Advertisement
E-Paper

অসুখে ঘাড় বেঁকে যায়, নড়বড়ে হাঁটা, কঠিন লড়াইয়ে সেই আজ সিনেমার হিরো

আমার মাথার মধ্যে একটা বানানো দুনিয়া আছে। সেখানে ভয়ানক সব ভিলেনরা থাকে। আমি ওই ভিলেনদের খতম করি আমার মাথার মধ্যে একটা বানানো দুনিয়া আছে। সেখানে ভয়ানক সব ভিলেনরা থাকে। আমি ওই ভিলেনদের খতম করি

অন্তরা মজুমদার

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৮ ০০:০০
মহাব্রত। ছবি: দেবর্ষি সরকার

মহাব্রত। ছবি: দেবর্ষি সরকার

ছেলেটা ছোটবেলায় সেপ্টিসেমিয়ার শিকার হয়েছিল। ঘাড় সোজা করতে পারত না। নড়বড়ে হাঁটত। যখন আর একটু বড়, এক দুপুরে তার মা পাশের ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে গিয়ে উঁকি মেরে দেখেন, ঘরময় জিনিসপত্র ছত্রখান। তার মধ্য দিয়ে খুব সাবধানে, সামলে সামলে হাঁটার চেষ্টা করছে সেই ছেলে। যাতে কোনও জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা না লাগে। যাতে আর নড়বড়ে না থাকে তার হাঁটাচলা...

সিনেমার মতো, না? এ রকমই তো হয় সিনেমায়! কিন্তু এটা গল্প নয়। বাস্তব। কঠিন বাস্তব। যেখানে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে ধরে তুলে দেওয়ার লোক হয়তো আছে। কিন্তু লড়াইটা নিজের সঙ্গেই। সেটা খুব ছোট বয়সেই শিখে গিয়েছিল ছেলেটা। মহাব্রত বসু তার নাম। পাঠভবনে, ক্লাস সেভেনের ছাত্র।

এক সময় ভাল করে হাঁটতে, কথা বলতে পারত না ঠিকই। কিন্তু এখন একটা বাংলা ছবির নায়ক সে-ই। সৌকর্য ঘোষালের ‘রেনবো জেলি’তে মহাব্রতই মূল চরিত্র। ‘‘আমাদের ছবির গল্পটা এক স্পেশ্যাল চাইল্ডকে নিয়ে। তার নাম ঘোঁতন। গল্পটা রূপকথার। ফুড ফ্যান্টাসিও বলতে পারেন। কিন্তু ছবিটা করতে করতে মনে হয়েছিল, গল্পটা মহাব্রতরও। ও-ই আসল ঘোঁতন। কারণ ছবির ঘোঁতনের মতো ও-ও একটা জিতে যাওয়ারই গল্প বলে,’’ বলছিলেন সৌকর্য। কেন? শুটিংয়ের আগে তিন মাসের দীর্ঘ ওয়র্কশপের পর ক্যামেরার সামনে যে মহাব্রতকে পরিচালক দেখেছিলেন, সে অন্য মহাব্রত। ক্যামেরার সামনে যার টানা সংলাপ বলায়, অভিব্যক্তি প্রকাশে অসুবিধে হয় না। সৌকর্যের কথায়, ‘‘ওয়র্কশপে যে এতটা কাজ দেবে, আমরাও ভাবিনি। ওকে স্মাইলি এঁকে এঁকে অভিব্যক্তি বুঝিয়েছিলাম। স্পুন-মার্বেল এক্সারসাইজ় করিয়েছিলাম মনঃস‌ংযোগ বাড়ানোর জন্য। ক্যামেরার সঙ্গে ওকে অভ্যস্ত করানোও হয়েছিল।’’ তিন মাস পরের মহাব্রত আরও বড় চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন আর কোনও সমস্যাই তার কাছে সমস্যা নয়। না সংলাপ মনে রাখায়, না সংলাপ বলায়। হাঁটা-চলাফেরাতেও সপ্রতিভ মহাব্রত।

সৌকর্য জানালেন, বেশির ভাগ শটই ওয়ান টেকে ওকে করে দিয়েছিল মহাব্রত। কারণ চিত্রনাট্যের সবটাই ওর আত্মস্থ হয়ে গিয়েছিল। ‘‘ঠিক বাঁধা গতে মুখস্থ করতে পারে না। ওর মুখস্থটা পুরোটাই শ্রুতিনির্ভর। ওর মা গোটা স্ক্রিপ্ট ওকে পড়ে শোনাতেন। রোজ। ওই করে করেই আত্মস্থ করেছিল গল্পটা।’’ ছবিতে মহাব্রতর সঙ্গে কাজ করেছেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, কৌশিক সেন। শ্রীলেখা বললেন, ‘‘আমাদের সকলের চেয়ে সবচেয়ে বেশি তৈরি ছিল মহাব্রত। কেউ লাইন ভুলে গেলে ও-ই মনে করাত। আমার তো মনে হয় মহাব্রত ওয়ান্ডার চাইল্ড!’’

কিন্তু সিনেমার হিরো হতে পেরে খুব কিছু আলাদা মনে হচ্ছে না মহাব্রতর। ‘‘আমার এগুলো খুব ভাল লাগে, এমন নয়। কেন লাগে না, বলতে পারব না। কিন্তু আমার ছবি খবরের কাগজে বেরোলে বন্ধুরা ক্লাস টিচারকে দেখিয়ে বলে, মিস দেখুন, মহাব্রতর ছবি বেরিয়েছে কাগজে! মিস আবার ওদের বলেন, তোমাদের আগেই আমি দেখে নিয়েছি, এ বার জায়গায় গিয়ে বসো,’’ ঝলমলে হেসে বলে মহাব্রত। এই হাসিটাই মুগ্ধ করেছিল পরিচালককে। ওই উইনিং স্মাইল... ঠিক চিনে নিয়েছিলেন, ওটা সংক্রামক। যে দেখে, তারও জিতে যেতে ইচ্ছে করে!

মহাব্রত কিন্তু নিজেই নিজের হিরো। ‘‘আমার মাথার মধ্যে একটা বানানো দুনিয়া আছে। সেখানে ভয়ানক সব ভিলেনরা থাকে। ব্রেনের হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে বললে, আমি গিয়ে ওই ভিলেনদের খতম করে আসি!’’ গল্প করে বলে সে। তার নিজের কোনও প্রিয় সুপারহিরো রয়েছে নাকি? ‘‘আয়রনম্যান। আসলে টোনি স্টার্ক লোকটাকেই আমার দারুণ লাগে!’’ মন্তব্য তার। মহাব্রত ‘অ্যাভেঞ্জার্স’ দেখে, ‘পথের পাঁচালী’ও। কিন্তু বড় হয়ে কী হতে চায়? উত্তরে গালভরা হাসি, ‘‘আগে বড় তো হই...’’

খেতে ভালবাসে ছবির ঘোঁতন। তাই নিয়ে সেটে বিপত্তিও কম হয়নি! সৌকর্য বলছিলেন, ‘‘একটা দৃশ্য রয়েছে, যেখানে শান্তিলালের সঙ্গে ডিম-পাউরুটি খেতে খেতে কথা বলছে ঘোঁতন। তিন প্লেট ডিম-পাউরুটি এনে রা‌খা হয়েছিল। রিহার্সালেই এক প্লেট শেষ করে দিল! ওই সিকোয়েন্সটা পুরো শুট হওয়ার আগে বাকি দু’প্লেটও সাবাড়! তার পর রাত ন’টায় কালীঘাটের মোড় থেকে আবার ডিম-পাউরুটি ভাজিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল!’’ খাওয়াদাওয়া নিয়ে মজার গল্প ঘোঁতনের ঝুলিতেও কম নেই। ‘‘এক দিন শুটিংয়ে গিয়ে দেখি, আমাকে দাদা (সৌকর্য) অনেক কিছু খেতে দিয়েছে। মাছ-মাংস-ডিম! আমি তো সব খেয়ে নিলাম। তার পর দাদা বলে, বমি করতে হবে! বুঝলাম, এ বার বমির সিন করতে হবে। কিন্তু বমি তো কিছুতেই হচ্ছে না। সেটের এক জন বলল, নুনজল খেতে। দাদা এক বোতল নুনজল দিল আমায়। কিন্তু ওটাও হজম করে ঢেকুর তুলে দিলাম! তার পর এক বোতল জল চাইলাম ওদের থেকে। পুরোটা ঢকঢক করে খেতেই মনে হল, সব বেরিয়ে আসবে! সঙ্গে সঙ্গে বললাম, শট রেডি করো। কথা শেষ করতে না করতেই বমি! এক শটে ওকে,’’ গর্বের হাসি মহাব্রতর মুখে।

বন্ধুদের ‘রেনবো জেলি’ দেখাতে চায় ঘোঁতন? ‘‘নাহ। ইচ্ছে হলে টিকিট কেটে দেখবে,’’ সোজা উত্তর তার। টেনশন হচ্ছে না? সামনেই তো ছবির রিলিজ়! ‘‘আমার টেনশন হবে কেন?’’ মুচকি হাসি। তা হলে কি সব টেনশন ‘দাদা’র? ‘‘হুঁ,’’ হাসতে হাসতে ঘাড় নাড়ে মহাব্রত।

Celebrity Interview Mahabrata Basu Rainbow Jelly Autistic Child Autism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy