দেখতে দেখতে আবারও বছর ঘুরে চলে এল পুজো। সবার নিশ্চয়ই পুজোয় কী কী করা হবে সেই পরিকল্পনা হয়ে গেছে! এখন শুধু জমিয়ে খাওয়া, আড্ডা, প্যান্ডেল হপিং আর প্রেম। কী! ওরম ভুরু কোঁচকাচ্ছেন কেন? কিছু বাদ দিচ্ছি বলে মনে হচ্ছে? ঠিক ধরেছেন। এই তালিকায় সিনেমা দেখা থাকবে না! বিশেষ করে এ বার পুজোয় ছ’-ছ’টা বাংলা সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু সারা বছর ধরে সিনেমা দেখা গেলেও এই পুজোর সময়ের সিনেমা নিয়ে এত ‘ক্রেজ়’ কেন?
জবাব খুঁজতে গিয়ে এক দিন দেখে নেওয়া গেল ছবিগুলির ট্রেলার। এবং দেখতে দেখতেই মাথায় তৈরি হয়ে গেল একটি সমীকরণ। মনে হতে লাগল, যেন ছ’টা সিনেমা নয়, একই সিনেমার ছ’টা সিকোয়েল দেখলাম। একটাই ‘টেক্স্ট’ বা ‘পাঠ’ তৈরি হচ্ছে ছ’টা সিনেমার মধ্যে দিয়ে। কোথাও গিয়ে এই ‘টেক্স্ট’ই সিনেমা আর পুজোর সিনেমার গোত্র আলাদা করছে না তো?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ অবলম্বনে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে এই পুজোয়। এই লেখাটার সঙ্গে আমাদের অদ্ভুত এক লগ্নতা আছে। আজও আমরা অনেকেই আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী কিনে প্রথমে শীর্ষেন্দুর লেখাটাই আগে পড়ে ফেলি। এর সূত্রপাত কিন্তু আনন্দমেলার পাতায় ১২ কিস্তির ওই ধারাবাহিক উপন্যাস।
আছে ‘ব্যোমকেশ গোত্র’। খুন, সম্পর্কের টানাপড়েন, সন্দেহ, জটিলতা, সঙ্গে রহস্য— সব নিয়ে বড় হওয়াটাকে শরীরে এবং মনে চিনতে শেখায় প্রথম ব্যোমকেশ। প্রেমহীন ফেলুদার সঙ্গে ঘোরা ছেলেরা পায় বাস্তবের প্রেমের স্বাদ, নারীসঙ্গের অনুভূতি ব্যোমকেশের হাত ধরে। সেই ছোঁয়া নিয়েই ‘রক্তের দাগ’ অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমা। আসছে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কাহিনি অবলম্বনে ‘এক যে ছিল রাজা’। এই ছবিরও ক্যানভাস জমিদার পরিবার, সঙ্গে আছে স্বদেশিয়ানার কথা।
এই তিনটে ছবিই স্মৃতিমেদুর বাঙালিয়ানার চালচিত্র। আজকের স্কোয়্যার ফুটে বাঁচা বাঙালির মনে একান্নবর্তী পরিবার ভাঙার যে যন্ত্রণা, সেই ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে যার ভার আজও বাঙালি বয়ে বেড়াচ্ছে বলে মনে হয়, তারই পরশ দিয়ে যায় এই ছবিগুলি। স্মৃতির পাতায় আর একটি নাম কিশোরকুমার। তাঁর এক কণ্ঠীকে নিয়ে আসছে ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’। এ ছাড়াও এ বারে আছে ‘ভিলেন’ আর ‘হইচই আনলিমিটেড’।
আসলে বাঙালির পুজো মানে পারিবারিক সঙ্গ। দুর্গাও তো আসেন সপরিবারে আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে। সেখানে পরিবারকে নিয়ে হই হই করতে করতে সিনেমা দেখতে যাওয়ার রেওয়াজও বহু দিনের। অনেক ভাল বাংলা ছবিই মুক্তি পেয়েছে এই সময়ে। উত্তমকুমারের ইন্দ্রাণী (১৯৫৬), সোনার হরিণ (১৯৫৯), সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘর (১৯৫৮), চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), তরুণ মজুমদারের শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ভালবাসা ভালবাসা (১৯৮৫) থেকে সৃজিতের অটোগ্রাফ (২০১০), বাইশে শ্রাবণ (২০১১), মিশর রহস্য (২০১৩), জ়ুলফিকার (২০১৬)— সবই পুজোর সময়ে মুক্তি পেয়েছে। দেব আর জিৎ তো নিজেরা কথা বলে ঠিক করেন, পুজো না ইদ, কবে কার ছবি মুক্তি পাবে!
এই পুজোয় পরিচালকেরা যেন স্মৃতির আয়না ধরলেন আমাদের সামনে। এক মাপের জিন্সে এঁটে যাওয়া গ্লোবাল বাঙালি তার অতীত, নেপথ্য কাহিনি আর ভুলে যাওয়া স্মৃতির আঁচ পোহাবে আরও একবার। এই বারের বাংলা ‘পুজোর সিনেমা’ তাই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে বাঙালিয়ানার উদ্যাপন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy