চুল দিয়ে যায় চেনা। রণবীর সিংহ তাঁর চুলের ছাঁট নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। আর তা দেখে বি-টাউন অনায়াসেই বুঝে যায়, এর নেপথ্যে রয়েছেন দর্শন ইয়েওয়ালেকর। সলমন খানের সঙ্গেই বলিউড সফর শুরু করেছিলেন কেশসজ্জা-শিল্পী। শুধু তারকা নয়, ‘ভাইজান’কে অন্য ভাবে চিনেছেন তিনি। বলিউডের প্রথম সারির বহু তারকার সঙ্গে কাজ করেছেন দর্শন। সেই সব অভিজ্ঞতা আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তারকা কেশসজ্জাশিল্পী।
প্রশ্ন: বলিউডে আপনার সফর শুরুই হয়েছে সলমন খানের মতো তারকার সঙ্গে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?
দর্শন: বিনোদন জগতে হঠাৎ করেই আমার আসা। কোনও পরিকল্পনা ছিল না। ছোট শহর থেকে আসা আমার মতো একজনের জন্য বলিউডের বিনোদন জগতে এসে কাজ করা অবাক করার মতোই ঘটনা। তাও আবার সলমন খানের সঙ্গে! সুভাষ ঘাইয়ের ছবি ‘যুবরাজ’-এ ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। ওই কাজটাই এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার জন্য অনেক রাস্তা খুলে দিয়েছিল। সলমনের কাছে আমি তাই চিরকৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: ভক্তদের কাছে তিনি ‘ভাইজান’। আপনি তো অনেকটা কাছ থেকে চিনেছেন…
দর্শন: হ্যাঁ। আমার কেরিয়ারের শুরুতে ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি। তাও আমার উপর ভরসা রেখেছিলেন। ওঁর চুল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন, যেটা সচরাচর সবাই করেন না। সলমন মানুষ হিসেবে খুব আন্তরিক। আজও একটা ঘটনা আমার মনে আছে।
প্রশ্ন: কী ঘটনা?
দর্শন: নিউ ইয়র্কে আমরা আউটডোর শুটিং করছিলাম। আমাকে একটা ‘হার্লে-ডেভিডসন’-এর জুতো উপহার দিয়েছিলেন তিনি। চারপাশের প্রতিটি মানুষের জন্য সলমন ভাবেন, প্রত্যেকের যত্ন করেন।
প্রশ্ন: ‘যুবরাজ’-এ সলমনের চুলের ছাঁট তো বেশ অন্য রকম ছিল…
দর্শন: ওঁর চুলে সোনালি রঙের হাইলাইট করেছিলাম। টানা তিন ঘণ্টা বসেছিলেন ধৈর্য ধরে। কোনও কথা বলেননি। এতে আমারও আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল। পরে আমাকে বাড়িতে ডেকে প্রশংসা করেছিলেন। বড় মাপের তারকাই শুধু নন, সলমন যে কোনও মানুষের আত্মবিশ্বাস সহজে বাড়িয়ে দিতে পারেন।
প্রশ্ন: এক বার চুল কাটতে গিয়ে আপনি নাকি সলমনের কানের একটি অংশ কেটে ফেলেছিলেন! রেগে যাননি উনি?
দর্শন: হ্যাঁ, সামান্য খোঁচা লেগে গিয়েছিল। তখন ট্রিমারগুলো তেমন উন্নত মানের ছিল না। তবে খোঁচা লেগে যাওয়ার পরে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সলমন খুব স্বাভাবিক ছিলেন, যেন কিছুই হয়নি। আর আমি তো ভয়ে তখন দরদর করে ঘামছিলাম! সেই দিনই বুঝেছিলাম, সলমন কতটা ভদ্র ও ধৈর্যশীল।
প্রশ্ন: এত দিন এমন একজন তারকার এত কাছে থেকেছেন। বিশেষ পরামর্শ পেয়েছেন কোনও?
দর্শন: ফিটনেসের প্রতি ওঁর দায়বদ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তবে সবচেয়ে ভাল লাগে ওঁর বিনয়। লন্ডনের ‘মাদাম তুসো’ মিউজ়িয়ামে ওঁর মোমের মূর্তির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তার আগে আমাকে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন, পরার মতো আমার কিছু আছে কি না! তার পরে ওঁর আলমারি থেকেই একটা স্যুট বেছে নিতে বলেছিলেন! সলমন স্যর এমনই। সাত বছর ধরে ওঁর থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
রণবীরের কেশসজ্জায় ব্যস্ত দর্শন। ছবি-সংগৃহীত।
প্রশ্ন: এখন যদি ফের সলমনের চুল কাটার সুযোগ আসে, কেমন ছাঁট দেবেন?
দর্শন: খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছাঁট। দাড়ি নয়। মুখটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত দেখায় এমন ছাঁট দেব। যেমন সেনাদের ছাঁট হয়ে থাকে। সলমন স্যরের চুল এমনিতে সোজা ও মোলায়েম। এই ছাঁটে ওঁর মুখের বৈশিষ্ট্য আরও বাঙ্ময় হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে গাঢ় বাদামি ‘হাইলাইট্স’।
প্রশ্ন: সলমন ছাড়াও অন্য তারকাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তারকাদের মুখের গড়ন, ব্যক্তিত্ব, না কি কোনও ছবির চরিত্র— কোন বিষয়টা সবার আগে রাখেন?
দর্শন: ছবির ক্ষেত্রে চরিত্রটিকে ভাল ভাবে বুঝে নেওয়া জরুরি। চরিত্রের মানুষটির সামাজিক অবস্থান, কোথায় থাকে, কী পেশা সবটা বুঝেই চরিত্রের কেশসজ্জা করা হয়। এর পাশাপাশি মুখের গড়ন কার কেমন সেটা তো দেখা হয় অবশ্যই! ছবির ক্ষেত্রে চুলের ছাঁট এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘বাজিরাও মস্তানি’ ছবির ক্ষেত্রে আমিই প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ইতিহাসগত ভাবে কাহিনির এলাকার ঐতিহ্য বজায় রাখার স্বার্থে রণবীর সিংহের ন্যাড়া মাথা হওয়া উচিত। সাহসী পদক্ষেপ ছিল সেটা। আবার ‘পদ্মাবত’-এর ক্ষেত্রে একেবারে অন্য রকম কেশসজ্জা। পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করেই সবটা করা হয়েছিল।
প্রশ্ন: রণবীর সিংহের সাজ বরাবরই চর্চায়। ২০১২ থেকে আপনি ওঁর সঙ্গে কাজ করছেন। কেমন সেই অভিজ্ঞতা?
দর্শন: আমার কর্মজীবনের সৃজনশীলতা পরিপূর্ণতা পেয়েছে রণবীরের সঙ্গে কাজ করে। ‘গোলিয়োঁ কি রাসলীলা রাম-লীলা’ ছবির সময় থেকেই বুঝতে পারি, আমরা দু’জনেই পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালবাসি। ওঁর এই নির্ভীক সত্তাই আমাকে নিজের সীমা অতিক্রম করে পরীক্ষা করার সুযোগ করে দিয়েছে। যে কোনও সাজ বা চুলের ছাঁট উনি নিজে বানিয়ে নেন। ‘৮৩’ ছবিতে কপিল দেবের চুলের ছাঁটটা যেন নিজেরই, এ ভাবেই ভেবে নিয়েছিলেন রণবীর। ওই লুক-এর জন্য ৫টা লুক টেস্ট হয়েছিল। ৪০ মিনিট ধরে ওঁর গোঁফের ছাঁট দেওয়া হয়েছিল একটু একটু করে।
প্রশ্ন: এ বার একটু ভিকি কৌশলের প্রসঙ্গে আসি। এক দিকে ‘মাসান’। আর এক দিকে ‘হুসন তেরা তৌবা তৌবা গানে’ তারকাসুলভ গ্ল্যামারাস সাজ। এতটা ব্যাপ্তি কী ভাবে সম্ভব?
দর্শন: সত্যিই ওঁকে যে কোনও ধরনের চরিত্রে মানিয়ে যায়। একেবারে মাটির কাছাকাছি কোনও চরিত্র থেকে শুরু করে সেনার চরিত্র, সবেতেই ভিকি অনবদ্য। এমন একজনের সঙ্গে কাজ করলে সৃজনশীল একটা আরাম মেলে। মুখের গড়ন, চুলের ধরন এবং নানা রকমের সাজ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার খোলামেলা মানসিকতার জন্য ওঁর সঙ্গে কাজ করতে ভাল লাগে।
প্রশ্ন: বলিউড তারকাদের মধ্যে শাহরুখ খানের চুল খুব সুন্দর। ওঁর সঙ্গে কাজ করলেন না?
দর্শন: শাহরুখের সঙ্গে একটা কাজ নিয়ে কথা চলছে। আশা করছি, আপনারা শীঘ্রই জানতে পারবেন। সত্যিই খুব ভাল চুলের অধিকারী উনি। কপালের উপর এসে পড়া চুল, আর ওঁর ব্যক্তিত্ব। কী অসাধারণ!
প্রশ্ন: কখনও কোনও তারকার কেশসজ্জা নিয়ে বেগ পেতে হয়নি? প্রত্যেকের পছন্দ-অপছন্দ তো ভিন্ন ধরনের হয়।
দর্শন: হ্যাঁ, তেমন অভিজ্ঞতাও রয়েছে। ‘পদ্মাবত’-এর আলাউদ্দিন খলজির কেশসজ্জার জন্যই বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এই চরিত্রের পিছনে বিভিন্ন মানসিক স্তর ছিল। ক্রমশ আলাউদ্দিন খলজি কেমন হয়ে উঠছেন, সেটা কেশসজ্জাতেও যাতে প্রতিফলিত হয়, খেয়াল রাখতে হয়েছিল। রণবীর সেই পরীক্ষানিরীক্ষা করার জায়গা দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের তারকাদের সঙ্গে কাজ করেছেন? ওঁদের পছন্দ-অপছন্দগুলো কেমন?
দর্শন: ইব্রাহিম আলি খানের সঙ্গে কাজ করেছি আমি। খুবই প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব ওঁর। খুব তীক্ষ্ণ নাক-মুখ ইব্রাহিমের। ওঁর চুলেও ভাল ঘনত্ব রয়েছে। তাই ওঁকে খুব ‘টেক্সচারড’ একটা ছাঁট দিয়েছিলাম। সেই সঙ্গে কপালের উপর হালকা ‘ব্যাংস’। এই ছাঁট ওঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায়। নতুনদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু বিশেষত্ব রয়েছে।
প্রশ্ন: অভিনেতাদের সঙ্গেই কাজ করেছেন অধিকাংশ। মহিলাদের মধ্যে কোন তারকাকে নতুন কেশসজ্জা দিতে চান?
দর্শন: সম্প্রতি ‘কেসরী ২’ ছবিতে অনন্যা পাণ্ডের কেশসজ্জা আমি করেছি। তবে আমার ইচ্ছে আলিয়া ভট্ট, দীপিকা পাড়ুকোন ও তাপসী পন্নুকে নতুন করে সাজানোর। চরিত্র নিয়ে ওঁরা পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। সাজ নিয়েও করবেন মনে হয়।
প্রশ্ন: এত তারকার সঙ্গে কাজ করেছেন। বলিউডের কোনও অভিনেতার কেশসজ্জায় কিছু বদল আনা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
দর্শন: আমি সুযোগ পেলে সইফ আলি খানের চুলে একটা সাহসী পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাই। ওঁর চুল সুন্দর, মুখমণ্ডলও তীক্ষ্ণ। নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা চাইলেই করতে পারেন তিনি। ওঁর জন্য আমার পছন্দ ‘রক-পাঙ্ক মোহক’ অথবা ‘শেভড আন্ডারকাট’। খুবই অন্য রকম। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ওঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই।
প্রশ্ন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তো প্রত্যেক পেশায় প্রভাব ফেলছে। কেশসজ্জার ক্ষেত্রে এর কোনও ভূমিকা রয়েছে?
দর্শন: কেশসজ্জাশিল্পীদের কাজে সাহায্য করতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু কখনওই তাদের জায়গা নিতে পারবে না। এর সাহায্যে আমরা আগেভাগেই দেখে নিতে পারি, কোন ছাঁটে কাকে কেমন দেখতে লাগতে পারে। বরং বলা ভাল, আমাদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজেই লাগছে।
প্রশ্ন: আগামী দিনের জন্য কী পরিকল্পনা আপনার?
দর্শন: ভারতে কেশসজ্জার নানা ধরন রয়েছে। সেটাকেই আমি আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে চাই। একটা সময়ে নাপিত বলে ছোট করা হত। নাপিত বলায় কোনও সমস্যা নেই যদিও। পেশার নাম তো আগে এটাই বলা হত। ছবিতে কেশসজ্জা নিয়ে পরীক্ষার পাশাপাশি, নিজের ব্র্যান্ডের মাধ্যমে ভারতীয় কেশসজ্জা-শিল্পকে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাই।