Advertisement
E-Paper

চুম্বন থেকে আলিঙ্গন, নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠতা তৈরি করছে দর্শক! ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য কি লিখবে এ বার ‘এআই’?

প্রযুক্তির দৌলতে এ সব এখন জলভাত। স্বতন্ত্র-কমলিনীর বিয়ে থেকে আর্য-অপর্ণার সন্তান! ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য তৈরি করছে দর্শক নিজেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা প্রভাব ফেলছে বিনোদনজগতে?

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:৫৪
‘এআই’ কি এ বার চিত্রনাট্য লিখবে বাংলা ধারাবাহিকের?

‘এআই’ কি এ বার চিত্রনাট্য লিখবে বাংলা ধারাবাহিকের? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

কয়েক দিন পরেই শাহরুখ খানের জন্মদিন। সেই আনন্দে কি ‘বাদশা’র সঙ্গে ক্যাফেতে বসে নিজস্বী তুলতে চান? আচমকা এই প্রশ্নে আপনি ধাক্কা খেলেও প্রযুক্তির দৌলতে এ সব এখন জলভাত। প্রিয় তারকার ‘সঙ্গ’ উদ্‌যাপনের এমন সব ‘ছবি’তে সমাজমাধ্যম ভরানো এখন নবতম শখ। কাদের শখ? এই উত্তর পেতে চাইলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়! এই তালিকায় জ়েন-জ়ি যেমন আছে, পিছিয়ে নেই তুলনায় বয়সিরাও। বিনোদনজগৎ ঘিরেও এখন এই হাওয়া, যার দাপটে কম্পমান অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে গোটা ইন্ডাস্ট্রি!

ছোট্ট দুটি শব্দ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! ইংরেজিতে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’, সংক্ষেপে এআই। এই প্রযুক্তির দাপটেই নাকি সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সৃজনশীলতার ‘কপিরাইট’ নাকি কেড়ে নিতে পারে এই অভিনব প্রযুক্তি! আপাতত আবির্ভাবের পর থেকে গত দু’তিন বছর ধরে এই প্রযুক্তি যে ‘দুষ্টুমি’ দেখাচ্ছে, তাতে চিন্তার ভাঁজ সারা দুনিয়ায়। বিপদের আশঙ্কার বাইরে নেই বিনোদনজগৎও।

‘দুষ্টুমি’ই তো! দীপিকা পাড়ুকোনের বা লিওনার্দো ডি-কাপ্রিয়োর সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে চাইলে নিমেষেই তা পূরণ করা যাচ্ছে এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। আর এ ভাবেই মনের গোপন (অন্যের ক্ষেত্রে আপত্তিকর) ইচ্ছা পূরণের জম্পেশ হাতিয়ার খুঁজে পেয়ে আত্মহারা লোকজন। সমাজমাধ্যম ভরে উঠছে এইসব ছবির মেলায়। কিন্তু এর ছায়া যে ভাবে বিনোদনজগতে পড়েছে, বিশেষত বাংলা ধারাবাহিকে, তা খুবই উদ্বেগজনক। দর্শক যেমনটা কল্পনা করছে, ঠিক সেই ভাবেই নিজেদের মতো করে চিত্রনাট্য সাজিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য কী ভাবে দর্শকের মতো করে তৈরি হচ্ছে? ধরা যাক, দর্শক নিজেদের কল্পনায় ভাবছে, তাদের প্রিয় নায়ক-নায়িকা এই বুঝি আলিঙ্গনাবদ্ধ হবে। কিন্তু, ধারাবাহিকের আসল যে চিত্রনাট্য, তাতে ওই দুই চরিত্রের শারীরিক স্পর্শ দেখানোর কোনও ইঙ্গিতই দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাতে কী? অনুরাগীরা তাঁদের কল্পনাজালে জড়িয়ে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র সাহায্যে চিত্রনাট্যও লিখে ফেলছে এখন। মনে আছে, শাহরুখ খানের সেই বিখ্যাত সংলাপটির কথা? ‘বাদশা’ বলেছিলেন, ‘কহতে হ্যায় অগর কিসি চিজ় কো দিল সে চাহো, তো পুরি কায়নাত উসে তুমসে মিলানে কি কোশিশ মে লগ যাতি হ্যায়’। কিন্তু কে জানত গোটা বিশ্ব-সংসার নয়, এখন এই সমস্ত ‘ইচ্ছাপূরণ’ করতে হাতের মুঠোফোনটাই যথেষ্ট। তা হলেই কেল্লাফতে!

‘করবা চৌথ’-এর দিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ছবি তৈরি করেছিলেন সুদীপা চট্টোপাধ্যায়।

‘করবা চৌথ’-এর দিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ছবি তৈরি করেছিলেন সুদীপা চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

সাধারণ মানুষ তো বটেই, অভিনেতাদের জীবনেও নতুন বিড়ম্বনার নাম এই ‘এআই’ প্রযুক্তি। ২০২৩ সালে অভিনেত্রী রশ্মিকা মন্দানার সেই বিতর্কিত ‘ডিপফেক’ ভিডিয়ো ঘিরে সমাজমাধ্যম তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। কালো জিম পোশাকে অভিনেত্রীর একটি ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়তেই অনুরাগীদের সন্দেহ হয়। কারণ, ভিডিয়োটিতে যে মহিলাকে দেখা গিয়েছিল তাঁর মুখ, কণ্ঠস্বর হুবহু রশ্মিকার মতো হলেও চেহারায় কিছু অসঙ্গতি ছিল। এ নিয়ে অভিনেত্রীর অভিযোগের পরে তদন্তে প্রমাণিত হয়, সেই ভিডিয়োটি আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি করা ‘ডিপফেক’ ভিডিয়ো। ‘ডিপ লার্নিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অডিয়ো, ভিডিয়ো এবং ছবির উপর কারসাজি করে এমন ভিডিয়ো তৈরি করা হয়, যা দেখে আসল না নকল তা বোঝার উপায় থাকে না। একজন মানুষের শরীরের উপর অন্যজনের মুখ বসিয়ে ছোট ছোট ভিডিয়ো তৈরি করা হচ্ছিল। কার্যত এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের শুরু প্রায় তখন থেকেই।

ব্যস! তখন থেকেই ‘ডিপফেক’ ভিডিয়োর আতঙ্কে রীতিমতো তটস্থ ঐশ্বর্য রাই বচ্চন থেকে দীপিকা পাড়ুকোন, আলিয়া ভট্ট, আমির খান-সহ তাবড় তারকারা। কারণ, এই দু’-তিন বছরে সারা বিশ্বের বিনোদনজগতের অনেক মানুষ এই ‘ডিপফেক’ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।

কলকাতা শহরেরই বিনোদনজগতের এক রসিক মানুষের কথায়, বেশির ভাগ মানুষ সৃজনশীলতা নয়, প্রযুক্তিকে যখন খেলনার মতো সহজ করে হাতে পেয়ে যায়, তখন তা থেকে মশলাদার মজাই বেশি খোঁজে। এই তালিকায় আমজনতার পাশাপাশি বিনোদনের লোকজনও বাদ যান না। প্রত্যেকেই নিজেদের শারীরিক রূপে কল্পনার রং মেশাতে চান। মনে মনে নিজেদেরকে যে ভাবে কল্পনা করেছেন, প্রযুক্তির কেরামতি তাকে সে-ভাবেই সাজায়। কিন্তু এই প্রযুক্তি যে ব্যুমেরাং হয়ে যাবে, তা কি বোঝা গিয়েছিল?

ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন কি ভাবতে পেরেছিলেন, মেয়ে আরাধ্যার প্রেম করার বয়স প্রায় এসে গেলেও তাঁর নিজের ২০ বছর আগের প্রেম নিয়ে কাটাছেঁড়া চলবে এখনও? এবং সেই এআই ‘অস্ত্র’ প্রয়োগ করেই! সলমন খানের সঙ্গে তাঁর প্রেম ভেঙেছে এক যুগের বেশি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও যখন-তখন দেখা যায়, সলমনের সঙ্গে ঐশ্বর্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে। কখনও আবার ঐশ্বর্য আর অভিষেক বচ্চনের মেয়ে আরাধ্যা শুয়ে আছে সলমনের কোলে!

আসা যাক ঘরের কাছে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে! কিছু দিন আগের ঘটনা। দিতিপ্রিয়া রায় এবং জীতু কমলকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে কোলে বাচ্চার ছবি দিয়ে এমনই একটা ‘ছবি’ তৈরি করা হয়েছিল। তা নিয়ে বিপুল তর্ক-বিতর্ক। ওই অভিনেতা ও অভিনেত্রীর মধ্যেও এই ছবি ঘিরে বিস্তর ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু ততদিনে সমাজমাধ্যমে ‘গল্পের গরু’ কল্পনার ভিন্‌গ্রহ ছুঁই ছুঁই!

মেয়ে দুয়ার সঙ্গে রণবীর সিংহ এবং দীপিকা পাড়ুকোনের ‘এআই’ ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।

মেয়ে দুয়ার সঙ্গে রণবীর সিংহ এবং দীপিকা পাড়ুকোনের ‘এআই’ ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

এই মওকায় নায়ক-নায়িকাদের অনুরাগীরাও নিজেদের পছন্দের নায়ক-নায়িকাকে জুড়ে তৈরি করছে ‘কল্পজগৎ’। ঠিক যেমনটা তাঁরা দেখতে চান। এ এক অদ্ভুত মজা! সেই জালে জড়িয়ে পড়ছেন অভিনেতারাও। এই তো, কিছু দিন আগেই শোনা গিয়েছিল অভিনেতা অর্পণ ঘোষালের একটি ধারাবাহিক আসতে চলেছে। তার পর অভিনেতা নিজেই জানান, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র সাহায্য নিয়ে অনুরাগীদের মনগড়া তথ্য সেটি। একই সমস্যায় পড়েছিলেন অভিনেতা সাহেব ভট্টাচার্যও। ‘চিরসখা’ ধারাবাহিকের স্বতন্ত্র-কমলিনীকে নিয়েও একই কাণ্ড ঘটেছিল। অনুরাগীরা নিজেদের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা ছাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ দর্শকের ইচ্ছায় ধারাবাহিকের কমলিনী, স্বতন্ত্রের মতো ‘কাল্পনিক’ চরিত্রকে বাস্তবের সঙ্গে মিশিয়ে ‘পঞ্চব্যঞ্জন’ করে ফেলছে। ফলে কমলিনী জড়িয়ে ধরছে স্বতন্ত্রকে, যা চিত্রনাট্যের বাইরে।

১৮ বছর বয়সে উত্তমকুমার বা প্রিন্সেস ডায়না কেমন দেখতে ছিলেন, সেই ছবিও অনায়াসে বানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে বিছানায় বসেই। তার পরে দর্শক পছন্দমতো ভঙ্গিতে নিজেদের দাঁড় করাচ্ছে সেই ‘অল্পবয়সি’ কাঙ্ক্ষিত তারকাদের পাশে! ভার্চুয়াল কামনা-পূরণের এ এক অভাবনীয় পন্থা!

‘চিরসখা’ ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য নিজেরাই তৈরি করছে দর্শক।

‘চিরসখা’ ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য নিজেরাই তৈরি করছে দর্শক। ছবি: ফেসবুক।

চারদিকে এ নিয়ে আলোচনার ফাঁকেই অনিবার্য ও অস্বস্তিকর প্রশ্নটা উঠছে, অদূর ভবিষ্যতে কি একটা গোটা সিনেমা এআই প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা যাবে? সে দিন কি অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে অন্য শিল্পীরা কর্মহীন হয়ে পড়বেন? কলকাতায় এই প্রযুক্তি নিয়ে কর্মরত এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘না, অত দূর ভাবার সময় আসেনি। এখনও পর্যন্ত এআই প্রযুক্তির যা শক্তি, তা একটা সিনেমা তৈরির কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। বাকিটা মানুষেরই হাতে, যার কোনও বিকল্প নাকি নেই। তবে ভবিষ্যতে কী হবে তা এখনই বলা মুশকিল।’’ ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ নিয়ে কাজ করেন এমন আর এক কর্মীর কথায়, এই প্রযুক্তির সুফল এবং কুফল দুই-ই আছে। তিনি বলেন, ‘‘শুধু বিনোদনজগৎ বা শিল্পের কথা যদি ভাবি, তা হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাড়বাড়ন্ত সত্যিই উদ্বেগজনক। শিল্পীদের ব্যক্তিগত ভাল লাগা না লাগার কোনও গুরুত্বই থাকছে না। আগেও অ্যানিমেটেড ছবি তৈরি হত। সেই প্রযুক্তি একেবারেই আলাদা ছিল। সে ক্ষেত্রে কোনও শিল্পীর অনুমতি ছাড়া তাঁদের কোনও কিছু ব্যবহার করা হত না। এখন অনেকেই অ্যানিমেটেড ছবির সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে গুলিয়ে ফেলছেন। যার ফলে বিষয়টি জটিল হয়ে যাচ্ছে।”

এই হাঁ-মুখ প্রযুক্তি কি তবে বিনোদনজগতের বিস্ময়কে বিপন্ন করে দেবে? রুপোলি পর্দার তারকাদের প্রতি অমোঘ আকর্ষণের দিন কি শেষ হয়ে যাবে? উত্তর নেই।

Bollywood Tollywood
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy