‘গুলমোহর’ অনুভব করায়, ভালবাসার বাড়ি আসলে তিল তিল করে গড়ে ওঠে পরিবারের কাছের মানুষদের ঘিরে। চারটি দেওয়াল এবং মাথার উপর ছাদকে ঘিরে নয়। ছবি: সংগৃহীত।
২০১০ সালের ২৫ নভেম্বর। তার পর ১২ বছরের বিরতি। এক দশকের দীর্ঘ বিরতির পর ক্যামেরার সামনে ফিরলেন শর্মিলা ঠাকুর। তা-ও আবার অমোল পালেকর এবং মনোজ বাজপেয়ীর মতো দক্ষ তারকাদের সঙ্গে জোট বেঁধে। কিন্তু শর্মিলা এলেন অন্য অবতারে। এ বার আর বড় পর্দায় নয়, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে এই প্রথম বার অভিনয় করতে দেখা গেল শর্মিলাকে। শুক্রবার ডিজনি প্লাস হটস্টারে মুক্তি পেয়েছে রাহুল ভি চিত্তেল্লা পরিচালিত ছবি ‘গুলমোহর’। শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে এই ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপেয়ী, অমোল পালেকর এবং সিমরন। পার্শ্বচরিত্রে চন্দন রায়, অনুরাগ অরোরার পাশাপাশি বহু নতুন মুখ।
‘গুলমোহর’ ছবির গল্প বাত্রা পরিবারকে ঘিরে, সেই পরিবারের ৩৪ বছরের ঠিকানা ‘গুলমোহর ভিলা’কে ঘিরে। ছবিটি শুরু হয় গানের আসর দিয়ে। পরিবারের সকল সদস্য জমায়েত হয়েছে এক ঘরের ভিতর, শেষ বারের মতো। কারণ নয়াদিল্লির যে দোতলা বাংলো তাঁদের সকলের ঠিকানা ছিল, সেখানে আর মাথা গুঁজে থাকার ঠাঁই মিলবে না কারও। বাংলোর পরিবর্তে সেখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবে বহুতল। পরিবারের সদস্যরাও কেউ পুদুচেরিতে, কেউ গুরুগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। এই শেষ বারের মতো ‘গুলমোহর’-এ পুরো বাত্রা পরিবারের এক হওয়া। তা-ই বাড়ির প্রধান কুসুমের (শর্মিলা ঠাকুর) ইচ্ছা, যেন ‘গুলমোহরে’ পুরো পরিবার হোলির অনুষ্ঠান সেরে নিজেদের নতুন ঠিকানায় যায়।
কুসুমের পুত্র অরুণ-সহ (মনোজ বাজপেয়ী) পরিবারের অন্য সদস্যরাও কুসুমের এই ইচ্ছাপূরণে সম্মতি জানায়। শুরু হয় নতুন বাড়িতে যাওয়ার জন্য জোগাড়যন্তর। এই চরম ব্যস্ততার মধ্যে পরিবারের সকলের জীবনে ব্যক্তিগত সমস্যা, সম্পর্কের টানাপড়েন ফুটে উঠতে থাকে পর্দায়। শুধু পরিবারের সদস্যই নয়, বাত্রা পরিবারের দৈনন্দিন কাজে যারা হাত লাগায়, তাদের জীবনের ভাল লাগা, মন্দ লাগাও ফুটে উঠেছে ‘গুলমোহর’ ছবির গল্পে।
ছবি শুরু হওয়ার মুহূর্তেই ‘গুলমোহর’ মনে করিয়ে দেয় মীরা নায়ার পরিচালিত ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবির কথা। যেন সেই আদলেই তৈরি করা। কিন্তু দু’ঘণ্টা দীর্ঘ এই ছবিটি কোথাও যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, শুধুমাত্র চার দেওয়াল এবং মাথার উপর ছাদ থাকলেই তা ‘বাড়ি’ হয়ে যায় না। ভালবাসার বাড়ি আসলে তিল তিল করে গড়ে ওঠে পরিবারের কাছের মানুষদের ঘিরে। এক দশক পর শর্মিলার অভিনয় যেন ঠিক আগের মতোই নজরকাড়া, ঠিক আগের মতোই অভিজাত।
বাদ পড়েননি অমোল পালেকরও। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ফরজ়ি’ ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল অমোলকে। কিন্তু ‘গুলমোহর’ ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রমাণ করল যে তিনি জাতশিল্পী। ছবিতে অন্য তারকারা থাকলেও প্রতিটি ফ্রেমে বলে বলে ছক্কা মেরেছেন মনোজ বাজপেয়ী। সংলাপ ছাড়াও কী ভাবে চরিত্রের অনুভূতি পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায়, তা ভালই জানেন অভিনেতা।
মনোজের পাশাপাশি তাঁকে টক্কর দিয়েছেন সিমরন। ছবিতে মনোজের স্ত্রী ইন্দুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সিমরনের অভিনয় বেশ দৃঢ়। মনোজের পাশে তাঁর অভিনয় কোথাও ফিকে পড়েনি। ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজ়ের বিকাশ চরিত্রে চন্দন রায় তাঁর অভিনয়দক্ষতা যে ভাবে ফুটিয়ে তোলার জায়গা পেয়েছেন, ‘গুলমোহর’ ছবিতে সেই সুযোগ মেলেনি। তবে, অল্প হলেও ওই ছবিতে মজার খোরাক জুগিয়েছেন তিনিই।
কিন্তু এত ভালর মধ্যেও ফাঁক থেকে গেল ‘গুলমোহরে’র অন্দরমহলে। ছবির গতি এবং চরিত্রের বুননই যেন এই ছবির নেতিবাচক দিক। ছবির প্রথমার্ধ পর্যন্ত ধীর লয়ে এগোনোর পর যেন দ্বিতীয়ার্ধে গল্পের গতি যেন ঘোড়া ছুটিয়ে এগোতে থাকে। ফলে কোনও সম্পর্কের রসায়ন সঠিক ভাবে ফুটে ওঠেনি। দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য যে পরিমাণ যত্ন নিয়ে চরিত্র বুনতে হয়, তাতে ফাঁক ধরা পড়েছে মাঝেমধ্যেই। যেন এক লহমায় সকলের জীবনের সমস্যা দেখা দিয়ে তড়িঘড়ি পালিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে শেষ হওয়া ‘ফ্যামিলি ড্রামা’ ঘরানার এই ছবি তাই দর্শকের বেশি দিন মনে থাকবে না। কিন্তু ‘গুলমোহর’ দর্শকের মনে রেখে যাবে তার সংলাপ। কখনও শর্মিলার মুখে, কখনও মনোজের মুখে, কখনও বা চন্দনের মুখে— প্রতিটি সংলাপ যেন মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
সমকামিতা থেকে শুরু করে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের রসায়ন— সবকিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ছবিতে। ‘গুলমোহর’ যেমন অন্দরমহলে গানের আসর দিয়ে শুরু হয়েছিল, ঠিক তেমনই নাচ-গানের আসর দিয়ে শেষে সেজে উঠেছে ‘গুলমোহরে’র বাহিরমহলও। সব শেষে বলা যায়, ১২ বছর পর অভিনয়জগতে ফিরে এসে শর্মিলা দর্শককে একটি মন ভাল করা ছবি উপহার দিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy