কখনও আকাশের মুখভার। ঝমঝমিয়ে এলোপাথাড়ি বৃষ্টি। পর ক্ষণেই মেঘ সরে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, পুজোর আর দেরি নেই। রবিবার উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে তখন আলসে দুপুর। গৃহস্থের অন্দরমহলে বাসন-কোসনের শব্দ। খাসির মাংসের রান্নার গন্ধে ‘বাই লেন’ ম-ম করছে! পায়ে পায়ে সে সব পিছনে ফেলে পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ির সামনে পৌঁছোতেই থমকে দাঁড়াতে হল। রাজবাড়ি যেন গমগম করছে বহু লোকের আনাগোনায়।
শুটের অবসরে দর্শনা বণিক, প্রিয়াঙ্কা সরকার, বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়, ঐশ্বর্য সেন। নিজস্ব চিত্র।
আর একটু ভিতরে গিয়ে জানা গেল, সেখানে প্রিয়াঙ্কা সরকার নাকি রান্না করছেন। আর তাঁকে সাহায্য করছেন আবীর চট্টোপাধ্যায়। সবিস্তার জানতে রাজবাড়ির ভিতরে পা রাখতেই সব পরিষ্কার। অভিরূপ ঘোষ তাঁর আগামী ছবির শুটিং করছেন। সেখানে দুর্গাপুজোর সেট পড়েছে। আবীর-প্রিয়াঙ্কা এই ছবির নায়ক-নায়িকা। ছবিতে পুজোয় উপস্থিত আমন্ত্রিতদের রেঁধে খাওয়াচ্ছেন নায়িকা। তারই তদারকিতে নায়ক! প্রিয়াঙ্কা সত্যিই রাঁধছেন নাকি? রান্নার জায়গায় উঁকি দিতেই দেখা গেল, কোমর বেঁধে তিনি লুচি, ছোলার ডাল রাঁধছেন! শুটিংয়ের একমাত্র সাক্ষী আনন্দবাজার ডট কম।
দালান জুড়ে পুজো-পুজো সাজ। লাল শালু, ফুলের মালা, প্রদীপ, আলপনায়, তালপাতার পাখায় চারিদিক সাজানো। একচালার প্রতিমাকে দেখে মনে হবে, এই মাত্র পুজো সারা হল। “রবিবার আমাদের অষ্টমী”, হাসতে হাসতে বললেন পরিচালক। তাঁর এই ছবিতে গা-ছমছম করা গল্প। এক বনেদি একান্নবর্তী পরিবারের ছোট মেয়ে ভয়ানক অসুস্থ। বিধবা মা একা হাতে মেয়েকে সামলান। মেয়ের অসুস্থতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় গ্রামের বাড়িতে মা দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছেন। বাড়িতে পুজো শুরু হতেই একের পর এক ভৌতিক কাণ্ড, যা সামলাতে উপস্থিত ‘পুরুত’। তিনি কি পারবেন অসুস্থ মেয়েটিকে সুস্থ করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে? এই নিয়েই এগোবে গল্প। ‘পুরুত’-এর ভূমিকায় আবীর। শিশুকন্যার মা প্রিয়াঙ্কা। এ ছাড়াও, গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দর্শনা বণিক, বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়, ঐশ্বর্য সেন। ঐশ্বর্য এখানে নেটপ্রভাবী। দর্শনা এবং বিবৃতি ছোট্ট মেয়েটির আত্মীয়। শিশুকন্যার চরিত্রে দেখা যাবে লগ্নজিতা দাসকে।
সেটে বিবৃতি, আবীর, প্রিয়াঙ্কা। নিজস্ব ছবি।
কান ভর্তি দুল, গলা ভর্তি হার...
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। পিঠে চামড়ার ব্যাগ। হাতে দো-নলা বন্দুক। আবীরের এই সাজ দেখে চমকে যেতে হয়। আরও চমক, তিনি জানলায় পেরেক পুঁতে লাল সুতো জড়াচ্ছেন। এমন সাজ আগে কখনও... আবীর তড়ঘড়ি জবাব দিলেন, “এই প্রথম। একটু অস্বস্তি হচ্ছে। ভালও লাগছে। এ রকম আগে তো সাজিনি!” আর ওই যে জানলায় লাল সুতো বাঁধা? “একটুও বিশ্বাস করি না! আমার হাতে ওই জন্য কোনও আংটি নেই।” ভূতের ছবিতে অভিনয় নতুন নয় তাঁর। নিশ্চয়ই একটু-আধটু বিশ্বাস করেন? নায়ক হেসে ফেলে জবাব দিলেন, “একটুও না। চোখেই দেখলাম না আজ পর্যন্ত।” শুনেই একটু দূরে দাঁড়ানো ঐশ্বর্য ফিসফিসিয়ে উঠলেন, “আমিও দেখিনি। কখনও যেন দেখতে না হয়। বড্ড ভয় পাই!”
আবীরের বিপরীতে প্রিয়াঙ্কা। একসঙ্গে সাতটি ছবি তাঁরা করেছেন। কিন্তু বাকি তিন সঙ্গিনী... বিবৃতি, দর্শনা, ঐশ্বর্য... নায়কের থেকে খুবই ছোট...
টোলভাঙা হাসি হেসে নায়কের দাবি, “বিবৃতির সঙ্গে আগে কাজ করেছি। বাকিদের নাম, কাজ— দুটোই দেখেছি। কাজ করতে করতে সব কিছুই সহজ হয়ে যাবে।”
সারা দিন ধরে নানা দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হচ্ছে। তারই মধ্যে একটি দৃশ্য। নাচের দৃশ্যের মতো। আবীরকে ঘিরে বিশেষ সাজে সজ্জিত একদল অভিনেতা। নায়ক নাচবেন নাকি?
“না না। এগুলো মন্তাজ দৃশ্য”, বুঝিয়ে দিলেন পরিচালক। সাজে, মন্তাজে যে অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘ভুলভুলাইয়া’র ছায়া! বলতেই মৃদু হেসে আবীর জানালেন, তিনি কোনও মিল পাচ্ছেন না।
শুটিং চলছে। নিজস্ব ছবি।
মাত্র ২২-এ মা, পর্দায় কেন হব না?
ইদানীং প্রিয়াঙ্কা সিরিজ় বা বড় পর্দায় ‘মা’ হচ্ছেন। যেমন, অভিরূপের আগের ছবি ‘মৃগয়া’। সেখানেও তাঁর এক ছেলে ছিল। সিরিজ় ‘লজ্জা’তেও মেয়ে ছিল তাঁর। তাঁর বয়সি অভিনেত্রীরা চট করে এই চরিত্রে অভিনয় করতে চান না। সঙ্গে সঙ্গে নায়িকার দাবি, “বাস্তবে মাত্র ২২ বছরে মা হয়েছি। তা হলে পর্দায় নয় কেন?” বলতে বলতেই পর্দার মেয়ে ‘আর্যা’ গা ঘেঁষে বসল তাঁর। “প্রিয়াঙ্কা আন্টি খুব স্মার্ট”, হাসিমুখে বলতেই গাল ধরে আদর করলেন তাঁকে। বললেন, “মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু অভিনয়ে পোড়খাওয়া। যা বলা হয় একবারেই করে দেখায়।”
পর্দার মা-মেয়ের এই খুনসুটি বাস্তবে ছেলে সহজ যদি দেখে, তা হলে কি সে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে?
শুনে হাসিমুখে জবাব দিলেন প্রিয়াঙ্কা, “আমার ছেলে জন্ম থেকেই তার মাকে পর্দায় দেখে আসছে। ফলে, এই নিয়ে আর কিছু ভাবে না।” তার পরেই রসিকতা করলেন,“পর্দায় আমার সন্তান বদলায়। আমার ছেলের কপালটাই খারাপ। ওর মা একই থাকে!”
আবীরদা ইজ় সো হট....
এক টানা শুটের পরে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার বিরতি। অভিনেতারা যে যাঁর ঘরে বিশ্রাম, খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত। একতলার একটি ঘরে, পুরো ইউনিটকে নিয়ে খেতে বলেছেন অভিরূপ। সে সব পেরিয়ে পায়ে পায়ে বিবৃতি, ঐশ্বর্য, দর্শনার অন্দরমহলে। কারও হাতে চিত্রনাট্য। দুলে দুলে সংলাপ মুখস্থ করছেন। কেউ ফোনে মগ্ন। মাত্র তিন দিন শুটিং হয়েছে। তার মধ্যেই ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে তিন অভিনেত্রীর মধ্যে।
শুটিংয়ে ‘পুরুত’ আবীর চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
চার সুন্দরীর মধ্যমণি এক পুরুষ, আবীর চট্টোপাধ্যায়!
বলতে না বলতেই হই হই করে উঠলেন ঐশ্বর্য। বললেন, “একটু আগে এলেই দেখতে পেতেন, বিবৃতি কী করছিল!” কী করছিলেন বিবৃতি? প্রশ্ন শুনেই লজ্জায় লাল তিনি। ঐশ্বর্য হাসতে হাসতে ফাঁস করলেন, “সাদা পোশাকে কোনও পুরুষকে এত সুপুরুষ দেখায় সেটা আবীরদাকে না দেখলে বোঝা কষ্ট। ওঁকে ওই সাজে দেখে বিবৃতি এক ছুটে ঘরে ঢুকে আমাদের বলল, ‘আবীরদা ইজ় সো হট...!’” নিজেকে নিয়ে তার পরেই স্বীকারোক্তি, “এই প্রথম আবীরদার সঙ্গে অভিনয় করব। বুক ঢিপঢিপ করছে!” একটু দূরে বসে ঠোঁট টিপে হাসছেন দর্শনা। তিনিও কি এ কথাই বলবেন? “আমি বলব কী! বাড়িতে সারা ক্ষণ এত আবীরদা আবীরদা করি যে আমার স্বামী সৌরভ দাস নিজেই দাদাকে ডেকে বলে, ‘আমার বৌ তোমার খুব ভক্ত!’”
আড্ডায়, বিশ্রামে দুপুরের খাওয়ার বিরতি শেষ। প্রত্যেকে আবার কাজের মেজাজে। পরের শটে যাওয়ার আগে পরিচালকের কাছে প্রশ্ন, দালানে দেবীপ্রতিমা। পুজো হয় তাঁর? অভিরূপ জানালেন, নিত্যপুজোর জন্য একজন পুরোহিত রাখা হয়েছে। তিনি নিয়ম মেনে রোজ পুজো করেন।
আবীর কি ‘ভুলভুলাইয়া’র অক্ষয় কুমার? নিজস্ব ছবি।
আলসে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পড়ন্ত রোদ গায়ে মেখে ঝকঝক করছে রাজবাড়ি। বাড়ির বিশাল ছাদের দিকে তাকাতেই কী যেন মনে পড়ল। ছাদটা ভীষণ চেনা। কোথায় দেখা গিয়েছে? পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিটের একজন টেকনিশিয়ান সেটা বুঝতে পেরে বললেন, “এই বাড়িতেই ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবির শুটিং হয়েছিল। এ বার অভিরূপদার ছবির শুটিং হচ্ছে।”
বাড়ির রূপবদল দেখতে দেখতে কখন যেন পায়ে পায়ে রাজবাড়ির বাইরে...।