Advertisement
E-Paper

মেয়েদের সংগ্রামের ইতিহাস ফিরে দেখল ছবির উৎসব

রাজধানী মস্কোয় নয়, ডন নদীর উর্বর অববাহিকা অঞ্চলে নোভেচারকাসাস্ক শহরের কারখানায় শ্রমিকেরা হরতাল ডাকেন।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৫০
‘ডিয়ার কমরেডস’ ছবির একটি দৃশ্য।

‘ডিয়ার কমরেডস’ ছবির একটি দৃশ্য।

মা দলের রাজ্যনেত্রী। মেয়ের বেয়াড়া প্রশ্নে এক দিন ঠাটিয়ে থাপ্পড় মেরেছিলেন তাকে। আজ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তিনি হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন। মা বোঝেন, এক প্রজন্মে সব প্রশ্ন শেষ হয়ে যায় না। প্রতিটি প্রজন্ম তার মতো প্রশ্ন করে এবং নিজেই উত্তর খুঁজে নেয়।

এ ভাবেই শেষ হয় ৮৩ বছর বয়সি রুশ পরিচালক কনচালস্কির নতুন ছবি ‘ডিয়ার কমরেডস’। ১৯৬২ সালে ক্রুশ্চেভের আমল নিয়ে ছবি। খাবারের দাম বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে। রাজধানী মস্কোয় নয়, ডন নদীর উর্বর অববাহিকা অঞ্চলে নোভেচারকাসাস্ক শহরের কারখানায় শ্রমিকেরা হরতাল ডাকেন। তরুণরাও বিদ্রোহে যোগ দেন।

কমিউনিস্ট দেশে শ্রমিকদের প্রতিবাদ? এই প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসপন্থী কারা? কেজিবি এবং স্থানীয় পার্টি নেতারা বৈঠকে বসেন। প্রচুর যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির ফানুস ওড়ে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী আন্দোলনরত ভুখা শ্রমিকদের উপরে গুলি চালায়। জনা কুড়ি লোকের মৃত্যু হয়। লাশগুলিকে গোপনে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। সোভিয়েতের পতনের পরে লেখ্যাগারে রাখা কেজিবি-র পুরনো নথিপত্র থেকে গণহত্যার ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে।

সেই ঘটনাই প্রবীণ পরিচালকের উপজীব্য। কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী মা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দেখেছেন, খাবারের অগ্নিমূল্য নিয়ে তিনিও চিন্তিত। দলের নেতা আশ্বাস দেন, ‘‘চিন্তার কিছু নেই। মস্কোয় কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা বলেছেন, অচিরেই জীবনধারণের মান বাড়বে।’’ মা-ও ভাবেন, ভবিষ্যতের খাতিরে এই ক্ষণস্থায়ী কষ্টটি মেনে নিতে হবে।

কিন্তু মেয়ে ও তার বন্ধুরা সে সব মানতে নারাজ। মেয়ে সরাসরি মাকে প্রশ্ন করে, ‘‘স্তালিন যদি এতই খারাপ হবেন, তা হলে ক্রুশ্চেভ আগে কিছু বলেননি কেন? তোমরাই বা মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলে কেন?’’ তার পরেই মেয়েকে মায়ের ঠাটিয়ে চড়।

গুলি চালানোর নির্দেশ কার ছিল, সঙ্গত ভাবেই সিনেমা তা দেখায়নি। শ্রমিকেরা ভাবেন, দেশের সরকার আর যা-ই হোক, গুলি চালাবে না। নিজেদের বৈঠকে কেজিবি-র বক্তব্য আবার অন্য। ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার আর বন্দুকহীন সৈন্য দিয়ে কী লাভ! ফলে গুলি চালানোর নির্দেশ মস্কো না অন্য কোথা থেকে এসেছিল, সে ব্যাপারে ইতিহাস আজও নীরব। এক দেশ, এক সরকার, এক আইনের ভয়াবহতা রাশিয়া জানে।

এই উৎসবেই দেখা গেল ইউক্রেনের ছবি ‘ব্লাইন্ডফোল্ড’। নায়িকা বক্সিং লড়েন, তাঁর প্রেমিক যুদ্ধে নিখোঁজ। বয়ফ্রেন্ডের মায়ের বিশ্বাস, তাঁর ছেলে বেঁচে আছেন। সেই ধারণা তিনি এই মেয়েটির ঘাড়ে সস্নেহে চাপিয়ে দিতে চান। প্রৌঢ়া হবু শাশুড়ি যে মানুষটা খারাপ, এমন নয়। রোজ মেয়েটির জন্য দুধ নিয়ে আসেন। কোচ বলেন, জিততে হবে। সমাজ বলে, নিখোঁজ বয়ফ্রেন্ডের স্মৃতি নিয়ে থাকতে হবে। হবু শাশুড়ি বলেন, তাঁর ছেলে জীবিত। কত জনের কত আকাঙ্ক্ষার চাপ যে ইউক্রেনের মেয়েটিকে সামলাতে হয়!

মেয়েদের দায়িত্বের চাপ কি আজকের? এই উৎসবেই দেখা গেল ইতালির ছবি ‘মিস মার্ক্স’। কার্ল মার্ক্সের মেয়ে ইলিয়ানর মার্ক্সকে নিয়ে ছবি। সাম্যবাদী আন্দোলন ও নারী স্বাধীনতাকে একত্রে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন যে মেয়ে। ছবিতে এক জায়গায় ইলিয়ানর বক্তৃতা দেন, ‘‘আমার বাবা চাইতেন, শ্রমিক আন্দোলনের মতো নারী-পুরুষে সমান অধিকার।’’ মার্ক্সের সব চেয়ে প্রিয় সন্তান। ছোটবেলায় বাবা লন্ডনে যখন ‘দাস ক্যাপিটাল’ লিখছেন, তাঁকে নানা গল্প বলতেন। সাহিত্যপ্রেমী বাবার প্রভাবেই পরে ইলিয়ানর ফ্লবেয়ার, মাদাম বোভারি অনেক কিছু অনুবাদ করেন। বাবার লেখা ‘দাস ক্যাপিটাল’-এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদও তাঁর।

কিন্তু জীবনের ট্র্যাজেডি? একটা সময়ে ইলিয়ানর জানতে পারেন, এঙ্গেলসের পোষ্যপুত্র ফ্রেডি আসলে তাঁর ভাই। তাঁর বাবা কার্ল মার্ক্সই ফ্রেডির জন্মদাতা।

আর স্বামী? বাবার প্রাথমিক অমত অস্বীকার করে সহযোদ্ধা এডওয়ার্ড আভেংলিংয়ের সঙ্গে একত্রবাস। অ্যালেক নেলসন ছদ্মনামে লেখালেখিও করতেন তিনি। ইলিয়ানর এক দিন জানতে পারেন, আভেংলিং গোপনে এক অভিনেত্রীকে বিয়ে করেছেন। অতঃপর বিষ খেয়ে মৃত্যু। বাবা ও স্বামী, দু’জনের গোপন যৌনাচার কি ছায়া ফেলেছিল তাঁর মনে?

এই বেদনা খুঁড়ে কী হবে? ছবিতে এক জায়গায় পশ্চাৎপটে আমেরিকার পাঙ্ক ব্যান্ড ‘ডাউনটাউন বয়েজ়’-এর গান, পর্দায় উন্মাদের মতো নাচছেন ইলিয়ানর। ‘‘মেয়েদের জীবনের প্রশ্নটা শাসকের প্রেক্ষিতে দেখতে হবে। এটা পুরুষের বিরুদ্ধে আমাদের শ্রেণিযুদ্ধ নয়। শোষকের বিরুদ্ধে শ্রমিকের যুদ্ধ,’’ একদা বলেছিলেন তিনি।

ছবিটার বৈশিষ্ট এখানেই। ইলিয়ানরের নাচ আসলে সংগ্রামের উদ্যাপন। অজস্র প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে সংগ্রাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এগিয়ে চলে। মেয়ে এবং মা, সেখানেই পরস্পরকে জড়িয়ে কাঁদেন।

Dear Comrades Kolkata International Film Festival KIFF
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy