লিয়েন্ডারকে খুব ছোট্ট বয়সেই খেলার জগতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। বারো বছর বয়সে দেখেছিলাম, ও এক জন পুরোদস্তুর অ্যাথলিট। মানসিকতা, দম, সাহস— এগুলো একেবারে ওর নিজস্ব গুণাবলি। গত তিরিশ বছর ধরে ও নাগাড়ে লড়াই করাটাকে মন থেকে ভালবেসে এসেছে। নিজের সামনে ক্রমাগত নতুন নতুন লক্ষ্য তৈরি করে সেগুলোতে পৌঁছনোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। এগুলো শুধু এক জন স্পোর্টসম্যানই নয়, যে কোনও পেশাতেই চূড়ান্ত সফল মানুষের স্পেশ্যাল মানসিকতা। ল্যাবরেটরিতে স্কিল তৈরি করা যায়। মানসিকতা নয়। লিয়েন্ডার সেটা সঙ্গে নিয়েই পৃথিবীতে এসেছে।
আমার প্রথম স্ত্রী জেনিফার ১৯৭২-এ মিউনিখ অলিম্পিকের সময় লিয়েন্ডারকে ‘কনসিভ’ করে। ওই অলিম্পিকে আমরা দু’জনই ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম। আমি হকি টিমে। জেনিফার বাস্কেটবলে। এখন মনে হয়, ঈশ্বরেরই যেন বিধান— লিয়েন্ডারের গ্রেট স্পোর্টসম্যান হওয়াটা!
ভাবুন তো, ওর উৎপত্তি দুই অলিম্পিয়ানের মিলনে আর সেটাও কিনা অলিম্পিকেই!
একই সঙ্গে এত বছর বাদেও বলতে খুব খারাপ লাগছে— আমাদের তিন সন্তানকেই মা-বাবার মধ্যে ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের দরুন পারিবারিক ঝড়কে সামলাতে হয়েছে। এবং সেটাও দুর্ভাগ্যক্রমে ওদের শৈশবে! বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই, ওই ঘটনা অবশ্যই লিয়েন্ডারদের কষ্ট দিয়েছিল।
ওর মাইন্ড সেট-টাই ম্যাজিক্যাল
পারিবারিক সমস্যাকে ওর মন থেকে সরিয়ে রাখতে লিয়েন্ডারকে আরও বেশি করে খেলাধুলোর সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছিলাম। যখন ওর বারো
বছর বয়স— ফুটবল, হকি, রাগবি, ক্রিকেট, টেনিস— প্রতিটা খেলা সমান ভাল খেলত।
আর তার চেয়েও যেটা দেখে আমার ওই সময় বেশি অবাক লাগত—চার দিকের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও কী ভাবে একটা বাচ্চা ছেলে নিজেকে ফাইটার করে তুলতে পারে! কী অদ্ভুত ব্যাপারটা!
আসলে তখন থেকেই দেখে আসছি, নিজের জীবনকে ছোট ছোট কম্পার্টমেন্টে ভাগ করে নিয়ে সেই বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ একটা কম্পার্টমেন্টের দিকে একশো ভাগ ফোকাসড্ থাকার ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে লিয়েন্ডারের।
সবচেয়ে বড় কথা, সেই ছোট বয়স থেকে আজও খেলাধুলোই হল লিয়েন্ডারের কাছে পারিবারিক সমস্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখার একমাত্র অবলম্বন। ব্যক্তিগত যাবতীয় সমস্যা থেকে বাঁচার রাস্তা।
সত্যি বলতে কী, লিয়েন্ডারেরও বেশ কিছু দিন ধরে পারিবারিক সমস্যা চলেছে। প্রায় নিয়মিত কোর্ট-কাছারি করতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এক বার টেনিস কোর্টে ঢুকে পড়লে ওর মগজে, বডি ল্যাংগোয়েজে সে সবের বিন্দুমাত্র ছাপ থাকে না! আসলে ওর মাইন্ড সেট-টাই এ রকম ম্যাজিক্যাল!
জার্মান মেথ়ড
লিয়েন্ডারের জন্ম ১৯৭৩-এ। সত্তরের দশকে তখনকার পূর্ব জার্মানি এক অত্যাধুনিক স্পোর্টস প্রোগ্রাম আবিষ্কার করেছিল। পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছিল— পিক পারফরম্যান্স প্রোগ্রাম। ওদের মত ছিল, স্পোর্টস ট্রেনিং মানে কেবল ফিটনেস ট্রেনিং নয়। এক জন প্রকৃত বিশ্বমানের খেলোয়াড় হয়ে ওঠার জন্য সেই প্লেয়ারের লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্টও ফিটনেসের মতোই সমান জরুরি। যার জন্য তিন বছর বয়স থেকেই তাকে অ্যাথলিট করে তোলার কাজ শুরু করে দিতে হবে।
লিয়েন্ডারকে আমি ওই জার্মান মেথডে তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। ওকেও তিন বছর বয়সে খেলার মাঠে এনে ফেলেছিলাম। ওই বয়স থেকেই ওর বডি মুভমেন্ট, শরীরের ব্যালান্স একেবারে ক্রীড়াবিজ্ঞান মেনে নিখুঁত করে তোলার কাজ চলেছিল আমার।
৩৬৫ দিন বাড়িতে হাজার বার স্কিপিং করাতাম
চেন্নাইয়ে (তখনকার মাদ্রাজ) ব্রিটানিয়া অমৃতরাজ অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার আগে লিয়েন্ডার সল্টলেক সাইতে ডাক্তার টন্ডনের কাছে ফিজিক্যাল ট্রেনিং করতে যেত। মাঝেমধ্যে ওই সময় পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফুটবল টিমের প্র্যাকটিসেও লিয়েন্ডারকে পাঠিয়েছি। সব কিছু একটাই টার্গেট নিয়ে। লিয়েন্ডার যাতে প্রচণ্ড কষ্টসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে। ওর ভেতর যেন একটা সহজাত চূড়ান্ত সহনশীলতা তৈরি হয়।
অনেকেই জানেন, আবার বেশির ভাগই জানেন না— ওই সময় ডাক্তার টন্ডন, কী পিকেদা’র কাছে ট্রেনিং নিতে যাওয়ার আগে, আর ফিরে আসার পরে ৩৬৫ দিনই বাড়িতে হাজার বার স্কিপিং করাতাম আমি লিয়েন্ডারকে। একশো বার ডন-বৈঠক। যাতে পা আর হাতের পেশি বজ্রকঠিন থাকে ওর গোটা খেলোয়াড়জীবনে। এক-এক দিন লিয়েন্ডার পরিশ্রম, ক্লান্তি আর কষ্টে ভেঙে পড়ত আমার কাছে। আমার দুটো হাত ধরে হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলে কাতর অনুনয় করত, ড্যাডি আজ একটা দিন ছেড়ে দাও। এত বার স্কিপিং করতে পারছি না। ওঠ-বোস করতে পারছি না আর...।