(বাঁ দিক থেকে) লিলি চক্রবর্তী, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, বরুণ চন্দ, অনসূয়া মজুমদার এবং বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সোমবার রাতে জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। অন্য দিকে, মঙ্গলবার আরজি কর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের শুনানিকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন জনগণ। তবে আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে এখনও চলছে প্রতিবাদ। মিছিলে বা অবস্থানে বিশিষ্টদের একাংশকে দেখা গিয়েছে সেখানে। কিন্তু, বর্ষীয়ান শিল্পীদের সিংহভাগই প্রতিবাদে শামিল হতে পারেননি। নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রতিবাদ প্রসঙ্গে তাঁদের অবস্থান এবং রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মতামত জানালেন টলিপাড়ার পাঁচ বর্ষীয়ান অভিনেতা।
মাঝে তাঁর শরীর ভাল ছিল না। কিন্তু পরান বন্দ্যোপাধ্যায় পর পর শুটিং করছেন। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে নিয়মিত খবর রাখছেন তিনি। পরান বললেন, “শরীর নিয়ে যে খুব সমস্যা এমন নয়। সমস্যা হল আমাকে ঘিরে যে ভিড়টা হবে, সেটায়। এখন ভিড়ে একটু সমস্যা হয়। কিন্তু, প্রয়োজনে বা মন অবাধ্য হয়ে গেলে তখন শরীর আর সে সবের তোয়াক্কা করবে না। মন চাইলে আবার বেরিয়ে পড়ব।” এর মধ্যে তাঁকে দেখা গিয়েছে, বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিছিল দেখেছেন পরান। সম্প্রতি বাড়ির কাছেই একটি অবস্থান মঞ্চে কিছু ক্ষণের জন্য উপস্থিতও ছিলেন তিনি।
শিল্প জগতে অতীতেও একাধিক প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছেন ‘টনিক’-এর অভিনেতা। কিন্তু আরজি করের ঘটনায় রাজ্য জুড়ে যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে শুরু হয়েছে, তাকে ‘নজিরবিহীন’ বলেই উল্লেখ করতে চাইলেন পরান। বললেন, “এর আগে হয়তো আরও মহৎ উদ্দেশ্যে সমাজে জমায়েত হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আর কোনও প্রতিবাদের এই রূপ আমি দেখিনি।”
পরান জানালেন, ইচ্ছে থাকলেও তিনি নিয়মিত প্রতিবাদ মিছিলে উপস্থিত থাকতে পারছেন না। তাঁর কথায়, “বয়স হয়েছে। কী আর করা যাবে। তবে বাড়িতে বসেও তো মনটা ছটফট করে।” বছর সাতেক আগে নাট্য জগতের একটি প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছিলেন পরান। সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললেন, “উত্তেজনার বশে পায়ে সমস্যা নিয়েও হেঁটেছিলাম। কিন্তু পরে টের পেলাম খুব সমস্যা হয়েছে।”
সম্প্রতি প্রতিবাদে শামিল হওয়া নিয়ে তারকাদের কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে। প্রতিবাদে শামিল হওয়ার ‘ব্যাকরণ’ নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন নেটাগরিকদের একাংশ। তাঁদের অবশ্য পাত্তা দিতে নারাজ পরান। বললেন, “যিনি নির্দেশ দিচ্ছেন, তাঁকে সেই অধিকার কে দিয়েছেন! তিনি নিজে কী করছেন? যাঁর যখন ইচ্ছে, যে ভাবে খুশি তিনি সেই ভাবে প্রতিবাদ করবেন।”
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নির্যাতিতার কথা ভেবে দুঃখ করছেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী। বললেন, “আমি সব খবর পাই। দ্রুত বিচারের আশায় রয়েছি।” অভিনেত্রী নিজে সাবধানে ধারাবাহিকের শুটিং করছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্যই তিনি প্রতিবাদ মিছিলে যেতে পারছেন না। বললেন, “আমার হাঁটুর হাড় ক্ষয়ে গিয়েছে। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। বেশি ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। কী ভাবে প্রতিবাদে যাব?”
এক সময়ে টলিপাড়ার প্রতিবাদে নিয়মিত অংশ নিতেন লিলি। জানালেন, সাধারণত এক দিনের কোনও জমায়েত বা কোনও মিছিলের সাক্ষী তিনি থেকেছেন। কিন্তু, এক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও জনগণের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন তিনি আগে কখনও দেখেননি। লিলির কথায়, “উত্তমদা বা সৌমিত্রদার সঙ্গে মিছিলে হেঁটেছি। মিছিল শেষ হলে তার পর আমরা আমাদের গাড়িতে করে যে যার বাড়িতে ফিরে যেতাম। কিন্তু, রাতের পর রাত মহিলা-পুরুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন! আমি দেখিনি। আমি তাঁদের কুর্নিশ জানাই।”
গত এক মাসে বিভিন্ন সময়ে আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে শামিল হয়ে তারকাদের যে ভাবে কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে, তা অভিনেত্রীকে ব্যথিত করেছে। লিলি বললেন, “সকলেই জমায়েতে যাচ্ছেন, ছবি তুলছেন। সেগুলি ফেসবুকে পোস্ট করছেন, কোনও দোষ নেই। কিন্তু তারকারা কোনও পদক্ষেপ করলেই তা নিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে। এই বিষয়টা আমার খুবই খারাপ লাগছে।”
এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটেননি অভিনেতা বরুণ চন্দ। বললেন, “বয়স হচ্ছে। কোনও মিছিলে গিয়ে একশো গজ হেঁটে তার পর বেরিয়ে আসতে চাই না। এই মুহূর্তে আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থাও ভাল নেই।” তবে এই আন্দোলনকারীদের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলেই জানালেন বরুণ।
বরুণের বিশ্বাস, আরজি করের ঘটনায় নাগরিক সমাজের এক জন মানুষও শান্তিতে নেই। প্রত্যেকের জীবনেই গভীর প্রভাব পড়েছে। তাই, বয়োজ্যেষ্ঠ বলে বা অন্য কোনও কারণে যাঁরা প্রতিবাদে শামিল হতে পারেননি, তাঁদের যেন অসম্মান করা না হয়। বরং তাঁর মতে, এই ধরনের মানুষের জন্য অন্য রকম কোনও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বরুণ বললেন, “কোনও সই সংগ্রহ কর্মসূচি থাকলে আমি সকলের আগে সেখানে সই করতে রাজি। আমার মনে হয়, আরও অনেকেই সেখানে সই করতে রাজি হবেন।”
তারকাদের দিকে ক্রমাগত ধেয়ে আসা কটাক্ষের বিষয়গুলি সম্পর্কে অবগত ‘সীমাবদ্ধ’ খ্যাত অভিনেতা। পাশাপাশি বিশিষ্টদের একাংশের বেফাঁস মন্তব্যও তিনি শুনেছেন। বরুণ বললেন, “মানুষ এখন খুবই সংবেদনশীল। তাঁদের সহনশীলতাও এখন কম। তাই তারকাদের খুব বুঝেশুনে কথা বলা উচিত।” বরুণের মতে, সাধারণ মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করছেন। সেখানে তাঁদের পাশে সমব্যথী এবং সমমনস্কদেরই তাঁরা আশা করছেন।
টলিপাড়ার আর্টিস্ট ফোরামের অবস্থানে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী অনসূয়া মজুমদার। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে চলতে থাকা আন্দোলনের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। অনসূয়া বললেন, “মিছিলে আমি হাঁটতে পারিনি। পায়ে ব্যথা রয়েছে বলেই আমার একটু হাঁটতে কষ্ট হয়।”
তবে শিল্পীদের যে ভাবে কটাক্ষের শিকার হতে হচ্ছে, তা দেখে হতাশ অনসূয়া। তাঁর কথায়, “কিছু বললেই তো আবার ট্রোলিং শুরু হবে। তাই আলাদা করে কিছু বলতে চাই না।” তবে, আরজি করের ঘটনায় দোষীদের দ্রুত শাস্তির দাবি জানালেন অনসূয়া। বললেন, “বিচার হোক, আমার চারপাশের সকলে যা চাইছেন, আমিও সে রকম দ্রুত ন্যায়বিচার চাই।”
আরজি কর-কাণ্ডের পর থেকে গত এক মাসে রাজ্যের অস্থির পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “ইচ্ছে তো করে। কিন্তু আমার পায়ের সমস্যা রয়েছে। কোথাও গিয়ে তার পর আমার জন্যই যদি বাকিরা সমস্যায় পড়েন, সেই দুশ্চিন্তা হয়।”
বরং বিপ্লব মনে করেন, প্রতিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে নির্ভর করে। তাই কেউ বাড়িতে বসে থাকলে কেউ যে এই ঘটনার প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করছেন না, সে কথা মানতে নারাজ বর্ষীয়ান অভিনেতা। তাঁর কথায়, “আমি তো বাড়িতে বসে একটা কবিতা লিখে বা ছবি এঁকেও আমার প্রতিবাদ জানাতে পারি। প্রতিবাদের নিয়ম যদি কেউ ঠিক করে দেন, তা হলে তো মুশকিল!”
বিপ্লবের মতে, রাজনীতির বাড়বাড়ন্তে সমাজের সিংহভাগ মিছিলের নেপথ্যেই কোনও না কোনও স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। বললেন, “আমরা শিল্পীরা যখন মিছিলে হাঁটতাম, ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে হাঁটতাম। কোনও বিভেদ ছিল না। অনেক দিন পর আজকের এই প্রতিবাদকেও আমার সে রকম মনে হচ্ছে, যেখানে মানুষ কোনও বিভেদকে মাথায় না রেখেই অংশ নিচ্ছেন।”
আরজি করের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে পর পর বেশ কিছু শুনানি হয়েছে। জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি মেনে নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু, ন্যায়বিচার পেতে খানিকটা সময় লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর কতদিন মানুষ প্রতিবাদে শামিল হবেন, সেই চিন্তা বিপ্লবকে ভাবাচ্ছে। বললেন, “প্রত্যেকের একটা জীবন রয়েছে। তার থেকে সময় বার করে সকলে যে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন দেখে আমি খুশি। আমরা যদি কঠোর হই, তা হলে কিন্তু ভবিষ্যতে আর এই ধরনের অপরাধ ঘটবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy