Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

অমিতাভ এবং

ই-মেল ইন্টারভিউ টিন্টারভিউয়ের চক্কর নয়। আনন্দplus-কে সময় দিয়েছেন সরাসরি – ফেস টু ফেস সাক্ষাৎকারের। কিন্তু ভদ্রলোক গেলেন কোথায়? ভেন্যু হিসেবে ধার্য গ্র্যান্ড হোটেলের ৩০৯ নম্বর ঘরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া সময়ের সাতাশ মিনিট অতিক্রান্ত। এমন তো কখনও হয় না। গায়ে একটা বাহারি শাল জড়ানো অমিতাভ বচ্চন আবির্ভূত হলেন পরের পঞ্চান্ন সেকেন্ডে। ঢুকেই বললেন, ‘‘সরি, ফ্যামিলিতে একটা ডেথ নিউজ পেলাম একটু আগে।’’ শোনা মাত্র গৌতম ভট্টাচার্য-র মনে হল, এই রে মুড থাকবে তো আজ মন দিয়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার...ই-মেল ইন্টারভিউ টিন্টারভিউয়ের চক্কর নয়। আনন্দplus-কে সময় দিয়েছেন সরাসরি – ফেস টু ফেস সাক্ষাৎকারের। কিন্তু ভদ্রলোক গেলেন কোথায়? ভেন্যু হিসেবে ধার্য গ্র্যান্ড হোটেলের ৩০৯ নম্বর ঘরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া সময়ের সাতাশ মিনিট অতিক্রান্ত। এমন তো কখনও হয় না। গায়ে একটা বাহারি শাল জড়ানো অমিতাভ বচ্চন আবির্ভূত হলেন পরের পঞ্চান্ন সেকেন্ডে। ঢুকেই বললেন, ‘‘সরি, ফ্যামিলিতে একটা ডেথ নিউজ পেলাম একটু আগে।’’ শোনা মাত্র গৌতম ভট্টাচার্য-র মনে হল, এই রে মুড থাকবে তো আজ মন দিয়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার...

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৫৮
Share: Save:

দ্বিতীয় খারাপ খবর: অমিতাভ বচ্চন ঘরে ঢুকলেন এবং বেরিয়ে গেলেন! ততক্ষণে তিনি আবিষ্কার করেছেন কোনার দিকের যে চেয়ারে তাঁকে বসতে বলা হচ্ছে তার উপর লাইট করা রয়েছে। ‘‘প্রিন্ট ইন্টারভিউ তো?

টিভি নয়?’’ অবশ্যই নয়। মুম্বই থেকে আগত ফোটোগ্রাফার সাত্যকি ঘোষ বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘‘স্যর, লাইট করেছি যাতে ছবি ভাল হয়।’’

অমিতাভের মতো চির পারফেকশনিস্ট সেটা শুনেও বাধ্য ছাত্রের মতো চেয়ারে বসে পড়বেন, হয় নাকি? বহু বছরের তাঁর ব্যক্তিগত মেক আপ আর্টিস্ট দীপক ঘরেই ছিল। তাকে ইশারা করলেন। মেক আপ নিয়েটিয়ে আবার আবির্ভূত হলেন দশ মিনিট বাদে। সাঁইত্রিশ মিনিট লেটে রান করছে আজ ইন্টারভিউ। বচ্চনের জীবনে নিশ্চয়ই খুব বেশি ঘটেনি। টিভি-তে চলছিল ভারত-অস্ট্রেলিয়া টি২০। টিভির মুখটা ঘুরিয়ে রাখা। যাতে ও দিকে চোখ পড়ে ইন্টারভিউয়ের তাল না কেটে যায়। কিন্তু এটা একান্তই বচ্চনের পৃথিবী! তাঁর কথাই প্রথম ও শেষ।

দ্রুত জানালেন, ইন্টারভিউ এবং মাঝেমধ্যে টিভিতে চোখ — দু’টো একসঙ্গে করতে চান। বললেন, ‘‘ওইটা আমি চাইছে।’’ টিভির মুখ ফের সোজা হল। অমিতাভের গত আঠারো বছরের ছায়াসঙ্গী ফোটোগ্রাফার পরেশ মেটা ফিসফিস করে বললেন, ‘‘স্যর অসম্ভব স্পোর্টস ফ্যান। টিভিতে খেলা হলে ছাড়েন না।’’

সে তো হল। কিন্তু আজকের খেলার প্লেয়িং কন্ডিশন কি অমিতাভ মানবেন? আনন্দplus-এর অনুরোধ, পুরো ইন্টারভিউ যেন বাংলায় হয়। বাংলায় প্রশ্ন। বাংলায় উত্তর। দু’মাস শহর কলকাতায় কাটিয়ে গেলেন। তাঁর চার পাশে এখন বাঙালি পরিচালকের ভিড়। এটুকু আব্দার তো আমরা করতেই পারি।

অমিতাভ রাজি হচ্ছেন না কিছুতেই। ঘোর লজ্জিত দেখাচ্ছে তাঁকে। ‘‘না, না, টানতে পারব না। লোকে হাসবে।’’ বাংলায় প্রশ্ন হলে তো বুঝবেন? ‘‘হ্যাঁ, সেটা মোটামুটি বুঝব।’’ সামান্য আশ্বস্ত দেখাচ্ছে তাঁকে।

অগত্যা নতুন প্লেয়িং কন্ডিশন। উত্তর ইংরাজিতে। কিন্তু প্রশ্ন যথাসম্ভব বাংলায়। বচ্চন ঘাড় নাড়লেন। এ বার শুধু মোবাইলে ভয়েস মেমোর রেকর্ডিং বাটন পুশ করার অপেক্ষা...

মিস্টার বচ্চন, আপনি কখনও বোঝেন, আপনার ইন্টারভিউ নিতে যে বসে, সে কী পরিমাণ প্রেশারের মধ্যে থাকে?

হোয়াট প্রেশার? হোয়াই প্রেশার?

প্রেশার এ জন্য যে, এক আধজনও যদি আগাম ইন্টারভিউ নেওয়ার ব্যাপারটা জানতে পারে তাদের হাবেভাবে, চাপ আরও বেড়ে যায়। ইন্ডাস্ট্রিতে আপনাকে ধরা হয় আলটিমেট!

আরে, না, না। আমি হলাম একান্ত একজন সাধারণ মানুষ, যে নিজের জন্য কিছু না কিছু চাকুরি ক্রমাগত খুঁজে চলেছে।

তিয়াত্তর বছর হল আপনার। অথচ, আপনার হালফিলের পরিচালকেরাও বলে আজও প্রত্যেকটা শট যেন আপনার কাছে প্রথম শট।

আমার এত কিছু মনে হয় না। আমার মনে হয়, আমি যদি কোনও দায়িত্ব নিয়ে থাকি, তা হলে সেই দায়িত্বের মর্যাদা আমার বহন করা উচিত। যখন যে দায়িত্ব নিই, তা পালনে আমি জান লড়িয়ে দিতে রাজি থাকি। কিন্তু সে তো অনেকেই করে থাকে। এর মধ্যে বিরাট প্রশংসাসূচক আর কী আছে?

৭৩ বছরকে যদি গুলিয়ে ফেলে ৩৩ মনে হতে থাকে, তা হলে লোকে যে মুগ্ধ হবে, প্রশংসা করবে — সে তো স্বাভাবিক!

তেমন কিছু নয়। আমার কথা হল, দায়িত্ব যখন নিয়েছ, নিজেকে উজাড় করে দাও। প্রোডিউসরের কী চাহিদা, মন দিয়ে শোনো। ডিরেক্টর কী বলছে, সেই নির্দেশটা নাও। যত দিন শরীর দেয়, জান দিয়ে অভিনয় করো।

ঘনিষ্ঠরা বলেন আপনার মধ্যে একটা স্পোর্টিং মাইন্ডসেট কাজ করে, যা নাকি নৈনিতালের স্কুলের বক্সিং রিং থেকে পাওয়া। সেটা আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি, ‘পিকু’র ওই রকম সাফল্যের পর মনে হয়নি, এ বার চলে যাই? ছক্কা দিয়ে তা হলে শেষটা হয়। আমার গোটা কেরিয়ার এত ভাল, শেষটাও কি রঙিন হতে পারে?

না, না, আমি এ ভাবে ভাবিই না। যত দিন শরীর দেবে, তত দিন কাজ করে যাব। ‘পিকু’ তৈরি হওয়ার সময় অলরেডি অন্য প্রোজেক্ট নিয়ে কথাবার্তা ফাইনালাইজ হয়ে যাচ্ছিল। ভবিষ্যতে আমার প্রোডাক্টগুলো কী দাঁড়াতে পারে, তার রূপরেখা ঠিক হচ্ছিল।

রিটায়ারমেন্টের কথা মাথাতেই আসেনি। আসলে আমার মতো অভিনেতাদের, স্পোর্টসম্যানদের — সেল্ফ লাইফ খুব ছোট। যতক্ষণ আমাদের শরীর দেয়, তত দিনই আমরা। বডি যখন সঙ্কেত দিতে শুরু করবে, আর না, স্টপ। তখন স্টপ করে দেব।

তেন্ডুলকর আপনার খুব কাছের বলে, ওঁকে নিয়ে একটা ঘটনা বলছি।

গো অ্যাহেড।

একবার টেনিস এলবো আর অফ ফর্মে বিপর্যস্ত অবস্থায় সচিন গিয়েছিলেন গ্রেগ চ্যাপেলের কাছে। গ্রেগ তখন ব্যাখ্যা করেন, পেশাদার জীবনে এগোতে এগোতে অনেক সময় মনের মধ্যে সেল্ফ ডাউটস জমতে থাকে। এই কুয়াশা দূর করার বেস্ট উপায় হল, মনকে স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেখান থেকে তার পেশাদার জীবনের দৌড় শুরু হয়েছিল। তা হলে নাকি শুরুর সেই খিদে আর ফ্রেশনেস ফেরত পাওয়া যায়। সচিন সেই চ্যাপেল ফর্মুলা ফলো করে উপকারও পেয়েছিলেন।

কৌতূহল হচ্ছে, মিস্টার বচ্চন আপনিও কি মনকে পিছোতে পিছোতে স্টার্টিং ব্লকে নিয়ে যান? নইলে এত দশক পরেও এমন ফ্রেশনেস আর খিদে কী করে বেঁচে থাকে?

প্রথমত, সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে আমার কোনও তুলনা হয় না। সচিন হল একজন জিনিয়াস। জিনিয়াস আর সাধারণ মানুষের কোনও কম্পারিজন হয় নাকি? আমার কর্মপদ্ধতিতে এমন কোনও দর্শন নেই। সেটা অনেক সাদামাঠা। যা বলে, তোমার ডিরেক্টর যা চাইছে সেটা যদি দেওয়ার সামর্থ্য থাকে, তা হলে সেটা করে দেখাও। তাকে খুশি করো। যদি ডিরেক্টর বলে, ধানখেতের উপর তুখড় নাচতে হবে, তা হলে সেটা করার চেষ্টা করো। না পারলে তৈরি থেকো ফিল্ম থেকে বাদ হয়ে যাওয়ার জন্য। আমার জীবনে সেটা ঘটেছে।

কী বলছেন?

অফ কোর্স। সিম্পল কথা হল, ব্যাপারটাকে জটিল করার দরকারই নেই। জাস্ট গো অ্যান্ড ডু ইট।

আপনি এমন ভাবে বলছেন, জাস্ট গো অ্যান্ড ডু ইট। যেন পৃথিবীর সহজতম কাজ।

সেটা তো করতেই হবে। যে আপনাকে কাজ দিল, তাকে তো আমার সীমিত সামর্থ্য দিয়েই খুশি করার অবিরাম চেষ্টা চালাই।

আপনি না বড্ড বেশি বিনয়ী!

না, না, আমি মনের কথাই বলছি। অভিনয় করতে আমি দারুণ ভালবাসি তাই আজও মন দিয়ে কাজটা করে যাচ্ছি। আমি এখনও কাজ পাচ্ছি, লোকে টুকটাক আসছে। তা হলে বন্ধ করে দেব কেন?

মুম্বই ইন্ডাস্ট্রি আপনাকে বাড়তি শ্রদ্ধা করে কারণ চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েও আপনি সেটা গচ্ছিত রাখতে পেরেছেন। রাজেশ খন্নার মতো সাফল্য পেয়েও সেটাকে অপব্যবহারে ছুড়ে ফেলেননি।

এ ভাবে বলাটা কিন্তু খুব অন্যায় হল। এথিক্যালি ঠিক হল না মোটেও।

কেন?

বিকজ উই হ্যাভ অল হ্যাড আওয়ার আপস অ্যান্ড ডাউনস। উই হ্যাভ অল হ্যাড আওয়ার মোমেন্টস। একজনকে সিঙ্গল আউট করছেন কেন?

মিস্টার বচ্চন, আপনি নিজের বেলা ‘হ্যাড’ বলছেন কেন? হ্যাড মানে তো পাস্ট টেন্স। আপনি তো আজও ফাটিয়ে কাজ করছেন।

না, সেটা সত্যি নয়।

কোনটা সত্যি?

সত্যি এটাই যে মোটেও আমার আগের জায়গা নেই।

মুম্বইয়ের আজকের টপ স্টারদের সঙ্গে আমি আর এক ব্র্যাকেটে পড়ি না। ওরা আমার থেকে অনেক এগিয়ে। বয়স সবচেয়ে বড় বাধা। এই প্রফেশনের ধর্মই তাই যে, যত আপনার বয়স বাড়বে, তত নতুন নতুন ছেলেরা সামনের দিকে এসে যাবে। এটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই।

আপনি কলকাতায় এত দিন কাটিয়ে গেলেন। কলকাতার অভিনয় জগতের আকাশেবাতাসে আজও উত্তম-সৌমিত্র। দুই লেজেন্ড সম্পর্কে আপনার উপলব্ধিটা বলবেন?

লেজেন্ড মানে! অ্যাবসলিউট লেজেন্ড! এঁদের বডি অব ওয়ার্ক আমার মতো অভিনেতার তুলনায় এত উচ্চাঙ্গের যে বারবার দেখার পরেও শিহরিত হতে হয়। অনুপ্রাণিত হতে হয়। উত্তম-সৌমিত্রর ফিল্মগুলো বারবার দেখা উচিত শুধু অ্যাক্টিংয়ের টুকরো সূক্ষ্মতাগুলো বোঝার জন্য। বুঝে নিজের অভিনয়ে সেটা মেশাবার জন্য। আমার তো শুধু এঁদের সম্পর্কে কথা বলতেই ইন্সপায়ার্ড লাগে! অবজার্ভ করাটা যে কোনও অভিনেতার বড় সম্পদ। আমার যে কত বার হয়েছে এঁদের ছবিতে অমুক সিনটা আছে। আমি ভাল আন্দাজ করতে পারছি এটা কী ভাবে ফুটিয়ে তোলা হবে। অথচ সিনটা হয়ে যাওয়ার পর হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করলাম আমি কত ভুল ভেবেছিলাম। আর ওঁরা কত ঠিক!

আপনি তো উত্তমকুমারের সঙ্গে একটা ফিল্মে কাজও করেছেন?

হ্যাঁ, ‘দেশপ্রেমী’। ওই ফিল্মটায় সর্বভারতীয় একটা আমেজ ছিল। উত্তমদাকে ছবিতে নেওয়া হয়েছিল বোধ হয় উনি বেঙ্গল থেকে বলে। খারাপ লাগে তার পর আর ওঁর সঙ্গে অভিনয়ের কোনও সুযোগ পেলাম না।

আর সৌমিত্রর কোন কোন ছবি আপনার প্রিয়?

মানিকদার যা যা কাজ উনি করেছেন, সব ক’টা। রিসেন্টলি ওঁর দু’টো কাজ দেখলাম। ‘বেলাশেষে’ আর সুজয়ের শর্ট ফিল্মটা।

‘অহল্যা’?

ইয়েস ‘অহল্যা’। কী ওয়ান্ডারফুল কাজ করেছেন। আপনি বলছিলেন আমার এত বেশি বয়সে কাজ করা নিয়ে। সৌমিত্রদাকে তা হলে কী বলবেন? এই বয়সেও পরের পর কী দুর্ধর্ষ কাজ করে যাচ্ছেন।

ঠিক। সৌমিত্রকে সবাই সে জন্য বাড়তি সম্মান করে। একটা কথা বলুন, এই যে দু’মাস এখানে কাটালেন, সবচেয়ে ‘বিজ়ার’, সবচেয়ে উদ্ভট কী করলেন?

হা হা হা। কলকাতার অনেক জায়গায় আমার আগে যাওয়া হয়নি। সেগুলো এ বার মনের সুখে ঘুরলাম। এই ফিল্মটা আসলে হওয়ার কথা ছিল গোয়ায়। আমাদের কিছু পারমিশন প্রবলেম হচ্ছিল। সুজয় এসে একদিন সেটা বলাতে, আমি সাজেস্ট করি কলকাতায় চলো না। সুজয় তখনই বলল, প্রমিস করছি, আপনাকে কলকাতায় এমন সব জায়গা দেখাব যা আগে কখনও দেখেননি (হাসি)।

সে জায়গাগুলো কোথায়?

উত্তর কলকাতার কত সব গলি তস্য গলি। নর্থ ক্যালকাটাতেই বড় নেতাজির মূর্তি, একটা জাংশন...

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়?

ইয়েস ইয়েস। উত্তর কলকাতার পুরনো সব বনেদি বাড়ি। গঙ্গার উপর দিয়ে বোটে করে যাওয়া। তারপর পুরনো সব ফ্যাক্টরিতে শ্যুটিং। আমি যে বার্ড কোম্পানিতে চাকরি করতাম, এই কোনও কোনও কারখানা তাদের মালিকানাধীন ছিল। আমায় তখন ভিজিটে যেতে হত। আজ এত বছর পর আমি সেখানে শ্যুটিং করতে এসেছি। কী অপূর্ব নস্টালজিয়া! তার পর আমার শান্তিনিকেতন দেখার এত সাধ ছিল। কাছাকাছি জঙ্গলে আমাদের শ্যুটিং পড়েছিল। টুক করে আমি শান্তিনিকেতনটা ঘুরে এলাম।

কর্পোরেট চাকরি করার সময় তো, মোটামুটি নির্দিষ্ট একটা বৃত্ত। তার বাইরে খুব একটা যাওয়ার বোধহয় স্কোপ নেই।

এক রকম তাই। ঘুরে ফিরে একটা নির্দিষ্ট সার্কেলেই থেকেছি। ক্লাব-রেস্তোরাঁ, অফিস, বাড়ি। একটা নির্দিষ্ট সোশ্যাল সার্কেল। কলকাতার এই দিকগুলো দেখার সুযোগই আমার হয়নি যা ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে, সৃষ্টিতে এত ঐশ্বর্যশালী। কী মায়াবী এই শহর। কত কিছু যে দেখার, জানার আর শেখার রয়েছে!

প্রতিবার আপনি যখন শ্যুটিং করতে কলকাতা আসেন, গড়পড়তা বাঙালির অদ্ভুত অনুভূতি হয়। তাদের মনে হয় ঘরের ছেলে আবার বোধহয় ঘরে ফিরল। এটা জেনেও যে আসলে আপনার শেকড় অন্যত্র। অন্য কোথাও।

তা কেন? কালকাতাও তো এক অর্থে আমার শেকড়ের শহর। যৌবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাত-আট বছর তো এখানেই কাটিয়েছি। কলকাতা আমাকে প্রথম সিগারেট খেতে শিখিয়েছে। কলকাতাতে জীবনে প্রথম ড্রিঙ্ক করি। কলকাতা আমার প্রথম স্বাধীনতা দিয়েছে।

আপনার চারপাশে এখন বাঙালি পরিচালকের ভিড়। সুজয়, সুজিত, অনিরুদ্ধ।

নিছক কো ইনসিডেন্স (হাসি)।

কিন্তু আপনার বাংলাটা নিশ্চয়ই এমন বাঙালি এনভায়রনমেন্টে অনেক বেটার হয়েছে?

না, না, আমাকে অনেক ইমপ্রুভ করতে হবে। যখন আমি বাংলায় মুখ খুলি, চারপাশে সবাই হাসাহাসি শুরু করে। হয় উচ্চারণে গন্ডগোল হচ্ছে। নয়তো গ্রামারে। খুব বিকট হয়ে যায়। আমায় চেষ্টা করতে হবে বাংলাটা বেটার করার জন্য। নইলে সবার উপহাসের পাত্র হয়ে থাকতে হবে। ঋতুপর্ণ তো কমপ্লেন করে এসেছিল জয়াকে, অমিতদা এমন হাবভাব করে যেন দারুণ বাংলা জানে। অথচ ওর বাংলা কী জঘন্য। আমরা শুনলেই হাসি।

অভিনেতার কি প্রিয় শহর বলে কিছু থাকে, যেখানে সে নিজেকে ছাপিয়ে স্রেফ পারিপার্শ্বিক মাহাত্ম্যে আরও দূরে চলে যেতে পারে?

নট রিয়েলি। থাকার কথা নয়। পরিবেশ যদি ফ্রেন্ডলি হয়। কাজ সহায়ক হয়। সেটা অবশ্যই সুবিধে। কিন্তু আসল কথা হল, স্ক্রিপ্ট আর পরিচালনা। মনে করা যাক, আমার চরিত্রটা উত্তর কলকাতার এঁদো গলিতে থাকে। এ বার তার জন্য শব্দগুলো কী ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে? লোকেশনের সঙ্গে সেটা কি খাপ খাচ্ছে?

কলকাতায় শ্যুটিং হওয়া আপনার তিনটে ছবি হিট। ‘দো আনজানে’, ‘ইয়ারানা’ আর ‘পিকু’। এ বার যখন ‘তিন’‌য়ের শ্যুটিং করতে এলেন, মাথায় এমন ভাবনা কাজ করেনি যে, এই শহর আমায় হ্যাটট্রিক দিয়েছে। এটাতেও ভাল হবে?

নট অ্যাট অল। আমি এ ভাবে ভাবিই না। এ রকম তথ্য শুনলে কার না ভাল লাগে। কিন্তু আমি সার সত্যটা মাথায় রাখা থেকে বিচ্যুত হই না, তুমি যে-ই হও না কেন, স্ক্রিপ্টের ওপর উঠতে পারবে না।

সমস্যা হল, সিনেমাকে দেখার ধরনে আমরা বড় বেশি সেলিব্রিটি সচেতন। স্টার সচেতন। আমরা একবারও ভাবি না সিনেমা বানানোর এফর্টটা কী রকম? যখন লেখক ভদ্রলোক লেখেন, তখন তাঁর মাথায় কী ঘোরাফেরা করে? যিনি সেই লেখার ভিত্তিতে ছবি পরিচালনা করেন, তিনিই বা কী ভাবেন? ‘পিকু’ যেমন। ক’জন সুজিতকে জিজ্ঞেস করেছে এ রকম একটা ব্যতিক্রমী বিষয়ের ওপর হঠাৎ করে কেন ছবি বানালেন? ক’জন জুহি চতুর্বেদীর কাছে জানতে চেয়েছে, যেখানে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা নায়কের সঙ্গে নায়িকার প্রেম আর দিনান্তে ন্যায়বিচার দেখিয়ে এসেছে, সেখানে সেই ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গিয়ে কী করে ভাবলেন এমন থিম? ‘পিকু’র থিম হল এমপাওয়ারমেন্ট অব ওম্যান ইন মডার্ন সোসাইটি। কী অসামান্য ভাবেই না সেটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! বাবা-মেয়ের চরিত্র ঘিরেও কত ঘনঘটা! এত কাল লোকে বন্ধ দরজার আড়ালে ফিসফিস করে যা বলাবলি করত, ‘পিকু’ সেটাই স্পষ্টাস্পষ্টি করে দিয়েছে। এটাই হল ছবিটার সততা।

ছবির স্ক্রিপ্ট যখন হাতে পেলেন, অস্বস্তি হয়নি? আপনি অমিতাভ বচ্চন! আপনাকে কিনা বলতে হবে আমার পটি হচ্ছে না, আমার মোশনের সঙ্গে ইমোশন জড়িয়ে, এই সব?

সাক্ষাত্কারের পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায়...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amitabh bachchan gautam bhattacharyay interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE