Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
BT Road

Bengal Polls: বিটি রোডের ধারে ভোটের অঙ্কে মশগুল তিন শিবিরই

বরাহনগরে কংগ্রেস আমলের গণহত্যার স্মৃতি এখনও বহু প্রবীণ নাগরিকের মন থেকে মুছে যায়নি। তাঁদের বড় অংশই বামপন্থী।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনির্বাণ দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৩৫
Share: Save:

কামারহাটিতে খেলা হবে?

মুচকি হেসে মদন মিত্রের উত্তর, ‘‘লাভলি খেলা হবে।’’

গত বিধানসভা নির্বাচনে জেল থেকে লড়ে পরাজিত হয়েছিলেন মদন। পাঁচ বছরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ভোট-যুদ্ধে আবার কামারহাটিতেই মদন। হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘ওরা (বিরোধীরা) প্রচার করেছিল মদন মিত্র আর কামারহাটিতে ফিরবে না। ফিরেছি। মানুষ জানেন মদন মিত্র গদ্দার নন।’’

তৃণমূলের এই মিত্রমশাই বঙ্গ রাজনীতিতে সব সময়ই আলাদা। ভোটের আগে এ বার তিনি ‘ও লাভলি’ মিউজিক ভিডিয়ো প্রকাশ করে সাড়া ফেলেছেন। প্রচারে গানের দু’চার লাইন গাইছেন নাকি? ঠোঁটের কোণে হাসি। কর্মী-সমর্থকদের আবদারে গাইছেনও। একটি হিন্দি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ‘লাভলি’ তুলেই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের মদন-খোঁচা, ‘‘অমিত-মোদী কাঁদবে যবে, শেষের খেলা সে দিন হবে। ও লাভলি।’’

মদনের মতোই বর্ণময় তাঁর ভোটপ্রচার। তাঁর হয়ে গত ৪ এপ্রিল প্রচার করে গিয়েছেন সাংসদ-অভিনেত্রী নুসরত জহান। হুডখোলা গাড়িতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রাজসিক পাগড়ি পরিহিত মদন। হাত নাড়ছেন আমজনতার উদ্দেশে। দেখে বোঝা দায়, রাজ্যের প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী প্রচার করছেন নাকি, ভোট-যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরে মানুষের অভিনন্দন কুড়োচ্ছেন। মদন এমনই! তাঁর প্রচারে টলি-টেলির তারকারা যেমন আছেন, তেমনই রোড শো করেছেন বলিউডের মহিমা চৌধুরীও। দোলের দিন গঙ্গাবক্ষে বিজেপির তিন অভিনেত্রী-প্রার্থীর সঙ্গে রং খেলে বিতর্কে মদন। তার আঁচ পড়েছে কামারহাটির ভোট-যুদ্ধে। সিপিএম এ নিয়ে প্রচারের সুযোগ ছাড়ছে না। তবে ওই প্রচারকে তেমন আমলই দিচ্ছে না প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী। সম্প্রতি নিজে বাইক চালিয়ে দু’তিন কিলোমিটার বাইক মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। প্রচারে জোর দিচ্ছেন উন্নয়নে। দক্ষিণেশ্বরের স্কাইওয়াক থেকে স্টুডেন্ট লাইব্রেরি তৈরি, বিএড কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ নির্মাণ থেকে দক্ষিণেশ্বরে জেটি— উন্নয়নের লম্বা তালিকা।

মদন মানছেন তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ আর এক মিত্র। সিপিএমের সায়নদীপ মিত্র। এ বার ভোটে সিপিএম যে ক’জন নজরকাড়া তরুণকে প্রার্থী করেছে, সেই তালিকার অন্যতম মুখ ডিওয়াইএফের রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ। লোকসভা ভোটের নিরিখে তৃণমূল এই আসনে ১৭ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে। কিন্তু ‘হাল ফেরানোর’ লড়াইয়ে হাল ছাড়ছেন না সায়নদীপ। অলিগলি, তস্য গলিতে ঘুরছেন। প্রায় প্রতিটি বাড়ি, আবাসনের দরজায় গিয়ে তিনি বলছেন কর্মসংস্থানের কথা। সায়নদীপের প্রচারে অল্পবয়সি ও মহিলাদের উপস্থিতি নজর কাড়ছে। প্রচারে বলছেন, ‘‘গত ১০ বছরে উনি (মদন মিত্র) এবং ওঁর দল কামারহাটির রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে তছনছ করে দিয়েছেন।’’ সিপিএমের প্রচার, তৃণমূলের অনেকের মতোই মদনও নাকি বিজেপির দিকে এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন। অভিযোগকে উড়িয়ে মদনের জবাব, ‘‘তৃণমূলের দুর্দিনে ছিলাম, এখন সুখের দিন আসছে। আর দল ছেড়ে যাব! আমি কালিদাস নাকি!’’

গত ১০ বছরে কামারহাটিতে উন্নয়ন হয়নি, এমন কথা কেউই বলছেন না। কিন্তু মে দিবস পল্লি থেকে আড়িয়াদহের রামকৃষ্ণ পল্লির বাসিন্দাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, মদনের কাছে যখন গিয়েছি খালি হাতে ফিরিনি, কেউ বলেছেন, সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে, তোলাবাজি-সিন্ডিকেট রাজ জাঁকিয়ে বসেছে। বিজেপি প্রার্থী রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল জমানায় কামারহাটিতে টাকা ছাড়া কিছু হয় না। এ বার আসল পরিবর্তন।’’

কামারহাটিতে অঙ্ক কষছে তিন শিবিরই। মদনের চিন্তা, লোকসভার মতো কি এ বারও বামভোট বিজেপিতে যেতে পারে। কামারহাটিতে অন্তত ৬০ হাজার সংখ্যালঘু ভোট। বিজেপি-ভীতিতে এই ভোটের বড় অংশ তৃণমূলে গেলে স্বস্তিতে থাকবেন মদন। উদ্বাস্তু ভোটও রয়েছে। তার বড় অংশ এ বার তাদের দিকে বলে দাবি পদ্ম-শিবিরের।

পাশের কেন্দ্র বরাহনগরে লড়ছেন তৃণমূলের আর এক ওজনদার প্রার্থী তথা মন্ত্রী তাপস রায়। বছরভর জনসংযোগই তাঁকে প্রতিপক্ষ বিজেপির প্রার্থী অভিনেত্রী পার্নো মিত্র ও কংগ্রেসের অমলকুমার মুখোপাধ্যায়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে রেখেছে। তাপস বলছেন, ‘‘পানীয় জল, নিকাশির সমস্যা দূর করেছি। জল জমা নিয়ে আড়াইটা জায়গায় সমস্যা আছে, মিটিয়ে ফেলব। সারা বছর মানুষের সঙ্গে থাকি, তাঁদের প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে।’’ বিজেপির তারকা প্রার্থীর হয়ে রোড শো করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী। পার্নোকে নিয়ে গেরুয়া শিবিরের কর্মীরা ঘুরছেন বটে, তবে তাপসকে টক্কর দেওয়ার মতো জোর চোখে পড়ছে কই। প্রচারে বিজেপি বলছে, পানীয় জলের সমস্যার কথা, নিকাশির দুরবস্থা। পার্নোর কথায়, ‘‘যে সাড়া পাচ্ছি তাতে অভিভূত।’’

বরাহনগরে কংগ্রেস আমলের গণহত্যার স্মৃতি এখনও বহু প্রবীণ নাগরিকের মন থেকে মুছে যায়নি। তাঁদের বড় অংশই বামপন্থী। বরাহনগরের রাজনীতি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের একাংশের মতে, এই প্রবীণ বামপন্থীদের কাছে কংগ্রেস এখনও অচ্ছ্যুৎ। তাই সেই ভোট বড় ফুলে যাবে নাকি ছোট ফুলে, তা নিয়ে অস্ফুটে জল্পনা বরাহনগরে।

পানিহাটি বিধানসভা আসনের প্রচারে দেখলে একটু ধন্দে পড়তে হয়। রাজ্য রাজনীতির চেয়ে এখানে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে স্থানীয় বিষয়গুলি। নিকাশি, রাস্তাঘাট, পরিস্রুত পানীয় জলের দাবির পাশাপাশি বিরোধীদের দাবি, বিধায়ক তথা এ বারে তৃণমূল প্রার্থী নির্মল ঘোষ এখানে ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করেছেন। এ সবকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না বিধানসভায় শাসকদলের মুখ্য সচেতক নির্মল। প্রচারে বলছেন, ‘‘উন্নতমানের নিকাশির ব্যবস্থা হয়েছে। পানীয় জলের সমস্যা অল্প কয়েক জায়গায় থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় মানুষ পরিস্রুত জল পাচ্ছেন। উন্নত মানের স্কুল করেছি। তৈরি হচ্ছে স্টেডিয়াম।’’ তাঁর আশা উন্নয়নই তাঁকে ভোট বৈতরণী পার করে দেবে।

নির্মলের উন্নয়নের ফিরিস্তিকে স্রেফ ‘গল্প’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন গত বার ‘হাত’ চিহ্নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এ বারের পদ্ম-প্রার্থী সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও কংগ্রেস প্রার্থী তাপস মজুমদার। দীর্ঘদিন কংগ্রেসে কাউন্সিলর ছিলেন সন্ময়। ঠিক ভোটের মুখে দলবদল করে বিজেপি প্রার্থী হওয়ায় ভোটদাতাদের কাছে জবাবদিহি করতে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে তাঁকে। ভোটের দিন তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি ও নির্মলের প্রভাবের সঙ্গে কী ভাবে মোকাবিলা করবেন? প্রশ্নে থমকান সন্ময়। জবাব, ‘‘আমাদের সংগঠন এখন অনেক গোছানো। মানুষের উপরে আস্থা আছে।’’ পানিহাটিতে জোট প্রক্রিয়া অনেক জায়গার তুলনায় মসৃণ। প্রচারে তেমন জৌলুস না-থাকলেও অলিতে-গলিতে ঘুরছেন কংগ্রেসের তাপস। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামাঞ্চলেও যা উন্নতি হয়েছে, পানিহাটিতে তা হয়নি। এখানে উন্নয়নে নামে দুর্নীতি হয়েছে। বিধায়ক যা করেছেন তা নিজের পরিবারের জন্য করেছেন।’’

পানিহাটিতে কান পাতলে শোনা যায়, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা। নির্মলের দাবি, সেই সমস্যা মিটেছে। ‘গদ্দার’রা দল ছেড়েছেন। কিন্তু দলের মধ্যেই এখনও কত ‘বিভীষণ’ রয়ে গিয়েছেন, তার হিসেব কারও কাছেই স্পষ্ট নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE