করা লোধাপল্লির চার জন শবর। তাঁদেরই এক জন বুধু শবরের বাবা।

“অ বুধু, বুধু। অ বুধু!”

বেলা দেড়টাতেও সকাল হয়নি বুধুর। বৌয়ের ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে দাওয়ায় এসে বসেন। এক মুখ সরল হাসি। মেলায় গিয়েছিলেন কাল। রাত করে ফিরেছেন। এক-ঘরের পাকা বাড়ি। পাকা মেঝের কোণে কাঠ পুড়িয়ে রান্নার কালি। কোনও আসবাব নেই ‘বিনপুর-২ নম্বর পঞ্চায়েতের ১ লক্ষ ৯১ হাজার ৯৯৩ টাকা বরাদ্দে নির্মিত’ ঘরে। ‘উপভোক্তা মালতী শবর’ কে? শীর্ণ বুকে টোকা মেরে বুধু বলেন, “আমার বোন আছে।” তিনি থাকেন না, তাই বুধু থাকেন। পাশে ‘উপভোক্তা বুধু শবর’-এর ঘরে কাঠ কেটে রাখা। ছাগল বাঁধা।

আজও আধার কার্ড নেই, রেশন কার্ড নেই। তবে ভোটার কার্ড আছে। পোলিং বুথ হয় আমলাশোলেই। বাদবাকি সব কাজে যেতে হয় ১৬ কিলোমিটার দূরে বিনপুর-২ পঞ্চায়েত অফিসে। “ধুস, কে যায়”, আড়মোড়া ভেঙে ঘরে ঢুকে যান বুধু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Belpahari West Bengal Polls 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE