বাইরে ‘কমলালেবু’ রোদ। ভিতরে সারি দিয়ে সাজানো বেঞ্চ। হাতের খাতায় উপুড় একদল ছেলেমেয়ে! একই বেঞ্চে বসে তাঁদের ‘স্যর’ পরিচালক সুকমল নাথ! পড়া বোঝাচ্ছেন তিনি। দাসানি ২ স্টুডিয়োয় ‘ক্লাস’ হয় নাকি? পায়ে পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গম্ভীর মুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘প্রফেসর বিদ্যা ব্যানার্জি’ ওরফে স্বস্তিকা দত্ত।
প্রশ্ন: নায়িকা কখনও শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলেন?
স্বস্তিকা: ছেলেবেলায় চেয়েছিলাম (হাসি)। ঠাকুমার ওড়না জড়িয়ে আমি দিদিমণি। বালিশগুলো ছাত্র। ওরা তো কথা বলতে পারে না। তাই সপাসপ স্কেলের বাড়ি খেত! ছোট থেকে যা যা স্বপ্ন দেখেছি, আস্তে আস্তে পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: ‘প্রফেসর বিদ্যা ব্যানার্জি’ তো অসভ্যতা দেখলেই সপাট চড় মারেন!
স্বস্তিকা: বাস্তবে স্বস্তিকার মুখ ছোটে, হাত ওঠে না! এদিকে চিত্রনাট্য মেনে আমায় সৎ ভাইকে মারতে হবে। দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হওয়ার পরে সৌমক বসুর গালে সমানে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর অঝোরে কাঁদছি!
প্রশ্ন: তিন বছর পরে ছোটপর্দায় ফিরে ধারাবাহিকের মলাট চরিত্র! বিরতি নেওয়া সার্থক?
স্বস্তিকা: (হেসে ফেলে) স্নেহাশিস চক্রবর্তীর ঘরে আট বছর পরে প্রত্যাবর্তন, সেটা যোগ করুন! সামান্য কারণে মনোমালিন্য। কিছু একটা কড়া কথা বলেছিলাম দাদাকে। সেই যে দাদা গায়েব, কোথাও পাই না তাঁকে। আট বছর পরে আচমকা মুখোমুখি। বিশ্বাস করুন, কাজ চাইতে নয়। নানা কথার পর দাদা বললেন, “ফিরবি?” ওঁর অনুরোধ কেউ ফেরায়। আমিও রাজি (সাউথ কটন শাড়ির আঁচল গোছাতে গোছাতে বললেন)। আমার নামে ধারাবাহিকের নাম হবে, অনেক দিনের স্বপ্ন। সেটাও পূরণ হয়ে গেল।
প্রশ্ন: বিরতি নিয়েছিলেন কেন?
স্বস্তিকা: আমার মতে, টানা অভিনয়ের পর অভিনেতাদের একটু বিরতি নেওয়া উচিত। সেই সময়ে ছবিতে, সিরিজ়ে কাজ করেছি। নানা রকমের বই পড়েছি। পরিবারকে সময় দিয়েছি। নিজেকে আরও তৈরি করছি। এসবেরও প্রয়োজন আছে। ভাঙা প্রেম জুড়তে বা ব্রেকআপের জন্য বিরতি নিইনি, এটা সত্যি।
প্রশ্ন: বিরতি নিয়ে ফিরে দেখলেন সব বদলে গিয়েছে?
স্বস্তিকা: আমার বেলায় ঘুম থেকে ওঠা বদলে গিয়েছে। এখন অনেক তাড়াতাড়ি উঠতে হয় । এর থেকে বড় বদল আর হয়? (জোরে হাসি)। প্রযোজনা সংস্থার নিয়মনীতি আরও কড়া হয়েছে। আমি শাড়ি পরে, চুল বাঁধার পর থেকে প্যাকআপ পর্যন্ত ‘বিদ্যা ব্যানার্জি’ হয়ে থাকছি। জানেন, এই সেটেই তিন বছর আগে শুভঙ্কর সাহার সঙ্গে ‘তোমার খোলা হাওয়ায়’-এর শুট করেছি (চোখ বুজে ভাবতে ভাবতে বললেন।)
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির কী কী বদলাল?
স্বস্তিকা: (সতর্ক গলায়) ও বাবা! অদলবদল প্রচুর। ভাল বিষয়ের অভাব ঘটেছে। এখন ইন্ডাস্ট্রি ভীষণ ‘আমি’সর্বস্ব! আগের মতো করে খুব কম ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার হয়। টিমওয়ার্ক কমে গিয়েছে। যিনি আমার মেকআপের ব্যাগটা বয়ে আনেন, তিনিও ধারাবাহিকের টিমের সদস্য। আমরা মনে রাখতে ভুলে গিয়েছি। তাই ধারাবাহিকও বেশি দিন চলে না। এ বিষয়ে একটা উদাহরণ দিই। স্নেহাশিস চক্রবর্তী এনটি১ স্টুডিয়োর একটি ছোট্ট ঘরে বসে রোজ স্ক্রিপ্ট লিখতেন আর ছিঁড়তেন। এ ভাবেই নিজেকে ঘষেমেজে এই জায়গায় উঠে এসেছেন। নিজের সঙ্গে বাকিদের তুলে এনেছেন। শুধু নিজের কথা ভাবলে এত লোকের অন্নসংস্থানের দায়িত্ব নিতে পারতেন না। আর একটা কথা বলব?
প্রশ্ন: অবশ্যই বলুন...
স্বস্তিকা: অনেকে বলেন, স্নেহাশিস চক্রবর্তী খুব ‘অয়েলিং’ পছন্দ করেন! আসলে দাদা আগলে রাখতে পছন্দ করেন। দাদা ‘রেসপেক্ট’ পছন্দ করেন। পরিচালক সুকমলদার দাবি, ওঁর সিরিয়াল তো বিয়ের থেকেও বেশি টেকে! ইদানীং বিয়ের বয়স দু’বছর হলেই লোকে ভাবে, অনেক দিন বিয়ে টিকল! দাদার ধারাবাহিক সাড়ে তিন বছরও চলেছে। যিনি এত দেন, বদলে তিনি তো সম্মান আশা করতেই পারেন।
প্রশ্ন: ‘প্রফেসর বিদ্যা ব্যানার্জি’ তা হলে স্নেহাশিস চক্রবর্তীর ধারাবাহিক বলে, বিষয়বস্তুর কারণে রেটিং চার্টে দ্বিতীয়? না কি স্বস্তিকা দত্তের প্রত্যাবর্তনে?
স্বস্তিকা: আমরা চ্যানেল টপার, স্লট লিডার-ও। আর ভাল ফলাফলের কারণ, তিনটি। স্নেহাশিসদা, পরিচালক আর প্রত্যেকের অক্লান্ত পরিশ্রম।
ক্লাসরুমের সেট। সেখানে অভিনেতাদের দৃশ্য বোঝাচ্ছেন সুকমল নাথ। নিজস্ব ছবি।
প্রশ্ন: যে সেট ছেড়ে গিয়েছিলেন সেই সেটেই আবার শুটিং...
স্বস্তিকা: (কথাশেষের আগেই) খুব নস্টালজিক! ‘তোমার খোলা হাওয়ায়’-এর সেটে খুব মজা হত। আসলে মিলেমিশে, হইহই করে কাজ করতে বেশ লাগে।
প্রশ্ন: ক্রুশল আহুজাকে মনে পড়েছে?
স্বস্তিকা: (থতমত খেয়ে) আমার শেষ ধারাবাহিকের নায়ক তো শুভঙ্কর!
প্রশ্ন: আপনাকে নিয়ে যাবতীয় গুঞ্জন তো ক্রুশলকে নিয়ে...
স্বস্তিকা: ‘কী করে বলব তোমায়’ ধারাবাহিক আদ্যন্ত প্রেমের। ফলে, দেখতে দেখতে দর্শক আমাদের অভিনয়কেই সত্যি বলে ধরে নিতেন। নেহাৎ শুভঙ্করের সঙ্গে আমার তেমন প্রেমের দৃশ্য ছিল না, তাই গুঞ্জন ছড়ায়নি। রোম্যান্টিক ধারাবাহিকে নায়ক-নায়িকা আলাদা আলাদা দুটো ঘরে বসে শুটিং করবেন, সংলাপ বলবেন— এটাও তো হয় না।
প্রশ্ন: তার মানে, রোম্যান্টিক ধারাবাহিক হলে নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে চর্চা হবেই?
স্বস্তিকা: না হওয়াটাই বড় বিপর্যয়। আমি অন্তত তা-ই মনে করি।
প্রশ্ন: ধারাবাহিক ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’কে ঘিরে এত বিতর্ক তা হলে সঠিক?
স্বস্তিকা: (থমকে গিয়ে) কাউকে ছোট না করেই বলছি, ধারাবাহিক দেখার সুযোগ পাইনি। তবে যে কোনও কাজের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এমন বিতর্ক বা চর্চা ছড়ানো উচিত নয়, যা সেই কাজের পক্ষে ক্ষতিকর।
প্রশ্ন: আপনার ধারাবাহিকের নায়ক অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রসায়ন জমল?
স্বস্তিকা: খুবই পরিশ্রমী। এ ব্যাপারে একটা কথা বলি। স্নেহাশিসদা খুবই রোম্যান্টিক, সেটা ওঁর অভিনেত্রী স্ত্রী রূপসা চক্রবর্তী বেশি ভাল বলতে পারবেন (জোরে হাসি)। ফলে, চরিত্র এমন ভাবে গড়ে দেন যে সেই চরিত্রে যিনি অভিনয় করবেন, তিনিই রসায়ন জমিয়ে দেবেন। দাদা খুব পরিণত প্রেম দেখান। কথায় ভালবাসা, কথাতেই যাওয়া, কথাতেই আসা— দাদা এই ভাবনায় বিশ্বাসী। তাই ওঁর লেখা সংলাপ হৃদয়ে ঝড় তোলে। দাদা নোংরামিতে বিশ্বাসী নন।
প্রশ্ন: অর্থাৎ নায়ককে নায়িকার হাত ধরতে হয় না, জড়িয়েও ধরতে হয় না?
স্বস্তিকা: কে বলেছে হয় না! সেটাও হয়। যদি দাদা মনে করেন, প্রয়োজন বোঝেন। জোর করে দৃশ্যে এ সব চাপিয়ে দেন না। দাদা কী মনে করছেন, সেটা আগের দিনের রাত অবধি জানতে পারি না।
প্রশ্ন: ধরুন, আপনার মেজাজ নেই। এদিকে, হাতেগরম দৃশ্য পেয়ে প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে। ক্যামেরার সামনে রোমান্স জাগে?
স্বস্তিকা: দাদার কণ্ঠস্বরে জাদু আছে। দাদা যে ভাবে ‘ভয়েজ় নোট’-এ দৃশ্য বুঝিয়ে দেন, তাতে চোখ বন্ধ করে দৃশ্য দেখতে পাই। ওই কণ্ঠস্বর শুনলে মন ভাল হয়ে যায়।
প্রশ্ন: রোম্যান্টিক প্রযোজকের তা হলে বহু প্রেম?
স্বস্তিকা: (ফের হাসি) এই রে! কঠিন প্রশ্ন। আমি সত্যিই জানি না। এই উত্তর রূপসাদি দিতে পারবেন।
সহ-অভিনেতার সঙ্গে সেটে ‘প্রফেসর বিদ্যা ব্যানার্জি’। নিজস্ব ছবি।
প্রশ্ন: একদিকে বড়পর্দায় ‘ভানুপ্রিয়া ভূতের হোটেল’ আসছে। অন্য দিকে, আপনি নিয়মিত ছোটপর্দায়। নায়িকাকে রোজ দেখতে পাওয়া ভাল?
স্বস্তিকা: অভিনয়ের জন্য, সমসাময়িক থাকতে এবং কাজের খিদে মেটাতে যত মাধ্যমে আমায় দেখা যাবে, আমি রাজি। নায়িকাকে দর্শক অভিনয়ে দেখতে চান। এখনকার দর্শক যথেষ্ট পরিণত। সব বোঝেন। আমিও মাধ্যম বাছি না। অভিনয়ের জন্য কাজ করি।
প্রশ্ন: সবার সঙ্গে হাসিমুখে মিলেমিশে থাকাকে এখন ভাল ‘জনসংযোগ’ বলে। স্বস্তিকা সেটাই করেন?
স্বস্তিকা: আমি গ্রিন টি, কফির উপরে থাকি। আমার ঘরে কেউ এলে তাঁকে আমি এই দিয়েই আপ্যায়ন করব। সেটা যদি ‘পিআর’ করা হয় তা হলে তা-ই। কেউ শিখতে চাইলে আসতে পারেন। ‘প্রফেসর বিদ্যা ব্যানার্জি’ ক্লাস নেবেন (হাহা হাসি)। আগে ভাল মানুষ হতে হবে।
প্রশ্ন: প্রাক্তনদের সঙ্গে দেখা হলেও সেটাই করেন? পৃথিবীটা খুবই ছোট...
স্বস্তিকা: (খানিক চেয়ে থেকে) আমার দুনিয়াটা বড়। তাই পুরনো বই পড়া ধাতে নেই। পাতাও উল্টে দেখি না। যেখানে অযাচিত ভিড়, সেখানেও আমি নেই। ফলে, কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ-ও নেই। কাজের বাইরে কারও সঙ্গে আমার প্রেম নেই।