Advertisement
E-Paper

কে এই ফাওয়াদ, যাঁর জন্য দিতে হল পাঁচ কোটির মুচলেকা?

কে এই ফাওয়াদ খান, যাঁর জন্য দিতে হল পাঁচ কোটি টাকার মুচলেকা? আর তোলপাড় হল গোটা দেশ। লিখছেন ইন্দ্রনীল রায় ও সায়ন আচার্যকে এই ফাওয়াদ খান, যাঁর জন্য দিতে হল পাঁচ কোটি টাকার মুচলেকা? আর তোলপাড় হল গোটা দেশ। লিখছেন ইন্দ্রনীল রায় ও সায়ন আচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:২০

তাঁর সঙ্গে স্রেফ একটা সেলফি তোলার জন্য মুম্বই থেকে নিউ ইয়র্ক উড়ে গিয়েছিলেন রণবীর কপূরের মা নীতু কপূর!

সঞ্জয় লীলা বনশালির পরের ছবি ‘পদ্মাবতী’তে তাঁকে নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন বলেই দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে নাকি ঝামেলা রণবীর সিংহ-র।

‘কপূর অ্যান্ড সন্স’য়ে তাঁর অভিনয় দেখে প্রথম যিনি টুইট করেন, সেই ভদ্রলোকের নাম অমিতাভ বচ্চন!

তাঁর পাকিস্তানি সিরিয়াল ‘জিন্দেগি গুলজার হ্যায়’-তে তাঁকে দেখার জন্য নিয়মিত লম্বা শ্যুটিং ব্রেক নিতেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া!

এবং বলিউডে কান পাতলেই শুনতে পাবেন এই প্রজন্মের মেয়েদের কাছে সবচেয়ে ‘গুড লুকিং পাকিস্তানি’ হিসেবে ইমরান খান কিংবা ওয়াসিম আক্রমকে মাইলখানেক পিছনে ফেলে দিয়েছেন তিনি।

এমনকী, যখন তিনি মুম্বইতে ছিলেন, সে সময় ফাওয়াদ খানের ইন্টারভিউয়ের সময় রীতিমতো বাউন্সারের ব্যবস্থা করতে হতো প্রযোজককে, শুধুমাত্র মহিলা সাংবাদিকদের থেকে তাঁকে বাঁচাতে।

ফাওয়াদ আফজল খান!

পাকিস্তানি সুপারস্টার।

বলিউডের হার্টথ্রব।

এবং এই মুহূর্তে তাঁকে ঘিরেই উত্তাল গোটা দেশ — ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ রিলিজের আগে বিতর্কের কেন্দ্রে তিনিই। এমএনএস-য়ের পাকিস্তান-বিরোধী হাওয়ায় ইতিমধ্যেই চুপিসারে দেশ ছেড়েছেন, এবং চাপের মুখে পড়ে পরিচালক কর্ণ জোহরও বলতে বাধ্য হয়েছেন, এর পর আর কোনও পাকিস্তানি অভিনেতাকে কাস্ট করবেন না।

তবু, ফেসবুক, টুইটার খুললে তাঁর অগুন্তি ভক্তদের পোস্ট — ‘ফিরে এসো ফাওয়াদ’।

বছর দুয়েক আগে যখন প্রথম বার ভারতীয় দর্শকদের সামনে টিভির পর্দায় হাজির হয়েছিলেন ‘জিন্দেগি গুলজার হ্যায়’ নিয়ে, তখনও কেউ ভাবতে পারেনি পরবর্তী দেড় বছরে এই রকম জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছবেন ফাওয়াদ।

• ‘পরিচ্ছন্ন ইমেজটাই ওঁর সেক্স অ্যাপিল’

যাঁকে নিয়ে এত হইচই, তিনি অবশ্য শ্যুটিং না থাকলে বাড়ির বাইরে বেরোন না, বলছেন তাঁর বলিউডের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। রাত ন’টার পর ফোন সুইচ অফ করে দেন।

আসলে, ফাওয়াদের ক্লিন ইমেজটাই তাঁর সবচেয়ে বড় সেক্স অ্যাপিল, এমনটাই মনে করছেন মুম্বইয়ের এক ম্যাগাজিনের সম্পাদক। ‘‘ফাওয়াদ খানের কোনও স্ক্যান্ডাল নেই। অত ভাল দেখতে হলেও কোনও হিরোইনের সঙ্গে ‘লিঙ্ক আপ’ নেই। নিজের বউ সদাফকে নিয়ে সব অনুষ্ঠানে যান। ওঁর ক্লিন ইমেজটাই মেয়েদের কাছে অসম্ভব অ্যাপিলিং। ওটাই ওঁর সেক্স অ্যাপিল,’’ বলছিলেন তিনি। শোনা যাচ্ছে, ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’‌য়ের কাস্টিং যখন ঘোষণা করা হয়, অনেকেই রণবীর নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন কর্ণ জোহরকে। তাঁদের বক্তব্য ছিল, রণবীর কি পারবেন এত বড় ছবি নিজের কাঁধে নিতে? তাঁদের মতে, বেশ কিছু ছবি ফ্লপ করার পর রণবীরের ওপর ডিস্ট্রিবিউটাররা সে রকম ভরসা রাখতে পারছেন না। কিন্তু যখন তাঁদের বলা হয়, ফাওয়াদ খানও রয়েছে ছবিতে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আশাবাদী হয়ে ওঠেন ‘অ্যায় দিল...’ নিয়ে।

যে বলিউড, এই ক’দিন আগেও ফাওয়াদের ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ নিয়ে প্রবল উৎসাহী ছিল, সেই মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিই আজ হঠাৎ বিভক্ত। পাকিস্তানি বিদ্বেষের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে ফাওয়াদের বন্ধুদের গলাতেও।

• কোনও অভিনেতাকে নিয়ে এত উন্মাদনা আগে দেখিনি

কেউ সোজাসুজি বলে দিচ্ছেন কথা বলবেন না, কেউ বা আবার পরিচিত সাংবাদিকদের নম্বর দেখলেই কল ডাইভার্ট করে দিচ্ছেন। কারণ একটাই— অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ফাওয়াদ নিয়ে কোনও মন্তব্য নয়।

‘‘বলিউডে সবাই ফাওয়াদকে পছন্দ করে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কথা বলা মানেই ওর বিপদ বাড়ানো। আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই,’’ মুম্বই থেকে বলছিলেন ফাওয়াদের এক বন্ধু, যিনি মাস খানেক আগে ঠিক করেছিলেন ফাওয়াদকে নিয়ে একটি টিভি সিরিজ তৈরি করবেন।

এখন অবশ্য সেটা করা মুশকিল।

সীমান্তের ও পারের ছবিটাও নাকি একই রকম। চুপিসারে ভারত ছাড়ার পর থেকেই পাকিস্তানি মিডিয়া সমানে খুঁজে চলেছে তাঁকে।

এমনকী, ফাওয়াদের লাহোরের বাড়ির সামনে সারারাত ওবি ভ্যান বসিয়েও তাঁর নাগাল পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি বাবা হয়েছেন। সেই উপলক্ষে নাকি কয়েকজন চিত্রগ্রাহক পৌঁছে যান ফাওয়াদের শ্বশুরবাড়িতে। স্রেফ একটা ছবি আর ‘কোট’-য়ের আশায়।

সেই বাউন্সারও সামলেছেন তিনি।

‘‘সবাই জানতে চাইছেন, ফাওয়াদ কোথায়? দেশে ফেরার পর থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এক দিন বিজ্ঞাপনের শ্যুটে দেখা গিয়েছিল। তারপর থেকে উধাও,’’ লাহোর থেকে আনন্দplusকে বলছিলেন সাংবাদিক তাহরুব আসগর, যিনি ঘটনাচক্রে ফাওয়াদের প্রতিবেশীও।

‘‘কোনও অভিনেতাকে নিয়ে এত উন্মাদনা এর আগে দেখিনি। দিন দিন যেন জনপ্রিয়তা আরও বাড়ছে ওঁর,’’ বলছিলেন তাহরুব।

• ফাওয়াদ, উইল ইউ ম্যারি মি

স্বপ্নের পুরুষ শুধু নয়, ফাওয়াদ খান রকস্টারও!

বছর দশেক আগে, বন্ধুদের সঙ্গে তৈরি করেছিলেন ‘এন্টিটি প্যারাডাইম’ নামের একটি রক ব্যান্ড। কলেজ ফেস্ট হোক কিংবা রক কনসার্ট, সবেতেই দেখা যেত রকস্টার ফাওয়াদকে। মুম্বই আসার পরেও পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আড্ডায় এখনও নিয়মিত বব ডিলান কিংবা জন লেনন শোনেন বছর চৌত্রিশের এই অভিনেতা।

এবং তাঁর ঘনিষ্ঠরা মনে করেন এই কারণেই ফাওয়াদের এত জনপ্রিয়তা। ‘‘একে ওই রকম দেখতে, তার ওপর হাতে গিটার। সেই কারণেই মহিলা ফ্যানদের ওকে নিয়ে এত উন্মাদনা। মেয়েদের মতে ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রমের পর সবচেয়ে সুদর্শন পাকিস্তানির নাম ফাওয়াদ খান,’’ বলছিলেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ পরিচালক। কিন্তু ফাওয়াদকে নিয়ে পাগলামিটা ঠিক কোন পর্যায়ে?

এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য মেলবোর্ন গিয়েছিলেন ফাওয়াদ। সেই ফেস্টিভ্যালে ঋষি কপূর, সিমি গারেওয়াল ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও। সেই অভিজ্ঞতার কথা একদিন বলছিলেন সৃজিত।

‘‘আমি মেলবোর্নে যা পাগলামো দেখলাম ফাওয়াদকে নিয়ে, সেটা ভারতের কোনও শহরে হলে র‌্যাফ নামাতে হতো। অডিটোরিয়ামে যখন ফাওয়াদ ঢুকলো, শুধু নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম। প্রায় দশ হাজার মহিলা একসঙ্গে চিৎকার করছে, ‘ফাওয়াদ, উইল ইউ ম্যারি মি’। আমার পাশেই বসেছিলেন ঋষি কপূর আর সিমি গারেওয়াল। দেখলাম ওঁরাও আলোচনা করছেন ফাওয়াদের জনপ্রিয়তা নিয়ে,’’ বলছিলেন সৃজিত।

ফ্যানদের মধ্যে যদি তাঁর চেহারা, তাঁর লুক নিয়ে এই রকম পাগলামি হয়, তা হলে বলিউডেরও একটা বিশেষ কারণ আছে তাঁকে এত ভালবাসার। ‘‘আসলে ও প্রচণ্ড খাটতে পারে এবং কাজের ব্যাপারে ভীষণ ডেডিকেটেড। সেটাই ওর সাফল্যের অন্যতম কারণ,’’ মুম্বই থেকে আনন্দplusকে বলছিলেন পরিচালক শাকুন বাত্রা, যাঁর ছবি ‘কপূর অ্যান্ড সন্স’য়ের মুখ্য চরিত্রে ছিলেন ফাওয়াদ।

• জনপ্রিয়, তবুও...

তবে এখন তাঁর জনপ্রিয়তা যাই থাকুক না কেন, বলিউড কিন্তু তাঁর ব্যাপারে একটু হলেও সন্দিহান।

এই মুহূর্তে যদিও তাঁর ওপর আশি কোটি টাকার লগ্নি রয়েছে কিন্তু অনেক প্রযোজকই ফাওয়াদের নাম শুনলে পিছিয়ে যাচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে ক্যাটরিনা কাইফের বিপরীতে ‘রাত বাকি’ ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল পাকিস্তানের এই অভিনেতার। প্রাথমিক কথাবার্তার পর অগ্রিম টাকাও নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন নতুন হিরোর খোঁজ শুরু করেছে ধর্মা প্রোডাকশনস।

যদিও প্রযোজনা সংস্থা এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ, বলিউডের অন্য এক প্রযোজক স্বীকার করছেন যে এর ফলে কিছুটা হলেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে।

‘‘ফাওয়াদ এখন একটা বিরাট ব্র্যান্ড। এবং সেই জন্যই ওকে ছবিতে কাস্ট করতে চাইছেন বেশির ভাগ পরিচালক। এখন আবার নতুন করে প্ল্যানিং শুরু করতে হবে,’’ বলছিলেন ওই প্রযোজক, যিনি মাসখানেক আগে ফাওয়াদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ডেট চেয়ে।

• ও ঠিক এগিয়ে যাবে

তবে যাঁরা ওর সঙ্গে আগে কাজ করেছেন, তাঁরা মানছেন যে এই ফতোয়ার ফলে আদতে ক্ষতি হবে বলিউডেরই।

শাকুন বাত্রা যেমন মনে করেন এই ফতোয়ায় প্রাথমিক ভাবে সমস্যায় পড়লেও ফাওয়াদ ঠিক ঘুরে দাঁড়াবেন।

“এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ফাওয়াদের মতো অভিনেতার বলিউডে কাজ না করাটা বড় ক্ষতি, তবে ও এটা কাটিয়ে উঠবে,” বলেন ‘কপূর অ্যান্ড সন্স’য়ের পরিচালক।

বলিউডে কান পাতলে অবশ্য শোনা যাচ্ছে আরও কিছু গুঞ্জন। পাকিস্তানের কিছু নামী প্রযোজকও নাকি ইতিমধ্যেই স্থানীয় ছবি করার প্রস্তাব দিয়েছেন এই সুপারস্টারকে। যদিও এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ ফাওয়াদ ঘনিষ্ঠ বা ম্যানেজার হাসান খালিদের।

‘কপূর অ্যান্ড সন্স’য়ের প্রচারের সময়, চণ্ডীগড়ের এক যুবকের গলায় কাওয়ালি শুনে চমকে গিয়েছিলেন ফাওয়াদ। পরে সেই ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে মুম্বই এখন তাঁর প্রিয় শহর। “এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে হয়তো আর কোনও দিন কাজ করা হবে না। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, ফাওয়াদ দেশ ছাড়লেই কি পরিস্থিতির উন্নতি হবে? ভারত-পাক উত্তেজনা কমে যাবে?” ক্ষোভের সুরে বলছিলেন শাকুন।

সম্প্রতি নিজের ফেসবুক পোস্টে বার্তা দিয়েছেন ফাওয়াদ স্বয়ং। ফ্যানদের অনুরোধ করেছেন গুজবে কান না দিতে। লিখেছেন, ‘‘একজন বাবা হিসেবে, আমি চাই একটা সুন্দর, শান্তিময় পৃথিবী, যেখানে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। আগামী প্রজন্মের জন্য এটুকু তো করতেই হবে। ভারত ও পাকিস্তানের মানুষকে ধন্যবাদ, যে তাঁরা এখনও ভালবাসা ও সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করেন।’’

এ বিষয়ে শেষ কথাটা বোধহয় বলছেন মহেশ ভট্ট স্বয়ং। ‘‘সন্ত্রাসবাদের কোনও দেশ হয় না। ফাওয়াদকে হাতজোড় করে বলছি, ভারতীয় মাটিতে হওয়া সন্ত্রাসবাদী আক্রমণকে ধিক্কার জানাতে। এটা করলে ভারত তাঁকে সারাজীবন সেলাম ঠুকবে,’’ বলছেন মহেশ।

সব মিলিয়ে, এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ফাওয়াদ খানকে নিয়ে যেন এক চূড়ান্ত মেরুকরণের সামনে বলিউড।

সব সুপারস্টারকে নিয়েই বোধহয় এই রকম মেরুকরণ হয়। শুধু ফাওয়াদের ক্ষেত্রে মেরুর দু’দিকে রয়েছে দু’টো দেশ — ভারত আর পাকিস্তান।

সাধে কি আর লোকে বলছে, অ্যায় দিল হ্যায় ফাওয়াদ!

Fawad Khan Bollywood Film Industry
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy