স্বাধীনতা উদ্যাপনের মরসুমে এ এক ‘জমি-দখল’-এর লড়াই!
এ যুদ্ধে প্রতিপক্ষরা যে-সে নন। হৃতিক রোশন, অক্ষয় কুমারদের সঙ্গে টক্করে অঞ্জন দত্ত-পরমব্রত কিংবা অরিন্দম শীল-শাশ্বতেরা। আজ, শুক্রবার থেকেই হাতেকলমে যে যুদ্ধের মার্কশিট আসতে শুরু করবে। দক্ষিণ কলকাতার জনপ্রিয় সিনেমা হলের কর্ণধারের গলাটা ক্লান্ত শোনায়, ‘‘ধু-র! এত চেষ্টা করলাম! কাউকেই খুশি করতে পারলাম না!’’
বলিউডের বড় ব্যানারের দুই হেভিওয়েট ছবি ‘মহেঞ্জোদ়ড়ো’ ও ‘রুস্তম’ শুক্রবারই গোটা দেশে রিলিজ করছে। গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্তের কাহিনি ‘ঈগলের চোখ’ এবং শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ অবলম্বনে অঞ্জন দত্তের ‘হেমন্ত’ নিয়ে টালিগঞ্জও মাঠে নামছে একই দিনে। বাংলাদেশের তারকা শাকিব খান ও শ্রাবন্তীর জুটির ‘শিকারি’ও আজই মুক্তি পাচ্ছে।
আপাত ভাবে যুদ্ধটা অসম মনে হতেই পারে। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে আশুতোষ গোয়ারিকরের রোম্যান্স যদি গোটা বাংলায় ১৪০টা প্রেক্ষাগৃহ দখল করে, একদা খুনের দায়ে অভিযুক্ত নৌ অফিসার নানাবতীর বহুচর্চিত সত্য ঘটনা ‘রুস্তম’-এর দৌড় ১০০-র কাছাকাছি হলে। সেখানে টালিগঞ্জের বাণিজ্যিক ছবি ‘শিকারি’ কলকাতায় খুব বেশি পর্দায় নেই। হাতিবাগান, শিয়ালদহ, ধর্মতলা, ভবানীপুর, গড়িয়া, বেহালা, দমদম, বাগুইআটিতে তার বিক্ষিপ্ত উপস্থিতি। তবে গোটা রাজ্যে ১১৭টা হলে মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। আর প্রধানত শহরাঞ্চলের মাল্টিপ্লেক্স-সিনেমা হল নিশানা করছে ‘ঈগলের চোখ’ ও ‘হেমন্ত’। অরিন্দম শীল পরিচালিত শবর-কাহিনি ৫৬টি হল এবং টালিগঞ্জের হ্যামলেট তথা ‘হেমন্ত’ ৪০টি হল থেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে। আগামী সোমবার, স্বাধীনতা দিবসের ছুটি উপলক্ষে এ বারের সপ্তাহান্ত খানিকটা লম্বা। ছুটির বিনোদনের কেকটা কী ভাবে ভাগ হবে, আপাতত তা নিয়েই যুযুধান বিভিন্ন প্রযোজক-শিবির।
এই ভাগাভাগির ফলে কম-বেশি ভুগতে হয়েছে বিভিন্ন হল-মালিককেও। বিস্তর টানাপড়েনের পরে ‘রুস্তম’ ও মহেঞ্জোদড়ো’র মধ্যে একটিকে বাছতে হয়েছে প্রিয়া-র কর্ণধার অরিজিৎ দত্তকে। তবে তাতেও শান্তি নেই! তিনি বলছেন, ‘‘হয় কারও শো-টাইমিং পছন্দ হচ্ছে না! নয়তো আরও বেশি শোয়ের চাহিদা! বাংলা ছবির লোকেরাও পুরোটা খুশি নন।’’ শবর-কাহিনি ও টলিউডি হ্যামলেট নিয়েও টানাপড়েন যথেষ্ট। একটিকে বেছে নিতে হলেও টেনশনে রয়েছেন হাতিবাগানের মিত্রার কর্ণধার দীপেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র। নবীনা-র নবীন চোখানির কথায়, একসঙ্গে অনেকের মধ্যে ছবি বাছাই করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে শাহরুখের দিলওয়ালে ছেড়ে আমরা বাজিরাও মস্তানিকে বেছে নিয়েছিলাম!’’
আইনক্স-এর অন্যতম কর্তা তথা ইন্ডাস্ট্রির বিপণন বিশেষজ্ঞ পঙ্কজ লাডিয়া অবশ্য এই টক্করে টালিগঞ্জের উপরেও যথেষ্ট ভরসা রাখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সাউথ সিটি, কোয়েস্ট মল বা সল্টলেকে ‘ঈগলের চোখ’ ও ‘হেমন্ত’— দুটোই দুপুরে-সন্ধেয় বেশ কয়েকটি শো পেয়েছে। আশা করছি, ভালই করবে।’’ নাগেরবাজারে পিভিআর-এর ডায়মন্ড সিটি-তেও নতুন বাংলা ছবি ভাল গুরুত্ব পাচ্ছে। সরকারি হল নন্দনে শুধুই বাংলা ছবি। সেখানে নতুন দু’টি বাংলা ছবির ভাগেই শো একটি। বেহালার অশোকা-র কর্তা প্রবীর রায়ের আশা, ‘‘ম্যাটিনি ও ইভনিংয়ে দু’টি বাংলা ছবি ঠিকই হলের মুখ রাখবে।’’ তবে লেকটাউনের জয়া-র কর্ণধার মানিক বণিকের কথায়, ‘‘এক সঙ্গে দু’টি বড় ব্যানারের হিন্দি ছবি এসে কেকটা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। না-হলে বাংলা ছবি আর একটু বেশি শো পেতে পারত!’’
তিন বাংলা ছবির প্রযোজক অবশ্য এই কেক ভাগাভাগির তত্ত্বকে আমল দিতে নারাজ। বরং কেক আদতে একটা নয় বলেই তাঁদের দাবি। ‘শিকারি’-র প্রযোজক অশোক ধানুকার কথায়, ‘‘আমার ছবির কলকাতার বাইরেই বেশি চাহিদা! গ্রামবাংলার দর্শকরাই লক্ষ্য। লড়াই হলে ঈগলের চোখ ও হেমন্ত-এর মধ্যে হবে।’’ বছর তিনেক আগে বড়দিনে বিগ বাজেট ‘চাঁদের পাহাড়’-এর মুক্তির সময়ে বাজার ভাগাভাগি ঠেকাতে ‘জাতিস্মর’-এর মুক্তি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বার পরিস্থিতি তেমন নয় বলে দাবি করছেন ‘ঈগলের চোখ’-এর প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর কর্তা মহেন্দ্র সোনি ওরফে মণি। বক্স-অফিসে ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত বাঙালি গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্তের জোরে বাজিমাত করার ব্যাপারে তিনি আত্মবিশ্বাসী। বলিউড এবং বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষার ছবির তুলনায় বাংলা ছবির সিনেমা হল ও দর্শক অবশ্য সীমিত। তাই বেশি ছবির ভিড় হলে টালিগঞ্জে একটা উৎকণ্ঠা সব সময়েই কাজ করে। তবে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও মনে করেন, ‘‘এ যাত্রা ‘হেমন্ত’ ও ‘ঈগলের চোখ’-এর টক্করে কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এর থেকে বেশি ছবির ভিড় হলেই কেকের ভাগে কম পড়ত!’’
‘হেমন্ত’-এর প্রযোজক শ্যামসুন্দর দে মনে করাচ্ছেন, ছুটির মরসুমে নামী-দামি ছবির কেক ভাগাভাগিটাই সাধারণত দস্তুর এ তল্লাটে। তবে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মতে, পুজো-বড়দিন ছাড়া ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে তা যথেষ্ট ঝুঁকির। তাঁর কথায়, ‘‘তখন অনেক বেশি লোক কলকাতায় আসেন। সিনেমা দেখার তাগিদটাও বেশি থাকে। অন্য যে কোনও ছুটিতে সেটা হয় না!’’ পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরও ধারণা, বাংলা ছবির ছোট বাজারে বেশি ভিড় থাকলে, ভাল ছবির পক্ষেও বক্স-অফিসে ধাক্কা দিতে সময় লাগে।
ছবি হিট করানোর যাবতীয় অঙ্ক কষাকষিতেও ছবির বিষয়বস্তুর মহিমা কিন্তু কেউই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বলিউডে ‘পিকু’ বা ভিকি ডোনর’ কিংবা টালিগঞ্জে ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’-এর মতো খানিকটা অন্য ধাঁচের ছবি নির্মাণের পুরোধা সুজিত সরকারও মনে করেন, ‘‘ভাগাভাগি যা-ই হোক! ছবির কনটেন্টই শেষ কথা বলবে!’’
মার্কশিটে কার ভাগে কম-বেশি পড়বে, পরের কথা! ছুটির বিনোদনের খোরাক দিতে একাধিক নতুন বাংলা ছবির উপস্থিতি ইন্ডাস্ট্রির জন্য ইতিবাচক বিজ্ঞাপন হিসেবেই দেখছে টালিগঞ্জ।