‘অহল্যা’তে রাঘিকা আপ্তে ও টোটা রায় চৌধুরী।
অমিতাভ বচ্চনের মনে হয়েছে ‘ব্রিলিয়ান্ট’। শোভা দে-র মতে ‘মাস্ট সি’। আর ‘পিকু’র পরিচালক সুজিত সরকারের মতে ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি’।
গত সাত দিনে ইউটিউবে ছবিটা দেখেছেন প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ, যা চমকে দিয়েছে গোটা বলিউডকে।
ইয়েস, সুজয় ঘোষ ইজ ব্যাক।
‘কহানি’ রিলিজের তিন বছর পর মাত্র চোদ্দো মিনিটের শর্ট ফিল্ম ‘অহল্যা’ বানিয়ে দুর্দান্ত কামব্যাক করলেন ‘ভিদ্যা বাগচী’র স্রষ্টা।
মুম্বইয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সৌমিত্রর প্রশংসা
হোক না মাত্র চোদ্দো মিনিটের শর্ট ফিল্ম, কিন্তু গোটা ভারতীয় ফিল্ম দুনিয়া যেন এই মুহূর্তে মজে আছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে। দর্শকের পছন্দ হয়েছে টোটা রায় চৌধুরীর স্মার্টনেস এবং রাধিকা আপ্তের লাস্যময়ী অভিনয়।
‘‘আমি অভিভূত। বলতে পারেন চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। এ রকম রিঅ্যাকশন হবে আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। মুম্বইতে রাস্তায় হাঁটলে লোকে আমাকে দাঁড় করিয়ে বলছে তাদের ‘অহল্যা’ কত ভাল লেগেছে! মুম্বইয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সৌমিত্রদার প্রশংসা শুনছি। আমার কাছে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?’’ মঙ্গলবার দুপুরে বলছিলেন সুজয় ঘোষ।
‘অহল্যা’ নিয়ে যে শুধু অমিতাভ বচ্চন, সুজিত সরকারই অভিভূত তা কিন্তু নয়। ‘অহল্যা’তে মজে গোটা বলিউড।
কিন্তু হইচইয়ের পিছনে কি অন্য কোনও কারণ রয়েছে?
‘অহল্যা’ মডেল
ছবি ভাল লাগা যদি প্রথম শর্ত হয়, তা হলে দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই বাণিজ্যিক।
বলিউডের বক্তব্য, একটা বড় বাজেটের ছবি করতে গেলে শুধু প্রচারের জন্য দশ কোটি টাকার কাছাকাছি খরচা করতে হয়। কাগজে কাগজে দিতে হয় বিজ্ঞাপন, ঘুরতে হয় এই শহর থেকে ওই শহর।
সেখানে এই পুরো ‘বিজনেস মডেল’টাই যেন হঠাৎ করে পাল্টে দিয়েছে ‘অহল্যা’। শুধু ইউটিউবেই যে একটা ছবি এত সংখ্যক দর্শক দেখে ফেলতে পারে সেই মডেল’য়ের মধ্যেই ভবিষ্যতের ফিল্ম মার্কেটিংয়ের সম্ভাবনা দেখছে বলিউড।
‘‘ভারতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যে কতটা শক্তিশালী, সেটা প্রমাণ করল ‘অহল্যা’। কোনও প্রচার ছাড়া কী করে ৩৫ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়, সেটা সুজয় দেখিয়ে দিল। ‘অহল্যা’ ক্যান বি আ গেম চেঞ্জার। বহু পরিচালক এবং প্রযোজক এ বার এই ইউটিউব মডেলটা অনুসরণ করবেন,’’ বলছিলেন ট্রেড অ্যানালিস্ট তরণ আদর্শ।
তরণের সঙ্গে একমত পরিচালক সুজয়ও। ‘‘আজকে সবার কাছে স্মার্টফোন রয়েছে। এই মানুষগুলো হলে ছবি দেখে ১২০ টাকা খরচ করত। এ বার আমাদের ফিনান্সিয়াল মডেলটা ঠিক করতে হবে। এই ৩৫ লক্ষ লোকের কাছ থেকে যদি ১০ টাকা করেও নেওয়া যায়, তা হলেই আমরা একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারব,’’ বলছিলেন ‘মহারানী’ কচুরির অন্ধভক্ত পরিচালক।
‘অহল্যা’তে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
রায়বাবু থেকে টুকলে বুক বাজিয়ে বলতেন
তবে অন্য দিকে এত সাফল্যের মধ্যেও বিতর্ক কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
রামায়ণে অহল্যাকে নিয়ে ফিসফাস ছিল। ২০১৫র বলিউডেও তা অব্যাহত। মূলত কলকাতার একটা বড় সংখ্যক দর্শকের ‘অহল্যা’ দেখে মনে হয়েছে, চোদ্দো মিনিটের এই ছবি পরিষ্কার সত্যজিৎ রায়ের গল্প ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ থেকে অনুপ্রাণিত।
অন্য দিকে মুম্বইয়ের একটা বড় অংশ মনে করেন এটি রোয়াল্ড ডালের ‘দ্য ল্যান্ডলেডি’ গল্পের অনুকরণে বানানো।
অনেকে ‘অ্যালমা’ নামের এক শর্ট ফিল্মের ছায়াও দেখছেন ‘অহল্যা’য়। কেউ আবার এটাও বলছেন ‘অহল্যা’, রাম গোপাল বর্মা প্রযোজিত সেই ‘ডরনা মানা হ্যয়’য়ের ছোট গল্পের সমগোত্রীয়, নতুনত্ব কিছুই নেই।
তবে পুতুলের এই মানুষ হয়ে ওঠাকে প্রথম জনপ্রিয় করে ইতালিয়ান লেখক কার্লোস কলোডির ১৮৮১-এ লেখা ‘পিনোচিও’। শিশুসাহিত্যে আজও দুনিয়াখ্যাত সেই গল্প। সে জানিয়েছিল, কামারের হাতে তৈরি খাড়া নাকের পুতুল পিনোচিও কী ভাবে স্কুলে যায়, দুষ্টুমি করে মাস্টারমশাইয়ের কাছে মার খায়। পুতুল তখন মানুষ। সত্তর দশকেও বাংলা শিশুসাহিত্যে, সিএলটি রঙ্গমঞ্চে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল শৈলেন ঘোষের ‘মিতুল
নামে পুতুলটি’।
পুতুল-মানুষ এই যুগলবন্দি, পুতুলের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার উদাহরণ অবশ্য তার আগে সংস্কৃত সাহিত্যেও এসেছে ‘বত্রিশ সিংহাসন’ গল্পে। মহারাজা বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে যে-কেউ বসতে পারে না। কারণ, ৩২টি পুতুল নানা রকম ধাঁধা জিজ্ঞেস করে, গল্প বলে। পুতুল সেখানে অলৌকিক শক্তির প্রতীক। সেই শক্তিমত্তাতেই সে সাধারণ ও অসাধারণ মানুষকে আলাদা করে।
ইউটিউবে ছবি বানানোর টিপস বলছেন সুজয় ঘোষ
লং শট যতটা কম রাখা যায় ততই ভাল। কারণ ছোট স্ক্রিনে মানুষের দেখতে অসুবিধা হয় ‘অহল্যা’তেও আমরা ক্লোজআপের উপরেই জোর দিয়েছি কারণ ওই ছোট স্ক্রিনে মানুষ ক্লোজআপটাই দেখতে চায়
স্মার্টফোনের স্পিকার সে রকম ভাল হয় না, তাই সাউন্ড ডিজাইন নিয়ে বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা না করাই ভাল এডিটিং হতে হবে শার্প
পরে বিভিন্ন সময় এই আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর নানা ভাষায় পুতুল/মানুষ নিয়ে গল্প লেখা হয়েছে। এমনকী অনেকে মনে করেন বিকাশ ভট্টাচার্যের বিখ্যাত ডল সিরিজের পিছনেও রয়েছে কলোডির আইডিয়া। পুরুষশাসিত দাম্পত্যে মেয়েরা কি এই সংসারে পরিণত হয় না খেলার পুতুলে? সাধে ইবসেন তাঁর বিখ্যাত নাটকের নাম রেখেছিলেন ‘এ ডলস্ হাউস’! মার্কিন লেখক স্টিফেন কিং-এর বিখ্যাত গল্প ‘দ্য মাংকি’। একটি বানরের পুতুল যখনই খঞ্জনি বাজায়, কেউ না কেউ মারা যায়। ভেন্ট্রিলোকুইস্ট মিঠুন চক্রবর্তী ও তাঁর কথা বলা পুতুল নন্দনা দেবসেনও গৌতম ঘোষের হাত
ধরে প্রায় দুই দশক আগে বলিউডে পৌঁছে গিয়েছিল।
হলিউডেও পুতুল আর মানুষের সম্পর্ক নিয়ে নানা ছবি তৈরি হয়েছে। স্ট্যানলি কিউব্রিকের গল্প নিয়ে বানানো স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (আইএ)-তেও তার আভাস পাওয়া যায়। এত সাফল্যের মধ্যেও এই সমালোচনা সম্বন্ধে কী বলছেন সুজয়?
‘‘শুধু এগুলো নয়। কেউ বলছে আমি ‘চাইল্ডস প্লে’ থেকে টুকেছি। কেউ বলছে ‘হানি আই শ্রাঙ্ক দ্য কিডস’ থেকে গল্পটা নিয়েছি। আবার কেউ বলছে রায়বাবু থেকে। এদের বোঝাতে পারছি না রায়বাবু থেকে যদি টুকতাম গল্পটা, তা হলে আমি বুক বাজিয়ে সেটা সবাইকে বলতাম। আমার কাছে রায়বাবুই সব। আমার স্কুলের প্রিন্সিপাল, হেডমাস্টার একজনই— সত্যজিৎ রায়। তাই
তাঁর গল্প থেকে টুকলে সেটা স্বীকার করব না, এটা হতে পারে নাকি!’’ স্পষ্ট জবাব সুজয়ের।
পতন না উন্নতি
বিশেষ কোনও ছবির অনুপ্রেরণা যদি একটা দিক হয়, ‘অহল্যা’ নিয়ে আরও একটা সমালোচনা প্রথম দিন থেকে দানা বাঁধছে।
অনেকেই মনে করছেন বক্স অফিসে ১০০ কোটির বেশি কামানো ‘কহানি’র তিন বছর পর চোদ্দো মিনিটের ‘অহল্যা’ বানানো সুজয় ঘোষের ‘ক্লাইম্ব ডাউন’। কোথাও অবতরণ। তিনি নিজেও কি তা মনে করেন?
‘‘যাঁরা মনে করছেন এটা ‘ক্লাইম্ব ডাউন’, তাঁদের ভাবনায় কিন্তু যথেষ্ট যুক্তি আছে। আমি কেন ‘কহানি’র পর এখনও একটা ফুল লেংথ ছবি বানাইনি তার পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটুকু বলব, ‘অহল্যা’ কিন্তু আমাকে একটা পুরো ছবির খ্যাতি দিয়ে গেল। আর এটাও বুঝলাম, মানুষ এখনও আমাকে কতটা ভালবাসে,’’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলেন সুজয়।
‘কহানি’র পর এটা যে কোনও অংশেই নেমে যাওয়া নয়, এমনটা মনে করেন সুজিত সরকারও।
‘‘কেন নেমে যাওয়া হবে? একটা ফিল্ম মেকারের কাজ ছবি বানিয়ে যাওয়া। সেটা তিন ঘণ্টারও হতে পারে, পাঁচ মিনিটেরও হতে পারে। আই থিঙ্ক, সুজয় হ্যাজ ডান আ গ্রেট জব,’’ মেয়েকে স্কুলে ছেড়ে আসার ফাঁকে বললেন সুজিত।
সব মিলিয়ে ‘অহল্যা’ নিয়ে
চারধারে যে একটা স্পষ্ট মেরুকরণ রয়েছে, সেটা পরিষ্কার। এ বিষয়ে শেষ কথাটা বলছেন বোধ হয় স্বয়ং পরিচালকই।
‘‘প্রত্যেকটা শিল্প নিয়ে এ রকম মেরুকরণ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সেটা দেখে ভাল লাগছে। আর একটা কথা বলব, ‘অহল্যা’ দেখিয়ে দিল আজকের দুনিয়ায় ভাষাটা
আর কোনও বাধা নয়, ভৌগোলিক দূরত্বও কোনও বাধা নয়। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে যে স্কাই ইজ দ্য লিমিট, সেটা বোধ হয় আবার বোঝা গেল। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি,’’ বললেন সুজয়।
সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি, ২০১৫তেও ‘অহল্যা’ যে ‘বছরের বিস্ময়’ সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তবে তার থেকেও বড় স্টোরি সুজয় ঘোষের কামব্যাক।
হ্যাঁ, সুজয় ফিরেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy