Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Lakshman Seth

Bengal Polls: লক্ষ্মণ-শেল জনতারই, মনে করাচ্ছে শিল্পশহর

হলদি তীরের এই শিল্পশহর বন্দর শহরও বটে। তবু ভরা ভোট মরসুমে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়া ছাপিয়ে জনতার মুখে রাম (পড়ুন শুভেন্দু)-লক্ষ্মণ তুলনা।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২১ ০৭:২৬
Share: Save:

এ শহর জানে ভানুমতীর খেল!

সঞ্জয় জানার (নাম পরিবর্তিত) ঠোঁটে বাঁকা হাসি। হলদিয়ায় বড় কারখানার গেটে পান-সিগারেটের গুমটির দোকানি সঞ্জয় বলছেন, ‘‘ভোটের খেলায় আসল জাদুকাঠি যে জনতার হাতে, তা আমাদের শহর কবেই দেখিয়ে দিয়েছে। লক্ষ্মণ শেঠের মতো লোক রাজা থেকে এখন ফকির। গেল বার শুভেন্দু অধিকারীর প্রার্থীকেও ধাক্কা দিয়েছি আমরা।’’
আর এ বার?

হলদি তীরের এই শিল্পশহর বন্দর শহরও বটে। তবু ভরা ভোট মরসুমে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়া ছাপিয়ে জনতার মুখে রাম (পড়ুন শুভেন্দু)-লক্ষ্মণ তুলনা। দু’জনেই প্রাক্তন সাংসদ, এইচডিএ-র চেয়ারম্যান। সব দল ঘুরে একজন রাজনীতিতে প্রায় দাঁড়ি টেনেছেন। নিজের একদা ‘প্রতাপগড়ে’ এক অর্থে বন্দি তিনি। আর অন্য জন সবে বিরোধী দলে নাম লিখিয়েছেন। অনেকের আবার কটাক্ষ— পরিণতিতেও মিলে যাবেন ‘রাম-লক্ষ্মণ’।

শুভেন্দু হলদিয়ার প্রার্থী নন। সাকিন বদলে হলদিয়া থেকে নন্দীগ্রামের ভোটার হয়েছেন। তবু ঘুরেফিরে চর্চায় তিনিই। লোকে মনে করাচ্ছে, শুভেন্দু যখন তৃণমূলের মধ্যগগনে, মন্ত্রী ও হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান, তখনই বন্দর আর কারখানাগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা তোলাবাজি, ইউনিয়নের জোরে কারখানায় চার্টার অব ডিমান্ড করতে না দেওয়া, চাকরিতে কাঁথি আর নন্দীগ্রামের লোককে স্বজনপোষণ, সেখানেও টাকার খেলার মতো গুরুতর সব অভিযোগ উঠেছে। এবিজি বিদায় পর্বের সাক্ষী থেকেছে বন্দর। ভোটেও উঠেছে জুলুমের অভিযোগ। হলদিয়ার পুরপ্রধান তৃণমূলের সুধাংশু মণ্ডল বলছেন, ‘‘এই সব অভিযোগ তখন বারবার দলের মাথাদের জানিয়েছি। সুরাহা হয়নি।’’

বার্তা দিয়েছিল জনতাই। ২০১৬ সালে রাজ্য জুড়ে যখন ঘাসফুল ফুটছে, তখন এই মাটিতে উড়েছিল লাল ঝান্ডা। হলদিয়া যাঁকে জিতিয়েছিল সেই তাপসী মণ্ডল অবশ্য এখন বাম ছেড়ে রামে। শুভেন্দুর হাত ধরে দল পাল্টে বিদায়ী বিধায়ক এ বার পদ্ম-প্রার্থী। তাঁর সভার অদূরে মহিলাদের জটলায় ক্ষোভ, ‘‘ঘরের ঝিউড়ি (মেয়ে) কী বেমাইমানিটাই করল।’’ রাগ শুধু তাপসীতে নয়, লাল পার্টিতেও। উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রার্থীকে নিয়ে আদি বিজেপিরাও সন্তুষ্ট নন।
নানামুখী এই ক্ষোভের অঙ্কেই নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন ঘাসফুলের প্রার্থী স্বপন নস্কর। বলছেন, ‘‘লোকে বুঝেছে দিদিই একমাত্র বিকল্প।’’ তৃণমূলের জেলা মুখপাত্র তাপস মাইতি জুড়ছেন, ‘‘তৃণমূল-বাম-বিজেপি— সব ঘরের ভোট আমাদের দিকে আসবে।’’ তবে ভোট মাস্টারদের ভূমিকা কী হবে, নির্বাচন কমিশন কতটা কড়া হবে— সে সব প্রশ্নও ঘুরছে।

১ এপ্রিল নন্দীগ্রামের সঙ্গেই ভোট পূর্ব মেদিনীপুরের আরও আট বিধানসভায়। সেই তালিকায় থাকা হলদিয়ার সঙ্গে মস্ত মিল জেলা সদর তমলুকের। ২০১৬-য় এখানেও জিতেছিলেন বাম প্রার্থী অশোক ডিন্ডা। তিনিও শুভেন্দু সঙ্গী হয়ে পদ্মের ভিড়ে মিশেছেন। এ বারের বিজেপি প্রার্থী জনপ্রিয় চিকিৎসক হরেকৃষ্ণ বেরা আশাবাদী বটে, তবে তৃণমূল প্রার্থী, রাজ্যের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র দৃশ্যতই প্রত্যয়ী। শুভেন্দুর জন্যই একটা সময় পাশের জেলায় ছুটতে হয়েছিল। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এখন জেলা সভাপতি। নিজের জয়ে বড় মার্জিনের কথা শোনালেও সৌমেনের মুখে ছায়া ফেলছে ‘গুপ্ত ঘাতক’ শব্দটি। বোঝা যাচ্ছে, ‘দিদি’র দলে থেকে ‘দাদা’র হয়ে খেলা লোকজনকে নিয়ে ভয় রয়েছে।
এমন ছুপা রুস্তম ছড়িয়ে জেলা জুড়েই। চণ্ডীপুরের বিধায়ক অমিয়কান্তি ভট্টাচার্য এ বার টিকিট পাননি। ঘাসফুলের প্রার্থী এখানে অভিনেতা সোহম চক্রবর্তী। অমিয় বলছেন, ‘‘টিকিটটাই সব নয়। দিদির সঙ্গে বেইমানি করব না।’’ তবে সোহম-শিবিরে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা প্রবল। ইতিমধ্যে ছড়িয়েছে, বাইরের প্রার্থী, তায় হিরো। কাজ করবেন কী করে! বিজেপি প্রার্থী পুলককান্তি গুড়িয়াও বলছেন, ‘‘তৃণমূলের তারকা তো মাটিটাই চেনেন না!’’ আপনি তো যুব তৃণমূলে অনেক দিন। ভোটেও আগে লড়েছেন। এ বার কি মাটি সত্যি কঠিন? ‘‘মনে রাখতে হবে একটাই দল, একজনই নেত্রী’’— সোহমের জবাবেও ঘরশত্রুর ইঙ্গিত।

ঘর ভেঙে শত্রুপক্ষে গিয়েছেন নন্দকুমারে তৃণমূল প্রাক্তন ব্লক সভাপতি সুকুমার বেরা। পোড়খাওয়া নেতা। বলছেন, ‘‘দিদিকে কারও থেকে কম ভালবাসি না। কিন্তু উনি যে ভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, মানা যায় না।’’ সুকুমার বেরার অভাব ভোটে ভোগাবে বলছেন দলের লোকেরাই। পুরনো বিধায়ক সুকুমার দে-ই এখানে তৃণমূলের প্রার্থী। ধিতাইবসান গ্রামে তাঁর টোটো মিছিলে অবশ্য তেমন সাড়া নেই। গ্রামের যুবক পেশায় চুন গুদামের শ্রমিক সহদেব মাইতি বললেন, ‘‘এমএলএ-র ব্যবহার খারাপ। আর পঞ্চায়েতে তো বিরোধীদের জেতা আসনগুলো মেরেপিটে দখল করেছেন। এ বার বদল চাই।’’

অনেকেই অবশ্য ঠিক উল্টো সুরে বলছেন, এই বেশ ভাল আছি। দু’টাকার চাল, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের কাজ, স্বাস্থ্যসাথী— তৃণমূল সরকারের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে চওড়া হাসি অনেকের মুখে। আবাস যোজনায় বাড়ি না পাওয়া, আমপানের ক্ষতিপূরণে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তবে তার থেকেও বেশি লোকের মুখে মুখে পেট্রল, গ্যাসের লাগামছাড়া দাম, ব্যাঙ্কে সুদের হার কমে যাওয়া, বেসরকারিকরণ নীতি নিয়ে বিজেপি সরকারের উপর ক্ষোভ। মাটির দেওয়ালে ঘুঁটে দিতে দিতে গাঁয়ের বধূ বলছেন, ‘‘দিদি তা-ও আমাদের কথা ভাবেন। মোদী সরকার তো পেটে কিল মারতে বলছে।’’ পাঁশকুড়ার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাকর্মী শুভ্রাংশুশেখর পাঠকের ক্ষোভ, ‘‘ব্যাঙ্কের সুদের হাল দেখেছেন? লোকে খাবে কী?’’

পাঁশকুড়ার মাইশোরাতেই খুন হয়েছিলেন তৃণমূল কাউন্সিলর কুরবান শা। সেই মামলা তুলতে রাজ্য সরকারের আবেদন ঘিরে কম আলোড়ন হয়নি। কুরবানের দাদা আফজল বিজেপিতে গিয়েছেন। তবে ঘাসফুলের পতাকায় সাজানো কুরবানের কার্যালয়ে বসে তাঁর অনুগামী বাপি মণ্ডল বলছেন, ‘‘দলকে ভালবাসি। সেটাই শেষ কথা।’’
এক দশক রাজ্যপাটে থাকা তৃণমূলকে ঘিরে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া একটা আছে। তাতেই পাল তোলার স্বপ্নে বিভোর গেরুয়া শিবির। বিজেপি সরকার ভাগ্য ফেরাবে— এমন বিশ্বাসে তরুণ-যুবদের একটা বড় অংশও সেই হাওয়ায় ভাসছেন। ভাতা নয়, কাজ চান তাঁরা। ময়নার বিজেপি প্রার্থী, ক্রিকেটার অশোক ডিন্ডার মিছিলে সেই তরুণ-যুবদের ভিড়। আবার ডবল ইঞ্জিন সরকারের পক্ষপাতী কেউ কেউ। পাঁশকুড়ার মাইশোরার দর্জি পুলক মণ্ডলের দুই মেয়েই কন্যাশ্রী। বড় জন কলেজের পার্শ্বশিক্ষিকা। প্রৌঢ় পুলক বলছেন, ‘‘এক বার ডবল ইঞ্জিন সরকার করে দেখাই যাক না।’’ ময়নার সম্ভ্রান্ত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীর আবার বক্তব্য, ‘‘আমাদের কংগ্রেসি পরিবার। পরে তৃণমূলকে ভোট দিতাম। কিন্তু অযোগ্যদের ফুলেফেঁপে ওঠার যে বহর দেখলাম, তাতে কড়া দলকে ক্ষমতায় আসতেই হবে। বিজেপি-ই পারবে তৃণমূলের দুর্নীতিবাজদের গারদে পুরতে।’’

চাওয়া-পাওয়ার এমন সব সমীকরণে জোরদার দুই ফুলের টক্কর। আর রণভূমি জুড়ে ধর্মের ধ্বজা। গ্রামের অলিগলিতে নতুন গজানো হনুমান মন্দির। মহিষাদলের মতো প্রাচীন সংস্কৃতির পীঠেও নতুন মন্দিরে আড়ম্বর। দোলের আগে-পরে গাঁ-গঞ্জে অষ্টম প্রহরে হাজির বিজেপি প্রার্থীরা। তাঁদের সভায় মাইকে তৃণমূল নেত্রীর ভুল মন্ত্রপাঠ, দোল মোবারক শোনানো হচ্ছে বারবার। পাঁশকুড়া পূর্বের পদ্ম-প্রার্থী দেবব্রত পট্টনায়েককে ঘিরে অল্পবয়সীদের জয় শ্রীরাম হুঙ্কারে চাপা পড়ে যাচ্ছে কাজের দাবি, শিল্পের দাবি, দুর্নীতিমুক্ত সরকারের দাবি।
তৃণমূল প্রার্থীরাও মন্দিরে ছুটছেন। পাঁশকুড়া পশ্চিমের তৃণমূল প্রার্থী নন্দীগ্রামের শহিদ মাতা ফিরোজা বিবি ঘুরছেন কুমোরপাড়ায়, উঠোনে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি গড়া হচ্ছে। ফিরোজার মুখে সম্প্রীতির কথা। তবে গ্রামবাসীর উষ্মা, ‘‘সব চাষজমি ভেড়ি হয়ে যাচ্ছে। স্কুলের পাশেও ভেড়ি। তা না দেখে সব ধর্ম ধর্ম করে চেঁচাচ্ছে।’’

ধর্মের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে যে দল, সেই সিপিএমের টিকিটেই গেল বার পাঁশকুড়া পূর্বের বিধায়ক হয়েছিলেন ইব্রাহিম আলি। দল অন্ত প্রাণ কিছু কমরেড ছাড়া তাঁর সঙ্গে লোক অবশ্য তেমন নেই। প্রচারের ফাঁকে মাটির ঘরে বসে ইব্রাহিম জয়ের কথা বলছেন। ফেরার পথেই চোখ গেল পাশের তিনতলা পাকা বাড়িতে, নাম ‘নরেন্দ্রমোহিনী’!
আদর্শ নাকি মোহ? জনসেবা নাকি নিজের শ্রীবৃদ্ধি? কর্ম নাকি ধর্ম? লড়াই চলছে শুম্ভ-নিশুম্ভের। গণতন্ত্রের লড়াইও যে ধর্মযুদ্ধই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE