ওটিটি-তে সাড়া ফেলেছে ‘পাতাললোক ২’। নাগাল্যান্ডের প্রেক্ষাপটে এই সিজ়নের গল্প। জয়দীপ অহলাওয়াত ও তিলোত্তমা সোমের পাশাপাশি স্নাইপারের চরিত্রে নজর কেড়েছেন প্রশান্ত তামাং। অভিনেতাকে দেখেই দর্শকদের একাংশের চেনা চেনা ঠেকেছে। মনে হয়েছে, ‘কোথায় যেন দেখেছি...!’ স্মৃতির পাতা উল্টে দেখলে বোঝা যায়, প্রশান্ত আসলে ‘ইন্ডিয়ান আইডল ৩’-এর বিজয়ী। সাল ২০০৭— বিপুল ভোটে গানের রিয়্যালিটি শোয়ে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। ‘পাতাললোক ২’-এর খাতিরে ফের মানুষের মন জয় করলেন। এত দিন কোথায় ছিলেন? এত জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরেও কেন মুম্বইতে নিজের জায়গা তৈরি করলেন না? সব নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বললেন প্রশান্ত।
প্রশ্ন: এটাই কি প্রশান্তের প্রত্যাবর্তন?
প্রশান্ত: (হাসি) আমিও তেমনই আশা করছি। ‘ইন্ডিয়ান আইডল ৩’-এর পরে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলাম। ‘পাতাললোক ২’-এর মাধ্যমে আবার সেটা ফিরে পেয়ে তো খুব ভাল লাগছে।
প্রশ্ন: অনেকটা সময় লেগে গেল ফিরতে। কেন বলুন তো?
প্রশান্ত: আমি নেপালের দিকেই বেশি কাজ করছিলাম এত দিন। নেপালের বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছি। তার পাশাপাশি এ দিকেই গানের অনুষ্ঠান নিয়েও ব্যস্ততা ছিল।
প্রশ্ন: সেখান থেকে ‘পাতাললোক’-এ কাজের সুযোগ এল কী ভাবে?
প্রশান্ত: আমি কিন্তু ‘পাতাললোক’-এর প্রথম সিজ়নের বিরাট ভক্ত। অতিমারির সময়ে মুক্তি পেয়েছিল, মনে আছে। এত ভাল লেগেছিল, আমি গোটা সিরিজ়টা দু’বার দেখেছিলাম। এ বার বলি কী ভাবে এই সিরিজ়টার সুযোগ এল। আমি নাগাল্যান্ডে গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা। তখন আমার কন্যার বয়স মাত্র এক। আমার স্ত্রীর এক বান্ধবী এসে জানায়, একটা ওয়েব সিরিজ়ের অডিশন চলছে। ওরা জানে, আমি আগ্রহী, তাই আমাকে জানায়। তবে এটা যে ‘পাতাললোক ২’-এর জন্য তা জানতাম না। পোশাকশিল্পী নিকিতা গ্রোভারকে ইনস্টাগ্রামে মেসেজ করে বলি, আমি অডিশন দিতে চাই। তার পর অডিশন দিই এবং আমাকে ওঁরা নির্বাচন করেন।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশ্ন: ‘পাতাললোক ২’-এর স্নাইপার ড্যানিয়েল চরিত্রে অভিনয় করে কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
প্রশান্ত: প্রতিক্রিয়া তো ভালই পাচ্ছি। ‘পাতাললোক ২’ মুক্তি পাওয়ার পর পরই ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে আমার গানের অনুষ্ঠান ছিল। অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম। সদ্য দেশে ফিরে ভাল প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি।
প্রশ্ন : আবার মানুষ চিনতে পারছে?
প্রশান্ত: হ্যাঁ সবাই বলছে, ‘‘আরে ড্যানিয়েল তো আসলে ইন্ডিয়ান আইডল-এর প্রশান্ত তামাং।’’ আসলে এই কাজটা পাওয়ার পরে আমি তেমন কাউকেই বলিনি। ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যেমন অমিত পাল, দীপালি, চ্যাং, অভিষেকদের বলেছিলাম। সবাই দেখার পরে তো বেশ অবাক ও খুশিও।
প্রশ্ন: গান গেয়ে পরিচিতি পাওয়ার আগে আপনি পুলিশে চাকরি করতেন...?
প্রশান্ত: হ্যাঁ, আমি কলকাতা পুলিশে ছিলাম।
প্রশ্ন: তা হলে তো বাংলায় কথা বলতে পারেন নিশ্চয়ই?
প্রশান্ত: অবশ্যই (বাংলায়)। কলকাতা পুলিশে এক সহকর্মী ছিলেন উত্তম দেবনাথ নামে। ওঁর কাছেই বাংলা শিখতাম। আর আমি ওঁকে নেপালি ভাষা শেখাতাম। পুলিশের চাকরি করার সময়ই আমার সহকর্মীরা গানে উৎসাহ দিতেন। তার পর একদিন গিয়ে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর অডিশন দিই।
প্রশ্ন: ‘ইন্ডিয়ান আইডল ৩’-এ আপনার পুরনো মিউজ়িক ভিডিয়ো কিন্তু আবার মানুষ শুনছে। ভালবাসা জানাচ্ছে। এত জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরেও মুম্বই শহর, বলিউড থেকে দূরে সরে গেলেন কেন?
প্রশান্ত: বলিউড আসলে অনেক বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি। অনেক স্তর রয়েছে এই জগতে। চেষ্টা তো করেছিলাম টিকে থাকার। কিন্তু মুম্বইয়ে টিকে থাকা বেশ কঠিন। তবে সেখানে থাকতে পারিনি বলে কোনও আক্ষেপ নেই। আমি কাজ করে চলেছি। ভবিষ্যতে কী হবে, সেই সব ভাবি না। বরং বর্তমানে ভাল হচ্ছে, সেটাই আমি দেখি। যা হচ্ছে, তা নিয়ে আমি খুশি। খুশি থাকতেই হবে।
প্রশ্ন: আপনি তো জাতীয় মঞ্চে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন...
প্রশান্ত: না, সেটা ঠিক নয়। আমি পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিঙের মানুষ। তবে এটা ঠিক, আমি মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, সিকিম থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়েছিলাম। আমাদের সংস্কৃতির মিল রয়েছে। এই রাজ্যগুলির মানুষ আমার সঙ্গে যোগ তৈরি করতে পেরেছেন। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সমর্থন তো পেয়েছিলাম বটেই!
প্রশ্ন: আপনার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও, এতগুলি রাজ্যের মানুষ আপনাকে গানের রিয়্যালিটি শোয়ে সমর্থন করেছিলেন। শোনা গিয়েছিল, শক্তিশালী ভোটব্যাঙ্কের জন্যই নাকি আপনি জিতেছেন?
প্রশান্ত: হ্যাঁ, এটা সত্যি। প্রচুর মানুষ আমার জন্য ভোট করেছিলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে আমার সঙ্গে অমিত পাল ছিলেন। অমিতও কিন্তু মেঘালয়ের শিল্পী। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ইমন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। আমি কিন্তু মনে করি, ওঁরা আমার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন। কিন্তু আমার অনুরাগীরা আমাকেই সমর্থন করেছিলেন। আমি শুধু ভোট পেয়ে জিততে চাইনি। কিন্তু অনুষ্ঠানের কাঠামোই তেমন ছিল— যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, সে-ই জিতবে। শেষ পর্যন্ত আমিই জয়ী হয়েছিলাম। সেই জন্য সমর্থকদের প্রতি আমি সব সময়ে কৃতজ্ঞ থাকব। তবে আবারও বলব, এই ভাবে আমি জিততে চাইনি।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশ্ন: আপনি নিজেও এটাই মনে করেন? এমন কিন্তু সচরাচর হয় না!
প্রশান্ত: হ্যাঁ। মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু এটাই সত্যি। আমার থেকে ভাল সঙ্গীতশিল্পী অনেকে ছিলেন। আমি ভোটের জন্যই জিতেছিলাম। এখনও তো ওই অনুষ্ঠানের প্রায় সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: ওই সিজ়নের বিচারক— অনু মালিক, জাভেদ আখতার, উদিত নারায়ণ, আলিশা চিনয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে?
প্রশান্ত: না, ওঁদের কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। বলিউডের কারও সঙ্গেই তেমন যোগাযোগ নেই।
প্রশ্ন: বর্তমানে তো রিয়্যালিটি শো-এ অনেক বদল এসেছে। আগের থেকে কতটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়?
প্রশান্ত: আমি সেই ভাবে এখন দেখি না। এখন তো রিয়্যালিটি শো-তে ‘রিয়্যালিটি’ই নেই। বাস্তবতাই যদি না থাকে, তা হলে আর রিয়্যালিটি শো বলব কেন? আগে যা দেখানো হত, তার মধ্যে কোনও ভণিতা ছিল না। আমাদের গান থেকে শুরু করে বিচারকদের মন্তব্য, সবটাই খুব খাঁটি ছিল। কিন্তু এখন তেমন দেখি না। আমি তো ‘রিয়্যালিটি শো’-এর মঞ্চ থেকে উঠেছি। আমার হয়তো এই কথাগুলো বলা শোভা পায় না। কিন্তু সত্যি কথা তো বলতেই হবে।
প্রশ্ন: আপনি বিপুল ভোটে গানের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান জিতেছিলেন। জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। কখনও রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আসেনি?
প্রশান্ত: আসলে দার্জিলিঙের পরিস্থিতি বা কী ঘটছে, আমি সব খবরই রাখি। কিন্তু রাজনীতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ ছিল না। আমি চাই আমার এলাকায় ভাল কিছু হোক। আগে তো আরও ভাল পরিস্থিতি ছিল। বহু পর্যটক আসতেন। এখন তো রাজনীতির দস্তুরটাই আলাদা। আমার বাড়ি দার্জিলিঙের চৌরাস্তার কাছেই। আগে আমরা সকালে হাঁটতে বেরোতাম। কিন্তু এখন রাস্তায় এত জ্যাম হয়। রাস্তাও ছোট।
প্রশ্ন: আচ্ছা আবার ‘পাতাললোক’ প্রসঙ্গে আসি। জয়দীপ অহলাওয়াত ও তিলোত্তমা সোমের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন?
প্রশান্ত: তিলোত্তমা তো খুবই মিষ্টি মানুষ। অন্য দিকে জয়দীপ স্যর অত বড় মাপের অভিনেতা। অথচ ওঁরা কিন্তু পা মাটিতে রেখে চলেন। প্রথম সিজ়নে ওঁকে দেখেছি। এ ছাড়াও ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’-এও দেখেছি। ওঁর ভক্ত ছিলামই। কিন্তু ওঁর সঙ্গে দেখা করার পরে এক বারও মনে হয়নি, বিরাট মাপের এক তারকার সঙ্গে দেখা করছি। ওঁর কাজ দেখে শিখেছি। মানুষ হিসাবেও খুব ভাল। একই কথা বলব তিলোত্তমার জন্য। আমরা বাংলায় কথা বলতাম। দু’জনের থেকেই অনেক কিছু শিখেছি।
প্রশ্ন: উত্তর-পূর্ব ভারতে তো বহু প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু জাতীয় মঞ্চে তাঁরা সেই ভাবে পরিচিতি পান না বলে মনে হয়?
প্রশান্ত: আমি এই কারণেই ‘পাতাললোক ২’-এর জন্য সুদীপ স্যরের (সুদীপ শর্মা) কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। এই সিরিজ়ে নাগাল্যান্ডের কথাও তুলে ধরা হয়েছে এবং খুব ভাল করে তুলে ধরা হয়েছে। অনেকেই এখনও জানে না, ভারতের মানচিত্রে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর ঠিক কেমন দেখতে। তাই বলা যায়, এই সিরিজ়ের মাধ্যমে আমাদের জন্য একটা রাস্তা খুলে গেল। মানুষ হয়তো এই রাজ্যগুলোকে আরও ভাল করে চিনতে পারবেন। কারণ এত দিন আমাদের সংস্কৃতি বা রাজ্য নিয়ে কোনও কাজ হয়নি। এখনও আমাকে লোকে প্রশ্ন করে, নাগাল্যান্ড কোথায়? উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের সঙ্গে যে হেতু চিন ও জাপানের মানুষের গড়নের মিল রয়েছে, সে হেতু সকলে খুব সহজেই আমাদের ‘চাইনিজ়’ বা ‘জাপানিজ়’ বলে ফেলেন। আমরাও যে ভারতীয়, সেটা তাঁরা ভাবেন না। মানুষের এ বার বোঝা উচিত, আমরাও সমান ভাবে ভারতীয়। আমরা তো অন্যদের বলি না, আপনারা পাকিস্তান বা বাংলাদেশের। তা হলে আমাদের কেন প্রশ্ন করা হয়, আপনারা চিন বা জাপানের মানুষ? আসলে মানুষ এখনও উত্তর-পূর্ব ভারতকে চিনেই উঠতে পারেনি। এই জন্যই ‘পাতাললোক ২’-এর কাছে কৃতজ্ঞ। সিরিজ়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রত্যেক অভিনেতার জন্য আমি গর্বিত। হয়তো তাঁরা ভাল করে হিন্দি বলতে পারেন না। কিন্তু চেষ্টা করেছেন।
প্রশ্ন: আচ্ছা ‘পাতাললোক’-এর কোন সিজ়ন ভাল লাগল বেশি?
প্রশান্ত: আমি হয়তো দ্বিতীয় সিজ়নে কাজ করেছি। নিজের সেরা অভিনয়টা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, আমার প্রথম সিজ়ন বেশি পছন্দ।
প্রশ্ন: ফের চর্চায় উঠে এসেছেন। পরিবারের কী প্রতিক্রিয়া?
প্রশান্ত: পরিবারের সকলেই খুব খুশি। আমার মেয়ের বয়স এখন আড়াই বছর। আশা করছি, ওরা এ বার আরও বেশি কাজ করতে দেখবে আমাকে। আপাতত কার্শিয়াং, নেপাল ও অরুণাচল প্রদেশে গানের অনুষ্ঠান নিয়ে কাজ চলছে।