Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

এক অবিরাম অনন্ত আলোর পথে হাঁটা

১৯ নভেম্বর সলিল চৌধুরীর জন্মদিন। তাঁরই সঙ্গীত-সাধনায় মগ্ন হলেন দেবজ্যোতি মিশ্র।সলিল চৌধুরী বাংলা গানের জগতে একটা ছেদ। একটা Departure। রবীন্দ্রনাথের গান। তার পর সলিল চৌধুরী। ঠিক যে ভাবে গ্রিক নাটকের পর শেক্সপিয়র। তেমনই। নান্দনিক অভ্যেস, রুচি বদলাতে একটা আকস্মিকতা। একটা ঝাঁকুনি। সলিল চৌধুরীর জন্মদিনে লিখছেন দেবজ্যোতি মিশ্র।

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

সলিল চৌধুরী বাংলা গানের জগতে একটা ছেদ। একটা Departure। রবীন্দ্রনাথের গান। তার পর সলিল চৌধুরী। ঠিক যে ভাবে গ্রিক নাটকের পর শেক্সপিয়র। তেমনই। নান্দনিক অভ্যেস, রুচি বদলাতে একটা আকস্মিকতা। একটা ঝাঁকুনি। একদম নতুন, ফ্রেশ, পৃথিবীর কবিতায় রোমান্টিকেরা, যেমন বোদলেয়ার, যেমন শেলি ঘাতক এলিয়ট; তেমনই যেমন রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে এবং প্রবল ও প্রখর জীবনানন্দ— তেমনই সলিল চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি। তবু রবীন্দ্রনাথের থেকে কত দূরে!

কল্লোলের উচ্চকিত ঘোষণায়, তারাশঙ্কর, বিভূতি-মানিক আর সতীনাথ ভাদুড়ির বলিষ্ঠ আগমনে, জীবনানন্দ থেকে বিষ্ণু দে পর্যন্ত কবিদের উদ্ধত পদচারণায় গত শতকের তিরিশের দশকেই কবিতা ও সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আঁকা সাহিত্যের মানচিত্রে ঘটল রদবদল। কিন্তু বাংলা গানকে অপেক্ষা করতে হল— আর কিছু দিন, চল্লিশের দশকে সলিল চৌধুরী আসা পর্যন্ত।

বিশ শতকের গোড়া থেকে যে আঁভাগার্দ সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা, কবিতায় যার ফসল এলিয়ট, সাহিত্যের-শিল্পের বিস্তৃত অঙ্গনে যার ফসল সুররিয়ালিস্ট আত্মমুখীনতা, বা তারও আগে কাফকার ট্রায়াল বা ক্যাসেল, তা জনরুচিকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চাইল। অন্য দিকে আছেন গোর্কি, মায়াকোভস্কি, এসেনিন, আরাগঁ, এলুয়ার, লুসুন, ব্রেশ্‌ট, নেরুদা। এঁরাও আঁভাগার্দ ঘরানার। কিন্তু এঁরা গণমুখী। সলিল চৌধুরী এঁদেরই সহোদর। এঁদের সঙ্গেই তাঁর রক্তের সম্পর্ক। এঁদের মতোই সলিল চৌধুরী আজীবন আলোর পথযাত্রী।

রবীন্দ্রনাথ। আলোর উপাসক রবীন্দ্রনাথ, আলোকের ঝরনাধারায় যাঁর অবগাহন। ভুবন ভরা আলো যাঁর আত্মীয়, সেই উপনিষদীয় রবীন্দ্রনাথ। তমসা থেকে জ্যোতির দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে তাঁর যাত্রা। সলিল চৌধুরীও তাই। এইখানেই তিনি উত্তরসূরি। এখানেই তাঁর প্রবহমানতা। সামাজিক অবস্থান আর রাজনীতির পট-পরিবর্তন হচ্ছে। রদবদল ঘটছে। এই যুদ্ধ, মৃত্যু, ক্ষয়, ধ্বংস এবং তার পরেও মানুষ বাঁচে, মানুষ বাঁচবে। এই যে মহান সত্য— মানুষ বাঁচে এবং বাঁচবে, সলিল চৌধুরীও সেই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সামিল। একটা অন্ধকার ঘরে গাছের পাতা যেমন আলোর দিকে ছুটে যায়, তেমনই গুহার আঁধারে আলো এসে পড়ল, আর নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হল। সলিল চৌধুরীও তেমনই ক্রমাগত আছড়ে পড়তে পড়তে, চিৎকার করে আলোর দিকে ছুটছেন। সলিল চৌধুরী যখন শুরু করেছেন তখন তাঁর পিছনে আছে রবীন্দ্রনাথের গানের বিশাল ভাণ্ডার। আলোর পথযাত্রীর কাছে আসছে আহ্বান। এই যে রাত্রি এখানে থেমে যেও না। ক্লান্ত হয়ে হারিয়ে যেও না। পথঘাট প্রান্তর ছাড়িয়ে বহু দূর থেকে আসা সেই ডাক। ছেঁচড়ে-ছেঁচড়ে-ছেঁচড়ে এগিয়ে চল, লড়তে-লড়তে-লড়তে, মার খেয়েও যেতে হবে। কখনও কখনও মনে হয় জীবন একটা সংগ্রাম। কিন্তু জীবন কেন একটা সংগ্রাম হবে? সত্যিই তো। চারপাশে লক্ষ লক্ষ জীবাণু অবশ্য ওঁত পেতে আছে। তার মধ্য দিয়ে শিশুটিকে, শিশুর মাকে বাঁচতে হবে। একটা ঘটে যেতে পারা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই বেঁচে থাকা। গর্ভের অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিকে তার যাত্রা। মানবজীবনের এই গোটা ইতিহাসের যাত্রা— সেই আদিম সাম্যের পৃথিবী থেকে, শ্রেণিবৈষম্যের ধুলো, কাদা, রক্তমাখা ইতিহাস পেরিয়ে সেই নতুন সাম্যের দিকে, আলোর দিকে যে যাচ্ছে— সে হল স্বয়ং মানুষ।


পারিবারিক মুহূর্তে।

এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটালেন সলিলদা। এমনই মনে হয়। এ রকমটা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে। বালুচরের আশা-তাঁর সুরে কোনও ‘মাইনর নোট’ নেই। ঠিক এমন জায়গায় কত রকম জটিল সুরবিন্যাস, কত কোমল (মাইনর নোটস) কত কড়ি (মাইনর নোটস) বয়ে যেতে পারত। সে সব কিছু ব্যবহার না করে মূল স্বরটিকে ‘মেজর স্কেল’-এ বেঁধে রাখলেন। আসবে অনুসঙ্গ হারমোনির, কিন্তু বাঁধা থাকবে বিলাবলের ঔদার্যে। এর মধ্যেই লেপটে আছে আলো। একটা ‘ফাইট’ দিতে হবে। কিন্তু এই আলো একমুখী নয়। ক্লান্ত মানুষ, রিক্ত মানুষ- গানের লয়ের ভিতর জড়িয়ে থাকে। আসলে যে লয় ব্যবহার করা হয়েছে, আর যে সব সা রে গা মা পা— তা যেন থমকে থমকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে। তা যেন ক্লান্তিকে উলের কাঁটার মতো বুনে চলেছে। সাহেবদের ভাষায় বললে এই লয় lento (অতিধীর)। Andante (ধীর) হয়ে Allegro (দ্রুত) ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমরা শুনতে পাব ‘আহ্বান ওই আহ্বান’। গানের ভিতরে তখন হাজার মানুষের পদচারণা— ওই এসে পড়েছে ‘নূতন ঊষার স্বর্ণদ্বার’। এই ভাবে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়ার এক লম্বা রক্তক্লান্ত পথ পেরিয়েই আলো। এ যেন উপকূল ধরে যুধিষ্ঠিরের যাত্রা। পঞ্চপাণ্ডবের মৃত্যু। দ্রৌপদীর মৃত্যু, মহাপ্রস্থানের স্বর্গ, তেমনই। না পাল ছিন্ন, রাত্রির অন্ধকার- তবু ক্লান্ত হওয়া চলবে না, তমসো মা জ্যোতির্গময়- এই আশাবাদে দু’জনের মিল।

তবু পার্থক্য অনেক। যখন ‘আহ্বান শোনো আহ্বান’ শুনি— ওই গানে, তখন মনে হয় যেন রেড আর্মি বার্লিনের পায়ের শিকল খুলে দিচ্ছে, যেন বাস্তিলের দুর্গ ভেঙে পড়ছে হুড়মুড় করে। যেন আলোর সংক্রামক উল্লাস ছড়িয়ে পড়ছে, আর হাজার হাজার মানুষ হেঁটে চলেছে সে দিকে। এ যেন বেঠোফেনের এক প্রণম্য গান নাইনথ সিম্ফনি-র ওড টু দ্য জয় মুভমেন্ট। ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন আলো। ঐতিহ্যের সেই আলো গায়ে মেখে নিয়ে এক নতুন ঠিকানার দিকে হাঁটছেন সলিল চৌধুরী। আলোর পথে হেঁটেছেন রবীন্দ্রনাথ। সারাজীবন তাঁর আলোর তপস্যা। আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি- আলোর প্রাচুর্য ভরাট করে দেয় সব অন্ধকার কোণ। আছে আছে, এমনকী দুঃখের ভিতরেও বাজতে থাকে এই একটা কথা। আর মন্দা, যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গার পৃথিবীতে এসে সলিল চৌধুরীকে আলোর জন্য লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়। লড়ে অর্জন করে নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তির আত্মমুক্তি, ব্রহ্মের সঙ্গে মিলন ও বিরহ, লীলাময়তা, রূপমুগ্ধতা চরিত্রের দিক থেকে মূলত র‌্যোমান্টিক। আর সলিল চৌধুরী মূলত নব্য ক্লাসিক্যাল। গণমুখী শিল্পী হিসেবে তাঁর কাছে আলোর পৃথিবী আর কোনও অপার্থিব দান নয়। গুহার আঁধারে অপার্থিব কোনও আলো এসে স্বপ্নভঙ্গ ঘটাবে না। আলো অর্জন করে নিতে হবে। আলোর পথে লম্বা পাড়ি দিতে হবে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ক্লান্ত হয়ে আর ক্লান্তি ভেদ করে আলো।

আলোর আহ্বান যত স্পষ্ট, তত জেগে উঠছে বলিষ্ঠতা— একই রকম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে ক্রমে ঘটল দৃষ্টিকোণের বদল। স্বদেশি আন্দোলনে যিনি অংশ নিয়েছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ মোড় ঘুরছেন আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে। এইখানে আর একটা যোগসূত্র। কিন্তু ছেদও। রবীন্দ্রনাথে যখন দুনিয়ার মানুষ এক হও, brotherhood of man; তখন সলিল চৌধুরী দেশপ্রেমিক হয়েও গলা মেলাচ্ছেন ভিন্ন স্লোগানে- দুনিয়ার মজদুর এক হও। আন্তর্জাতিকতাবাদে তাঁদের যোগ, আন্তর্জাতিকতাবাদের চরিত্রে তাঁদের ছেদ। এইখানে ছিন্ন হচ্ছে নাড়ির যোগ। তা হলে কী বলব— রবীন্দ্রনাথ-সলিল চৌধুরী মাতা-পুত্র, না পিতা-পুত্র। সন্তান বিচ্ছিন্ন হল। এ বার থেকে তাঁকে হাঁটতে হবে তাঁর নিজের পথে। যদিও তাঁর ভিতরে রয়ে গেল সেই জেনেটিক্স। একটা পাঁচমাথার মোড়ে রবীন্দ্রনাথের থেকে উত্তরাধিকার নেবেন সলিল চৌধুরী। ‘বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে’।

পাঁচমাথার মোড় থেকে কোন পথে হাঁটতে থাকবেন সলিল চৌধুরী তা এ বার ঠিক করে নেওয়ার পালা। এক দিকে তেভাগা। কলে মজুর, খেতে কিষাণ, এক দিকে স্বাধীনতা আন্দোলন, অন্য দিকে উত্তরাধিকার। উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। অসমের চা বাগানে তাঁর ডাক্তার বাবা শুনতেন পাশ্চাত্যসঙ্গীত। সলিল চৌধুরীর মগজের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল সেই সুরের তরঙ্গ। ‘আমি নিজেই দেখেছি আমার নিজের অভিজ্ঞতা। কলোনি পাড়ায় আমার সেই বেড়ে ওঠা, আমার বাবা রেডিও-র নব ঘুরিয়ে শুনতেন কলকাতা ‘খ’। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক। অন্য দিকে রেকর্ডে বাজছে আব্দুল করিম খাঁ-র ‘যমুনা কি তীর’। সলিল চৌধুরী শুনতেন চা বাগানের কুলিদের গান, ‘ফোক টিউন’— তা-ও জড়ো হচ্ছিল মগজের কোনও কু‌ঠুরিতে, যার কিছুটা চেতন, কিছুটা প্রাকচেতন। আনা ফ্রয়েডের সেই কথা। প্রথম পাঁচ বছরস একটা শিশুকে যা গড়ে তোলে। বাবার প্রতিবাদী চরিত্র সলিল চৌধুরীর ভিতরে ছাপ রেখে গিয়েছে। ঠিক হয়ে যাচ্ছে, এ ভাবেই এর পর ভবিষ্যতে তিনি গান করবেন— বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে।


সুর সাধনা।

তবু অন্য প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথও ‘রেবেল’, বিদ্রোহী। তিনি সুর করলেন ঋগবেদ। ঋগবেদ সুর করা নিষিদ্ধ। মানলেন না রবীন্দ্রনাথ। স্কুলে তাঁকে পড়ানো গেল না। যিনি ভবিষ্যতে শান্তিনিকেতন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন, তিনি স্কুলের পড়া শেষ করলেন না। তিনি বিদ্রোহী।

ঐতিহাসিক ভাবে একটা কথা জেনে নেওয়া দরকার যে, সলিল চৌধুরী সুরকার হতে আসেননি। তিনি চেয়েছিলেন সমাজ বদলে দেবেন। বিপ্লবে অংশ নেবেন। সলিল চৌধুরী রেনেসাঁ-র ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথকে। তিনি কবি, তিনি নাট্যকার, তিনি গীতিকার, তিনি সঙ্গীতকার ও শিক্ষাবিদ। তিনি চিত্রী, তিনি কর্মী। আমরা দেখেছি ভিঞ্চিকে- তিনি বিজ্ঞানেরও কাজ করেছেন, ছবিও আঁকছেন। আমরা দেখেছি মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকে। তিনি ভাস্কর, তিনি কবি। তিনি স্থপতি। এ দিক থেকে সলিল চৌধুরী রেনেসাঁ-র উত্তরাধিকারী। তিনি সুরকার, তিনি গীতিকার, তিনি গল্প লেখেন। সর্বোপরি তিনি কর্মী, তিনি বিপ্লবী।

সলিল চৌধুরী তখন ‘shoot at sight’ অর্ডার নিয়ে ঘুরছেন। গল্পগুলো সলিলদার কাছেই শুনেছি। ‘পার্টিতে তখন আমাকে ভাবা হত ট্যালেন্টেড ছেলে। বাঁশি-টাশি বাজায়। আসে, লেখে, গান-টান করে। এই পর্যন্ত। কোনও সাবাশি দেওয়ার জায়গা ছিল না।’ বটুকদা-জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, এঁদের কাছে সাবাশি পাননি বটে, কিন্তু সব সময়ে প্রশ্রয় ছিল। প্রতিভা আছে ছেলেটার। আদেশ আসত কোনও দিন, ‘রংপুরে যাও’। ব্যস, অমনি রংপুর যাওয়া। ফলে পার্টিকর্মী হিসেবে সলিল চৌধুরীর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মতো এক জন কর্মী থাকলেও, তাঁদের উদ্দেশ্য ও চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উত্তরাধিকার আর ছেদের প্রশ্নে আরও একটা গানের কথা উল্লেখ করছি।

‘হয়তো তারে দেখেনি কেউ কিংবা দেখেছিলাম ময়নাপাড়ার মাঠে’— এর স্তবকের প্রথম অংশ পর্যন্ত ভীষণ ভাবেই রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু সামাজিক অবস্থান ইতিমধ্যে বদল ঘটে গিয়েছে। দুর্ভিক্ষ হয়েছে। ভিখুর মতো চরিত্র পেয়েছি আমরা। পেয়েছি দুঃশাসনীয়’র মতো গল্প। ফলে এত কিছুর মধ্য দিয়ে সলিল চৌধুরীকে যেতে হয়েছে, কী করে রবীন্দ্রনাথের মতো কৃষ্ণকলির রূপে মুগ্ধ হবেন। কিন্তু কোথাও একটা ট্রিবিউট। এই সুরের মধ্যে কোথাও আছে musical anote-সাঙ্গীতিক উদ্ধৃতি। রবীন্দ্র-পংক্তি উদ্ধৃতি তিরিশের দশকের কবিরা ব্যবহার করেছেন। বিষ্ণু দে ব্যবহার করেছেন, ‘কাল রজনীতে ঝড় হয়ে গেছে রজনীগন্ধা বনে’। আর সলিল চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি, সাঙ্গীতিক উদ্ধৃতি করেছেন সুরে—

কে জানি কবে যে

তার রাম্ তারা রাম্ তারা রাম্

এই যে রবীন্দ্রনাথের সুরের চলন অনুসরণ করতে করতে হঠাৎ বদল আনলেন, গতির সঞ্চার আনলেন, গতি সঞ্চার করে ঝাঁকুনি দিলেন— এই খানে Departure। এইখানে সলিল চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে বলছেন, রবীন্দ্রনাথ, তুমি আমার বাবা মানলাম। কিন্তু আমার পৃথিবীতে যুদ্ধ, দাঙ্গা, মন্বন্তর ঘটে গিয়েছে। ফলে আমার পৃথিবীটা আলাদা হয়ে গিয়েছে। আমার পথ আলাদা। এখানে মনে রাখা প্রাসঙ্গিক যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে সলিল চৌধুরী অশৌচ পালন করেছিলেন।


আড্ডার সঙ্গী লতা মঙ্গেশকর।

এই যে রোম্যান্টিক অনুসঙ্গ গড়ে ভেঙে টুকরো করে ফেলা, যা আমরা সলিল চৌধুরীর কৃষ্ণকলিতে পেলাম, সেটাই আবার প্রত্যক্ষ করি ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ গানটিতে। গান যখন শুরু হয় তখন কোনও এক গাঁয়ের বধূকে ঘিরে রোম্যান্টিক গ্রাম্য জীবনের ছবি। তার পরেই ‘ডাকিনী যোগিনী’। এইখানে ‘মিউজিক্যাল ফর্ম’ দেখার মতো। পেছনে যেন মনে হচ্ছে চেলো কনসার্ট বাজছে—

তারারা রাম্ তারারা রাম্

পা পা পা পাম্

তারারা রাম্

আবার বেঠোফেনের ফিফ্থ সিম্ফনির আভাস।

১৯৪৬— নৌবিদ্রোহ। সলিল চৌধুরীর গান, ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, প্রাণ জাগছে।

একটা ডাক, এসো আমরা জমায়েত হয়েছি। এই দ্যাখো নৌ-সেনারা বিদ্রোহ করছে। বেজে উঠেছে-প্যাঁপপা প্যাঁ

ঢেউ উঠ/ছে কারা টুট্/ছে/প্রাণ জাগ/ছে— একটাই স্বর এখানে। কিন্তু এর মধ্যেই ছিল হারমোনির সম্ভাবনা। তার পর,

গুরুগুরু/গুরুগুরু/ডম্বরু/পিনাকে

বেজেছে বেজেছে বেজেছে

মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ

তরণী জাগানো ঢেউ উঠেছে

এই যে ঢেউ উঠছে, করা ছুটছে— ঠিক যেন তারা রাম্ পাম্। তারা রাম্ পাম্।

বুঝতে অসুবিধা হয় না সমুদ্রটা ফুলছে। ফুলতে ফুলতে বড় হয়ে উঠছে। ঢেউয়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে। আর তখন, হ্যাঁ, তখন সেই ফুলে ওঠা ঢেউকে থামিয়ে দিয়ে শোনা গেল, ‘আজ চাকা বন্‌ধ,’ থামো। যে মিউজিক্যাল প্রগ্রেশন চলছিল-সেটা থেমে গেল। সেই চূড়ায় দাঁড়ানো ফুলে ওঠা ঢেউ আছড়ে না পড়ে যেন শূন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর সেই দাঁড়িয়ে থাকা জলের দেওয়ালের ভিতর থেকে সেকেন্ড খানেক বিরতির পরে মেঘ ডাকতে শুরু করল। গুরুগুরু/গুরুগুরু। আর সমুদ্রের ঢেউ, মেঘের গর্জন আর চাকা বন্ধ তৈরি করে হারমোনির অভিঘাত। নৌবিদ্রোহ থেকে ইশারা পেয়েছে এই গান, হয়ে উঠেছে আবহমান মানুষের বিদ্রোহের গান। এক মহা-ঐকতান। এক অবিরাম অনন্ত আলোর পথে হাঁটা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE