এ বার বাঁকুড়ার রানিবাঁধে আত্মঘাতী হলেন এক বুথ স্তরের আধিকারিক (বিএলও)। বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) সংক্রান্ত কাজের চাপের কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি সুইসাইড নোটে! স্কুলের ক্লাসরুম থেকে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়।
স্থানীয় সূত্রে খবর, মৃত বিএলও-র নাম হারাধন মণ্ডল। বাঁকুড়ার রাজাকাটা মাঝেরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। রানিবাঁধের ২০৬ নম্বর বুথের রাজাকাটা এলাকায় বিএলও-র দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন তিনি। ওই বুথের কিছু ভোটারের শুনানিতে ডাক পড়ে। সেই ভোটারদের নথিপত্র জোগাড়ের নাম করে রবিবার বেলা দশটা নাগাদ নিজের বাড়ি থেকে বের হন ওই বিএলও। পরে পরিবারের লোকজন তাঁর খোঁজ করতে করতে স্কুলে হাজির হলে দেখেন স্কুলের একটি ক্লাসরুমের সিলিং ফ্যানে গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁর দেহ ঝুলছে। তাঁর দেহের পাশে একটি সুইসাইড নোট পড়েছিল।
সুইসাইড নোটে এসআইআর সংক্রান্ত কাজের চাপকে দায়ী করে গিয়েছেন ওই বিএলও। লিখেছেন, ‘‘আমি আর চাপ নিতে পারছি না। বিদায়।’’ তার পরের লাইনে হারাধন লেখেন, ‘‘এই বিএলও কাজের জন্য আমিই দায়ী। এর সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। ভুল আমার।’’ তার পরে নিজের পুত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন ওই বিএলও। নোটে তিনি দাবি করেছেন, তাঁর পুত্রকে তিনি কোনও কাজ করতে দেননি। সব কাজ নিজেই করেছেন। হারাধন আরও লেখেন, ‘‘আমি কাউকেই বিশ্বাস করি নাই। সব ঠিক করেও ভুল করলাম। ক্ষমা কর আমাকে।’’
এনুমারেশন ফর্ম বিলি, সংগ্রহের কাজ শেষ। এখন শুরু হয়েছে এসআইআরের দ্বিতীয় পর্বের কাজ। শুনানিপর্ব চলছে রাজ্য জুড়ে। ‘নো ম্যাপিং’ ভোটারদের নোটিস পাঠিয়ে ডেকে পাঠানো, তার পরে তথ্য যাচাই করছে কমিশন। রবিবার শুনানির দ্বিতীয় দিন। সে দিন সকালে আত্মঘাতী হন হারাধন।
মৃতের পরিবারের দাবি হারাধন, এসআইআরের কাজের চাপ নিতে না পেরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তার জেরেই এমন ঘটনা। মৃত বিএলওর ছেলে সোহম মণ্ডল বলেন, ‘‘বাবার শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ছিল। তা সত্বেও রাত ৩টে-৪টে পর্যন্ত এসআইআরের কাজ করতেন। তার পরেও বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ ছিল। বাবা এই মানসিক চাপ নিতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছেন।’’ মৃতের স্ত্রী মালা মণ্ডলের দাবি, ‘‘অসুস্থতার জন্য আমার স্বামীকে রাত ৯ টার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে হত। কিন্তু এসআইআরের কাজের জন্য তাঁকে রাতের পর রাত জাগতে হয়েছে। তার পরেও যাতে কোনওরকম ত্রুটি না হয় সেই চেষ্টা করতেন। কিন্তু কোনও তরফেই কোনও সহযোগিতা পাননি। অবসাদে তাঁকে আজ এই পথ বেছে নিতে হয়েছে।’’
বিএলও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই মৃত্যুর জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছেন। তাঁর দাবি, কমিশন অপরিকল্পিত ভাবে এসআইআরের কাজ করেছে। এসআইআর একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া হতে পারত, কিন্তু কমিশন তা জটিল করে তুলেছে। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক মঙ্গল পান্ডে বলেন, ‘‘বিহারে এসআইআরের কাজ হয়েছে। সেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মোতাবেক বিএলও-রা স্বচ্ছতার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করেছেন। কিন্তু এখানে মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকে এসআইএরের বিরোধিতা করে আসছেন। স্বাভাবিক ভাবে এখানের প্রশাসন ও তৃণমূল নেতৃত্ব বিএলও-দের ভুল কাজ করতে ক্রমাগত চাপে রাখছে। আর তার জেরেই এ ভাবে বেশ কয়েকটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এর সমস্ত দায় রাজ্য সরকার এবং শাসক দল তৃণমূলের।’’
আরও পড়ুন:
এই নিয়ে রাজ্যে পাঁচ বিএলও-র মৃত্যু হল। তবে এসআইআরের এনুমারেশন ফর্ম বিলি, সংগ্রহের সময় বাকি ঘটনাগুলি ঘটেছিল। পশ্চিমবঙ্গে কাজ শুরুর চার দিন পর প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। গত ৯ নভেম্বর ‘কাজের চাপে’ বিএলও-র মৃত্যু হয় পূর্ব বর্ধমানে। মৃতার নাম নমিতা হাঁসদা। পেশায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী নমিতা ৮ নভেম্বর ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। পরিবারের দাবি, এসআইআরের কাজ করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পর দিন কালনা মহকুমা হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এর ১০ দিন পরে জলপাইগুড়িতে এক বিএলও মারা যান। অভিযোগ, কাজের চাপে আত্মঘাতী হন ডুয়ার্সের মাল ব্লকের নিউ গ্লেনকো চা বাগান এলাকার বাসিন্দা শান্তিমুনি ওঁরাও। ৪৮ বছর বয়সি শান্তিও পেশায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ছিলেন। এর পরে ২১ নভেম্বর নদিয়ার কৃষ্ণনগরে আত্মঘাতী হন এক বিএলও। নাম রিঙ্কু তরফদার। ৫১ বছরের ওই বিএলও পেশায় পার্শ্বশিক্ষক ছিলেন। তাঁর দেহের পাশ থেকে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে পুলিশ। তার পরে মুর্শিদাবাদে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান জাকির হোসেন নামে এক বিএলও। এ বার বাঁকুড়ার রানিবাঁধে এক বিএলও-র আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল।