করোনার সময়। ঘরবন্দি আমি তাঁকে খুঁজে পেলাম। গওহর জান। আশৈশব আমার সুরের শিক্ষা, আমার নাচের ধারা বুঝি গওহর জানের মধ্যে দিয়ে বিস্তারিত হল। মঞ্চে গওহর জানকে নিয়ে আসার ভাবনা থেকেই আমার তাঁকে চেনা। জানতে শুরু করলাম আমাদের সেই ‘ফার্স্ট ডান্সিং লেডি’কে। আমাদের দেশের ‘গ্রামোফোন সেলিব্রিটি’কে।
১৯০২ থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী। আর সেই যুগে প্রতিটি রেকর্ডিং সেশনের জন্য তিনি নিতেন তিন হাজার টাকা! ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সংজ্ঞা, আঙ্গিক, এমনকি গায়নশৈলী বদলে দিয়েছিলেন তিনি। আরবি ভাষায় যোগিয়া রাগের ঠুংরি গেয়ে তিনি নতুন সুরের যে দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন তার চর্চা আজও চলে আসছে।
১৯০১ সালে কলকাতায় আসে গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেড। উদ্দেশ্য, এ দেশের শিল্পীদের গান রেকর্ড করে বাণিজ্য করা। সেই থেকেই শুরু হয় এ দেশে রেকর্ডের প্রচলন। প্রথম যুগের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম গওহর জান। কোম্পানির রেকর্ডিস্ট হিসেবে এসেছিলেন গেইসবার্গ সাহেব। রেকর্ডিং-এর সময় গওহর জানকে দেখে অবাক হয়েছিলেন তিনি। গওহরের গান গেইসবার্গের বোধগম্য হয়েছিল সামান্যই। কিন্তু, তাঁর কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, যা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। গেইসবার্গ লিখছেন, ‘কোলোরাচুরা কণ্ঠস্বর বা কারুকাজপূর্ণ কণ্ঠ প্রয়োগে তিনি যথেষ্ট পটু। সহজ ভঙ্গিতে তিনি গাইতেন। কণ্ঠে রূপ দেওয়া কঠিন যে সব তাল, সেগুলিকেও এমন অনুরণনে পরিবেশন করতেন, আমাদের সমস্ত মনোযোগটা টেনে নিতেন তাঁরই দিকে।’
গওহর জানের মেহফিলের স্মৃতি, গৃহবন্দি ভালবাসা আজও এ শহরের প্রাণ-পিঞ্জরে। বার বার স্তব্ধ হই তাঁর জীবনের ঘটনা জেনে। এক বার জোড়াসাঁকোর মল্লিকবাড়ির জমিদার গোবিন্দরাম মল্লিক এক অনুষ্ঠানে গওহরকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানান। জমিদারের নিমন্ত্রিতদের তালিকায় সে দিন ছিলেন বাঙালি, পঞ্জাবি, মাড়োয়াড়ি ও ইংরেজি ভাষার মানুষজন। জমিদার যেন গওহরকে পরখ করতে চাইলেন। গৃহকর্তা অনুরোধ করলেন, অতিথিদের ভাষা অনুযায়ী গওহর যেন তাঁদের আলাদা করে গান শোনান।
বহুমূল্য অলঙ্কারে সুসজ্জিত গওহর আসর থেকে প্রাঙ্গণে নেমে এলেন। যে দিকে সাহেবরা বসেছিলেন, সেখানে গিয়ে একটা কুর্নিশ করে ধরলেন ইংরেজি গান। এর পরেই পঞ্জাবি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে ধরলেন একটি পঞ্জাবি গান। মাড়োয়াড়ি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে গাইলেন হিন্দি দাদরা ও ঠুমরি। সব শেষে বাঙালি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে শুনিয়েছিলেন একাধিক বাংলা গান। গওহরের আত্মবিশ্বাস আর স্পর্ধা তাঁকে নিজের কাছে নিজেকেই প্রতিযোগী করে তুলেছিল। যে গওহর দশটি ভাষায় ছ’শোর উপর রেকর্ড করেছিলেন তাঁর কাছে এই কাজ খুব যে মোটেই দুরূহ ছিল না, তা তিনি ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সে দিন।
এখন ভাবলে মনে হয়, কত সহজে নিজের মুন্সিয়ানা সম্পর্কে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন গওহর। আজকের দিন একেই তো আমরা ‘ব্র্যান্ডিং’ বলি। সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়েছিলেন তিনি।
১৮৭৩ সালের ২৬ জুন উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে জন্ম অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োয়ার্ডের। জন্মসূত্রে ইহুদি। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া হেমিংস, আর বাবা রবার্ট উইলিয়াম ইয়োয়ার্ড। ভিক্টোরিয়া ও রবার্টের দাম্পত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একা হয়ে যান মা ও মেয়ে। পরে এক মুসলিম যুবক খুরশিদের সহায়তায় ভিক্টোরিয়া ও অ্যাঞ্জেলিনা বারাণসী শহরে থাকতে শুরু করেন। এখানেই মা ও মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ভিক্টোরিয়ার নাম হয় মালকা জান এবং অ্যাঞ্জেলিনা হয়ে ওঠেন গওহর জান। সে সময় মালকা জানের উর্দু আর সঙ্গীত চর্চা বারাণসীর মেহফিল সাজিয়ে তুলেছিল। মায়ের সঙ্গে মেয়ে গওহর জানেরও সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। বেচু মিশ্রের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন গওহর। খুরশিদের সঙ্গে গওহরের মায়ের নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সে সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার ব্যাপ্তি উত্তর ভারতের শিল্পীদের আকর্ষণ করেছিল। মেয়ের সঙ্গীত চর্চা, খুরশিদের শাড়ির ব্যবসার কথা ভেবে মালকা জান কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৮৩-তে মা আর মেয়ের নতুন আস্তানা হল কলকাতায়।
কলুটোলার পুরনো এক বাড়ি ভাড়া করে থাকতে আরম্ভ করেন মালকা, গওহর আর খুরশিদ। তবে গওহরের নাম বিশ্বে ছড়িয়ে যাওয়ার পরে তিনি নাখোদা মসজিদের পাশেই এক প্রাসাদসম বাড়িতে থাকতেন। তিনি তার নাম রেখেছিলেন ‘গওহর বিল্ডিং’। সে সময় এক জন পারফর্মার হিসাবে গওহর যে পারিশ্রমিক পেতেন আমার মনে হয় না, আজকের দুনিয়ায় ওই সমপরিমাণ অর্থ কেউ আজ পেতে পারেন! গওহর একবার একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন, যেখানে পুরো মঞ্চ রুপোর টাকা দিয়ে তৈরি হয়েছিল। এই রুপোর মঞ্চ উনি উপহার পেয়েছিল গান করার জন্য।
সে যুগ স্বাধীনতা সংগ্রামের। প্রতিবাদের। দ্বারভাঙার মহারাজা লক্ষ্মেশ্বর সিংহের দরবারে গওহরের মেহফিলের কথা তখন লোকমুখে ছড়িয়ে গিয়েছে। গওহর বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আর্থিক সাহায্য করে চলেছেন। মহাত্মা গান্ধীর কোনও এক কর্মসচিব গওহরকে চিঠি লেখেন। সেখানে গান্ধীর পক্ষ থেকে গওহরকে স্বদেশী আন্দোলনের এক সভায় গান গাওয়ার নিমন্ত্রণ জানানো হয়। বলা হয়, গওহর গান গাইলে ওই সভায় বহু মানুষ আসবেন। সেই সভা থেকে সংগৃহীত অর্থ
স্বদেশী আন্দোলনের জন্য যেন দান করা হয়। ভীষণ গর্বিত হয়ে, আনন্দিত হয়ে গওহর এই সভায় যোগ দিতে রাজি হয়ে যান। ভেবেছিলেন মহাত্মা গান্ধী এসে তাঁর গান শুনবেন, এর চেয়ে সম্মানজনক আর কী-ই বা হতে পারে। গওহরের কাছে সে সময় সব ছিল। নাম, অর্থ, ক্ষমতা। কুড়ি হাজার টাকা খরচ করে বেড়ালের বিয়ে দিয়েছিলেন। ছিল না কেবল সম্মান। গান্ধীজি তাঁর গান শুনবেন জেনে খুব খুশি হয়েছিলেন গওহর। সে কারণেই সভায় যেতে রাজি হয়ে যান। গওহর গান গাইবেন, সভা কানায় কানায় পূর্ণ। সেই সভায় গওহর এলেন, গান্ধীজি এলেন না।
যাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য রাস্তায় ভিড় জমে যেত। এমনকি, দেশলাইয়ের বাক্সে থাকত যাঁর ছবি, সে যুগে যাঁর ছবিওয়ালা রঙিন পোস্টকার্ড কিনে বাড়িতে যত্ন করে রেখে দিত মানুষ, সেই গওহরজান অপমানিত হলেন! গান্ধীজির অনুপস্থিতি তিনি সহজ ভাবে নিতে পারেননি। গওহরের উপস্থিতির জন্য সে দিনের সভায় বহুল পরিমাণে অর্থ সংগৃহীত হয়। গওহর কিন্তু সেই টাকার অর্ধেক উদ্যোক্তাদের দিয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কথা মতো পুরো টাকা দেওয়ার কথা, তিনি অর্ধেক কেন দিলেন? জবাবে গওহর জানান, অর্ধেক কথাই রাখা হয়েছে, গান্ধীজি আসেননি। তাই পুরো টাকা তিনি দেবেন না।
তৎকালীন বঙ্গসমাজ যে গওহরকে নিয়ে মুগ্ধ ছিল তেমন নয়। গওহরের গান শুনে রুষ্টও ছিলেন বহু মানুষ। সে সময় শহরে সং বেরিয়েছিল। গায়ক কবি গোপাল দাস খেউড় লিখলেন— ‘রাইচাঁদ বড়াল আদি করে/বড় বড় ভাইরে ধরে/রেখেছে ভাই বন্ধ করে/কলেতে ভরে/আবার রেখেছে এক মেয়েকে ধরে/তার নাম গহরজান বাই/ধনদৌলত টাকাকড়ি/জুড়ি ঘোড়া ঘরবাড়ি/কলেতে গিয়াছে সব/কিছু বাকি নাই/এখন কলের গানে/মাতিয়ে প্রাণে ন্যাংটা করতে চায়’।
সমাজের ঠাট্টা, অবহেলার পাশাপাশি ভালবাসার টানে একটু একটু করে নিজেকে তখন ফুরিয়ে ফেলতে বসেছেন সুর জাগানিয়া গওহর। একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছিলেন আর সংসার করতে চেয়ে কপালে জুটেছিল বিশ্বাসঘাতকতা। ভালোবাসার যে মানুষটির সঙ্গে গওহর বারাণসী চলে এসেছিলেন, সেই ছগনলালজীর সঙ্গে তখন সম্পর্ক ভাঙনের মুখে। ছগনলাল খুব যত্ন নিয়ে গওহরকে বারাণসীতে রেখেছিলেন। প্রায় দু’বছর তাঁরা একত্রে ছিলেন। ছগন তাঁর প্রতিশ্রুতি মতো মালকা জানকে প্রতি মাসে পাঁচশো টাকা করে পাঠাতেন। কিন্তু আচমকাই গওহরকে কিছু না জানিয়ে ছগন অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করে নেন। তাঁদের মধ্যে বাদানুবাদ চলে। ছগন জানিয়ে দেন, তাঁর স্ত্রী পছন্দ না করলে তিনি আর গওহরের সঙ্গে দেখাও করবেন না। গওহরের হৃদয় ভেঙে পড়ে।
গান গেয়ে নিজেই তিনি যথেষ্ট অর্থ রোজগার করতে পারতেন। ছগনের অর্থ নয়, ভালবাসার জন্য কলকাতা ছেড়ে তিনি বারাণসী চলে আসেন। সেই ছগন তাঁকে স্রেফ ব্যাবহার করে ছেড়ে দিলেন। মনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ১৮৯১ সালে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন গওহর। বুঝতে পারেন, ধনী ব্যাক্তির কাছে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসা বাইজিরা শুধু আমোদের বস্তু।
কলকাতায় ফিরলেন গওহর। নির্বাক! সুরের কাছেও যান না। মা মালকা জান বেশ কিছুদিন সময় দিয়েছিলেন গওহরকে। পরে তিনিই মেয়েকে বোঝান, গওহরের মুক্তি একমাত্র সঙ্গীতেই।
গহরও বেশ কিছু দিন পরে ফিরে যান সঙ্গীতের কাছে। তাঁর সুরের আলোয় বেজে উঠল বিদায় ব্যথার ভৈরবী।
“সে আমাকে ফেলে চলে গেল এবং তার পর একবারও আমার দিকে ফিরেও দেখল না, কোনও প্রশ্ন করল না। আর আমি এর পরেও তার প্রতীক্ষায় বসে আছি, যখন আমার যৌবন অস্ত যাচ্ছে।’’
প্রাণের মানুষের খোঁজ যদিও থেমে থাকেনি। কিন্তু ভাগ্য তাঁর সঙ্গে ছিল না। জীবনে বহু পুরুষ এলেও, অমৃত কেশব নায়ক ছিলেন তাঁর প্রাণের পুরুষ। মুম্বইয়ের এই শায়েরের জন্য দীর্ঘ সময় মুম্বইয়ে কাটিয়েছেন গওহর। অমৃত লিখতেন আর গওহর সেই গানে সুর দিয়ে গাইতেন। তাঁদের বিয়েও হতে পারত। কিন্তু, ১৯০৭ সালে আচমকাই অমৃত মারা যান। আবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় গওহরের হৃদয়।
গওহর রেওয়াজে মন দিলেন। যে রেওয়াজ তাঁর মেজাজ গড়ে তুলছিল। তাঁর সুরের নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলেন অগুনতি মানুষ। গওহর জান মানেই তখন মুলতানি, মালকোষ কিংবা ভূপালি রাগ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দীর্ঘ বিলম্বিত খেয়ালের জায়গায় গওহর বিস্ময়কর ভাবে খেয়াল গাইতে শুরু করেন তিন মিনিটে। এত কম সময়ের মধ্যে খেয়াল উপস্থাপনা করার যে গায়নশৈলী তুলে ধরলেন তা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে নতুন সময়ের সূচনা করেছিল। এতে রাগের ঐতিহ্যগত কোনও ক্ষতি তো হয়ইনি, বরং স্বল্প সময়ে রাগের সুন্দর রূপ প্রকাশ পেয়েছিল। বড় কৃষ্ণভক্ত ছিলেন গওহর। শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখা গানে নিজেকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতেন গওহর। তাঁর গাওয়া মালকোষের ভজন ‘কৃষ্ণ মাধো শ্যাম’ সারা দেশে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। তাঁর গাওয়া ‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি’, ‘আজ কেন বঁধু’, ‘নিমেষেরই দেখা যদি’ বাংলা গানে কেবল বিষণ্ণ, বিপন্ন সুর, মানুষকে এই সময়েও যা আচ্ছন্ন করে রাখে।
তাঁর প্রতিভা আর দক্ষতাকে শান দিয়ে বিভিন্ন শিল্পীদের থেকে সঙ্গীতের কৌশল আরোহণ করে গওহর যখন ব্যতিক্রমী সত্তা গড়ে তুলছিলেন, তখনও তাঁর ব্যক্তিজীবন ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত। বহরমপুরের ধনী জমিদার নিমাই সেনের প্রেমে পড়েন গওহর। নিমাই সেন তাঁকে রানির মতোই তোষামোদ করে রাখতেন। কেমন ছিল তাঁদের প্রেম? শোনা যায়, বহরমপুরে থাকাকালীন গওহর এক বার মাথাব্যথায় ছটফট করছিলেন, ঘরে চা করার জন্য কোনও জ্বালানি ছিল না। খবর পেয়ে প্রেমিক নিমাই সেখানে উপস্থিত হন এবং টাকার নোট পুড়িয়ে সেই আগুনে চা করার ব্যবস্থা করেন। নিমাই সেনের সঙ্গেই প্রথম গওহর মুকুন্দরামের কীর্তন শুনতে যেতেন। গওহরের ভালবাসার মন আবার সংসার করার ইচ্ছে করল। তিনি চাননি ছগনের মতো এই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাক। তিনি নিমাইকে বিয়ের কথা বলেন। নিমাই গওহরকে ভালবাসলেও সামাজিক কারণেই তাঁকে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না। গওহর তাঁর প্রেমিকের মনোভাব বুঝে এই সম্পর্ক থেকে নিজেই বেরিয়ে আসেন। কারও পুতুল হয়ে থাকতে চাননি।
পরবর্তী কালে তাঁর সচিব আব্বাস ক্রমশ গওহরের প্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন। ভালবাসা তো নিছক দেখনদারি। তাঁর চোখ ছিল গওহরের সম্পত্তির উপর। পরিস্থিতি এমন হয় যে, গওহর বাধ্য হন আব্বাসের নামে আদালতে মামলা করতে। এ ভাবেই কেউ ভাই, কেউ প্রেমিক বা স্বামী সেজে তাঁর অর্থ-সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। আর তাঁদের বিরুদ্ধে যেতে প্রায়শই গওহরকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। প্রতিটি মামলাই তিনি জেতেন। কিন্তু বিনিময়ে প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যায়। ভালবাসা মেলে না। ভালবাসার মানুষের জন্য সেই আকাঙ্ক্ষা, সেই তৃষ্ণা তাঁর কোনও দিন মেটেনি।
“অ্যায় মহব্বত তেরে অনজাম পে রোনা আয়া
জানে কিঁউ আজ তেরে নাম পে রোনা আয়া...”
এক দিকে, দেশজোড়া খ্যাতি। অন্য দিকে, সব কিছুর অলিন্দে ব্যক্তিগত জীবনে নিঃসঙ্গতায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন গওহর। সঙ্গীহীন, সঙ্গহীন, একাকী গওহরের ভাঁড়ার শূন্য হতে থাকে। একা থাকতে পারছিলেন না আর। শরীরে ও মনে বয়সের ছাপ পড়তে লাগল। সঙ্গীত মহলে তাঁর গুরুত্ব কমে আসছিল। তাঁর গান গাওয়ার ইচ্ছেও ফুরিয়ে আসছিল।
গওহর বাধ্য হন কলকাতা ছাড়তে। পাড়ি দেন মহীশূরে (অধুনা মাইসুরু)। ১৯২৮ সালে মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে মহীশূরের রাজদরবারে সভাগায়িকা নিযুক্ত হন গওহর। দু’বছর পরে, ১৭ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন গওহর। মন অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ বার প্রাণ গেল।
“আমার শবযাত্রার যারা প্রতিনিধিত্ব করছে, তারাই তো আগে আমার জীবন নিঃশেষ করে ফিরেছে।“ (মির্জা গালিব)
অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়