আচমকাই চারপাশের চিত্রটা কেমন যেন বদলে গিয়েছে। কয়েকটি ঘণ্টা আচমকাই যেন লন্ডভন্ড করে দিয়েছে চেনা চৌহদ্দি। বিপদ যে আসবে সেটা আঁচ করেছিলেন সবাই। কিন্তু তার যে এই রকম রূদ্ররূপ হতে পারে ধারণা করতে পারেননি সেলেব থেকে সাধারণ। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৭২। গৃহহীন বহু মানুষ। খাবার জলটুকু পর্যন্ত জোগাড় করতে পারছেন না অনেকেই। করোনা এসে কোমর ভেঙে দিয়েছিল, আর আমপান যেন ঘুরে দাঁড়ানোর আশাটুকুকেও নিঃস্ব করে বিলীন হয়ে গেল।
এরই মধ্যে জাতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মনে। সৃজিতের বাড়িতে খাওয়ার জল নেই কাল থেকেই। না, আমপান হয়তো গৃহহীন করতে পারেনি তাঁকে, কিন্তু ক্ষতির মুখে তিনিও। খানিকটা বক্রোক্তি মিশিয়েই সৃজিতের পোস্ট, “সোশ্যাল মিডিয়ায় #প্রেফরইন্ডিয়া যখন এক নম্বরে ট্রেন্ডিং তখন জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলির আমপান নিয়ে কভারেজ দেখে আমি অভিভূত। ‘ক্যাল-কাটা এবং ‘বাঙ্গাল’ ‘রসোগোল্লায়েড’ এবং ‘হামি তুমাকে ভালবাসি’-তেই আটকে রয়েছে তাদের কাছে। ওহ, জাতীয় সঙ্গীতটা কিন্তু বাংলাতেই, সেটা আপনারা রেখে দিতে পারেন।’’
বুধবার বিকেল থেকেই ফেসবুকে আমপান নিয়ে একের পর এক আপডেট দিতে থাকছিলেন অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ। বাড়ির সামনে মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ছে গাছ। বাড়ির আলো দপদপ করছিল। চারপাশে হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল। ঘড়ির কাঁটায় রাত ৮টা বাজল। ভেসে এল রুদ্রর পোস্ট, “অসুখ দিলেন। জীবন-জীবিকা-প্রাণ সব কেড়ে নিলেন। শেষে আজ নিরপরাধ গরিবের আশ্রয়টুকুও! এ কেমন পরীক্ষা।” হাওয়া যে এত নৃশংস হতে পারে সে ধারণা কি আমি আপনি কেউ-ই করতে পেরেছিলাম? “হাওয়া কাড়ল সব, হাওয়ায় কাড়ল ভবিষ্যৎ, হাওয়ায় হাওয়ায় শব”, লিখেছেন রুদ্র। ভাইরাস বয়ে বেড়ায় কাল রাতের পর থেকে বয়ে বেড়াচ্ছে মৃতদেহের গন্ধ, হাহাকার, আর্তনাদ।
আরও পড়ুন: আমপানে তছনছ বাংলা, মৃত অন্তত ৭২, ‘এসে দেখে যান’, মোদীকে বললেন মমতা
ভয়ঙ্কর এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সমাজের সব তলার মানুষ। সেলেবরাও রয়েছেন এই তালিকায়। হয়তো নিরাশ্রয় হননি তাঁরা। কিন্তু কারও বাড়ির জানলা ভেঙে গিয়েছে। কেউ বা আবার পড়েছেন প্রবল জলকষ্টের মধ্যে। অভিনেত্রী জয়া আহসান এই মুহূর্তে বাংলাদেশে। আমপান আসছে শোনার পর থেকেই দু’ চোখের পাতা এক করতে পারেননি তিনি। তাঁর নিজের দেশ, আর তাঁর আর এক প্রিয় দেশ... দুই দেশই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা তিনি জানতেন। প্রার্থনা করছিলেন। কিন্তু ওই যে, “এ সময় ভগবানও বোধহয় কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোন।” আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তান্ডব চালিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে আর এক প্রস্থ নিজের রূপ দেখাবে সে। তা হয়নি। বুক চিতিয়ে আমপানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে বাংলা। ম্যানগ্রোভ অরণ্য রুখে দিয়েছে তার বাংলাদেশ ভ্রমণ। ক্ষতি হয়েছে ওপারেও তবে শেষ হয়ে গিয়েছে দক্ষিণবঙ্গ। “পশ্চিমবঙ্গ তো মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ভয়ানক কোনও দৈত্যের পায়ের তলায় মিশে গিয়েছে”, বলছিলেন জয়া।
গত রাতের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না অভিনেত্রী রুক্মিণী মৈত্রও। “আমরা সহায়হীন ছিলাম। কিছুই করার ছিল না”, বলছেন রুক্মিণী। অভিনেতা এবং সাংসদ দেবের দেশের বাড়ি ঘাটালে। দুই মেদিনীপুরেই হামলা চালিয়েছে আমপান। এমন বিপর্যয় যে আগে কখনও দেখেনি পশ্চিমবঙ্গ সে কথা মাথায় রেখেই দেব বলছেন, “রাজনীতি করার সময় নয় আজ, মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখিনি।”
আরও পড়ুন: আমপানের তুমুল তাণ্ডবে লন্ডভন্ড নানা জেলা, কোথায় কতটা ক্ষতি দেখে নিন
গতকাল বিদ্যুৎ ছিল না বেশির ভাগ বাড়িতেই। কোথাও তার ছিঁড়ে গিয়েছিল, কোথাও আবার ইলেকট্রিক অফিস থেকে সুরক্ষার জন্য আগেভাগেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। অন্ধকারে নিজের বাড়িটাকেই মনে হচ্ছিল দৈত্যপুরী। জীবনে প্রথম বার নিজের বাড়িতে বসে প্রাণভয়ে কেঁপেছেন বিদীপ্তা চক্রবর্তী। হাওয়ার দাপটে কাচের জানলা বার বার খুলে গিয়ে জলে ভিজিয়ে দিয়েছে সারা বাড়ি। বেলচা দিয়ে কাচিয়ে সেগুলো বাইরে ফেলেছেন তিনি? বিদিপ্তা লিখছেন, “যে মুহূর্তে জল ফেলছি, ঠিক তখনই যে কত মানুষের মাথায় উপর ছাদটুকু উড়ে যাচ্ছে, দেওয়াল ভেঙে পড়ছে, সে ছবিটা কল্পনা করতেই শিউরে উঠছিলাম।” ভেঙে গিয়েছে অঙ্কুশ হাজরার বাড়ির জানলাও। খসে গিয়েছে ফলস সিলিং।
বাংলার এই চরম দুর্দশায় যখন জাতীয় সংবাদমাধ্যম প্রায় চুপ তখন মুখ খুলেছেন কর্ণ জোহর। বাংলার জন্য প্রার্থনা করে পোস্ট করেছেন তিনি। টিভির পর্দায় ভয়ঙ্কর ছবি দেখে শুকিয়ে গিয়েছে শাবানা আজমির বুক। অর্জুন কপূরের তরফ থেকেও উড়ে এসেছে সমবেদনা। বিরাট কোহালি লিখেছেন #প্রেফরওয়েস্টবেঙ্গল।
গিয়েছে সবই। কোভিড কেড়েছিল খাবার। আমপান কাড়ল আশ্রয়। তবু ঘুরে দাঁড়ানোয় আশায় বাংলার মানুষ। সেলেবরাও আশ্বাস জোগাচ্ছেন পাশে দাঁড়িয়ে। দেব-রুক্মিণী-জয়া সবাই এক সুরে বলছেন এ লড়াই জিততেই হবে আমাদের।