Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

হোক অর্ণব

রেওয়াজ করেন ঢাকার গুলশনে বসে। অথচ সে গান কিনা আছড়ে পড়ে যাদবপুরের ক্যাম্পাসে! সায়ন চৌধুরী অর্ণব নিজেও জানতেন না তাঁর ‘হোক কলরব’ এই ভাবে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদের গান হয়ে উঠবে। ক’দিন আগে কলকাতা ঘুরে যাওয়া গায়কের মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।রেওয়াজ করেন ঢাকার গুলশনে বসে। অথচ সে গান কিনা আছড়ে পড়ে যাদবপুরের ক্যাম্পাসে! সায়ন চৌধুরী অর্ণব নিজেও জানতেন না তাঁর ‘হোক কলরব’ এই ভাবে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদের গান হয়ে উঠবে। ক’দিন আগে কলকাতা ঘুরে যাওয়া গায়কের মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

হোক কলরব ফুলগুলো সব
নীল না হয়ে লাল হল ক্যান
অসম্ভবে কখন কবে
মেঘের সাথে মিল হল ক্যান

সেলিব্রিটি হলেই বুঝি দেরিতে আসতে হয়?
(হালকা হেসে) আমি আবার কীসের সেলিব্রিটি! আমি তো পালিয়ে পালিয়েই বাঁচতে চাই। আজকাল চারিদিক খুব বদ্ধ লাগে। ভীষণ ডিপ্রেসড আমি...

সে কী! অর্ণব বলতেই তো আজকের প্রজন্ম পাগল। তার পরেও এমন হতাশা?
দেখুন, আমার জীবনটা স্টুডিয়োতে কাটে আজকাল। দমবন্ধ ঘর। দিন-রাত বোঝা যায় না। আর এখন যা সিস্টেম তাতে স্টুডিয়োতে মিউজিক করা আর গতানুগতিক টাইপ করা, দু’টোই সমান। গায়ক-মিউজিশিয়নদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানই হয় না। শান্তিনিকেতনের খোলা হাওয়ায় ১৭ বছর কাটিয়েছি আমি। আজকের পরিবেশ পোষাচ্ছে না। আর শুনুন, লোকে আমায় গায়ক ভাবে। আমি কিন্তু গায়ক নই। গান গাওয়ার ইচ্ছেও আর নেই।

যা বলছেন ভেবে বলছেন তো। আজ ‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে’ তো অর্ণবের গান হয়ে গিয়েছে। এর পরেও এত মনমরা?
রবীন্দ্রনাথের ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ গানটা আমার গান হিসেবে অনেকে ভালবেসেছে। এই তো দেখলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে দশ হাজার মানুষ একটানা ওই গানটা গেয়ে গেল। আমাকে তো ওরা গানটা গাইতেই দিল না। বাংলাদেশ এবং কলকাতায় এখন আমার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো বাবা আর মেয়ে একসঙ্গে বসে শুনতে পারে। আগে ‘বাবা-মা কী সব শোনে’ বলে ছেলেমেয়েরা নাক সিঁটকোত।


তার মানে নতুন প্রজন্ম কোথাও আপনার গান রিলেট করতে পারছে...
এখন সবাই গিটার বাজায়। আমি যখন দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে নানারকম মিউজিক্যাল অ্যারে়ঞ্জমেন্ট চেঞ্জ করে রবীন্দ্রনাথের গান গাই, আমার মনে হয় নতুন প্রজন্ম সেটার সঙ্গে রিলেট করতে পারে। বলতে পারেন এটা আমার সাফল্য।

আর ‘হোক কলরব’?

ওটা এখন আর আমার গান কোথায়! ওটা যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের গান হয়ে গিয়েছে। দেখুন দশ বছর এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছি। আমি আসলে গান বাঁধতে ভালবাসতাম। শান্তিনিকেতনে পড়তে পড়তেই ল্যাজ গজিয়ে ছিল আমার।

ল্যাজ গজিয়ে ছিল মানে?

বাংলাদেশে আর শান্তিনিকেতনে দেখলাম গান বাঁধছে। মনে হল আমিও গান বাঁধি। শান্তিনিকেতনে শান্তিদেব ঘোষের মতো গান গাইব, নাকি গিটার বাজিয়ে গাইব— এই কনফিউশন থেকেই ফিউশনের জন্ম হল। গান বাঁধলাম। কিন্তু যখন দেখলাম আমার গানগুলো কেউ গাইছে না, তখন আমি নিজেই গেয়ে বসলাম। বাংলাদেশে ছবির গানের মানও একটা সময়ে অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল। তখন ‘মনপুরা’ ছবির জন্য গান লিখলাম। অনেক করেছি, আর না।

কিন্তু শান্তিনিকেতন থেকে সোজা ঢাকা কেন? কলকাতা কী দোষ করল?

বাংলাদেশে মায়ের কাছে মাছভাত খাওয়া, আদরে বাঁদর ছেলে আমি। ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারতাম না। আর কলকাতায় থাকব বললেই তো আর হল না। ভিসা নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। অত চাপ কে নেবে?

ভেতো বাঙালি না হয় বুঝলাম, তাই বলে মুম্বইতে প্রীতম গান গাইতে ডাকল। আপনি সেটা গাইলেন না!

আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না, প্লিজ। মুম্বই গিয়েছিলাম একবার। আমি প্রীতমের খুব ভক্ত তাই ওকে ফোন করেছিলাম। তখন অরিজিৎ সিংহ ফোনটা ধরেছিল। ও বলল, ‘‘অর্ণব, তোমার গানের ফ্যান আমি। এক্ষুনি চলে এসো। প্রীতমদা একটা দারুণ গান রেখেছে তোমার জন্য। তুমি গাইলেই সুপারহিট।’’

আপনি তাও গেলেন না? গানটা কী ছিল?

বিশ্বাস করুন, গানটা আমি জানতে চাইনি। আমি ঝটপট কিছু করতে পারি না। আজ গিয়ে আজই গান গেয়ে দিলাম— তাও আবার হিন্দিতে... পারতাম না। সত্যিই পারতাম না।

আজও তার জন্য মন খারাপ...

হ্যাঁ, আফসোস হয়। তবে ভাবি গানটা যদি প্রীতমের চাহিদা অনুযায়ী গাইতে না পারতাম, নাম তো আমারই খারাপ হত।

এত সাফল্যের পরেও গাইতে না পারার ভয়? ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত তো ‘খাদ’‌য়েও আপনাকে দিয়ে একটা গান গাওয়াতে চেয়েছিলেন। সেটা গাইলেন না কেন?

ইন্দ্রদীপদার সঙ্গে পরমব্রত আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। ‘সে যে বসে আছে’ গানটা ইন্দ্রদীপদার খুব পছন্দ হয়েছিল। ওর বাড়িতে একদিন রান্না করে খাইয়েও ছিল আমায়। ‘খাদ’‌য়ের জন্য ‘মুঠো আজ দিলাম খুলে’ গানটা ঢাকা থেকে রেকর্ড করে পাঠিয়েছিলেম আমি। কিন্তু সিনেমার জন্য গানটা একটু অন্য ভাবে গাইতে হত। তার জন্য ইন্দ্রদীপদা আবার আমায় কলকাতায় আসতে বলেছিল। আমি আর আসিনি। ইন্দ্রদীপদাকে বললাম, ‘‘তুমিই গানটা গেয়ে দাও।’’ ইন্দ্রদীপদা আমার গানটা তাও বোনাস ট্র্যাক হিসেবে রেখেছিল। ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

আচ্ছা একটা কথা বলুন তো। অনেকে বলেন অনুপম রায় নাকি আপনাকে নকল করেন।

এটা একদম ভুল। অনুপম দেখা করেছে আমার সঙ্গে। ও বলেছে আমার গান ওকে ইন্সপায়ার করে। অনুপম যে সহজে বলতে পারে, এটাই অনেক। ‘পিকু’তে ও দারুণ গেয়েছে। ওকে অভিনন্দন। মুম্বইতে বাঙালিরা আবার যদি শচীন দেব বর্মন, আর ডি বর্মনের মতো নিজস্ব জায়গা করতে পারে, তার চেয়ে আনন্দের আর কিছু হবে না।
তবে বাঙালি মিউজিশিয়নরা যেন মুম্বইয়ে আইটেম নম্বরের দ্বারা চালিত হয়ে না যায়।

কলকাতায় পারফর্ম করতে গিয়ে কখনও মনে হয়নি রূপম ইসলামের মতো স্টেজটাকে দাপটের সঙ্গে ব্যবহার করে দর্শকদের আপনি নাচিয়ে তুলতে পারছেন না? নরম গায়কি আর সিরিয়াস কথা দিয়ে আজকের প্রজন্মকে কি টানা যায়?

ক্ল্যাপ দেওয়ার জন্য, নেচে গাওয়ার জন্য প্রচুর গান আছে। সেটা থাক। তবে প্রচণ্ড নাচানাচির মাঝে একটা সফট গান গেয়ে দেখেছি নতুন প্রজন্ম ফেসবুক বন্ধ রেখে আমার গান শোনে। আমরা আসলে দর্শকদের আন্ডারএস্টিমেট করি।

আপনিও কিন্তু নিজেকে আন্ডারএস্টিমেট করছেন।

যা করছি ভেবেই করছি। টাকাপয়সার জন্য গান গাইতে রেকর্ডিং স্টুডিয়ো আর পাবলিক শোয়ের পিছনে ছুটতে ছুটতে দেখেছি আমার গান গাওয়া, গান শোনা কিছুই হচ্ছে না। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন কার গান শুনছি, কার গান ভাল লাগছে—আমি বলতে পারব না। আমার অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টা রেওয়াজের দরকার। কোথায় করছি সে সব? মিডিয়া, পিআর — এ সবের মধ্যে গান ঢোকালে গান হারিয়ে যাবে।


গান যখন প্রতিবাদের হাতিয়ার: হোক কলরব ফেসবুক পেজেও।
সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

ত লোকে তো প্রোফেশনালি গান গাইছেন, তাঁদের গান কি হারাচ্ছে?

গাইছেন, তবে দেখবেন বেশির ভাগেরই লোক বা কোনও প্রতিষ্ঠান বা মিডিয়া পিছনে আছে। যারা বলছে তুমি গেয়ে যাও বাদবাকিটা আমরা দেখে নেব। আমার তেমন কেউ নেই। গায়ককে নিজেকে যদি মিডিয়া হাউজে বিক্রি করাতে হয়, তা হলে তার গান বা সম্মান কোনওটাই থাকে না।

গান ছেড়ে কী করবেন তা হলে?

প্রোফেশনালি গান গাওয়া ছেড়ে গানচর্চা করব। আমি ভিশুয়াল আর্টসের ছাত্র। ঢাকায় ভিশুয়াল আর্টস পড়াতে চাই।

তা হলে অগুন্তি মহিলা বান্ধবীদের কী হবে?

আমার বান্ধবীরাই আমাকে সামলায়, আমাকে দেখতে হয় না। তবে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে বলেছে প্রেম নিয়ে যেন আমি খুব বেশি নাড়াচাড়া না করি।

ওহ! এখন গানের মতো প্রেমও বাদ?

আমি ফসফস করে প্রেম করি। আর প্রেমে পড়ে এত আনন্দ পাই যে কাজকর্ম ভুলে গিয়ে প্রেম নিয়েই থাকি। এটা খুব একটা ভাল ব্যাপার নয়।

সাহানার সঙ্গে প্রেমটা আছে তো?

হ্যাঁ, ওটা আছে। সতেরো বছর শান্তিনিকেতনে একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। এখন সাহানা অবশ্য ঘোরতর সংসারী। এই তো সে দিন বলল, ঢাকায় অনুষ্ঠান করতে চায়। মাঝেমধ্যে আবার ইউটিউবে গানের লিঙ্ক মেল করে আমায় বলে, ‘‘তোর ফেসবুকের ওয়ালে পোস্ট করে দে প্লিজ।’’ আমিও মজা করে বলি, ‘‘করব, একটা শর্তে। আমায় এক্ষুনি একটা গান লিখে পাঠা।’’ এ রকমই চলছে...

নতুন কি কিছু চলবে?

একটা অ্যালবাম করব। ‘খুব ডুব’ নামটাও ভেবে ফেলেছি। সেটা করার পরেই প্রোফেশনাল গানের জগৎ থেকে একদম ডুব মারব। ধুর... প্রোফেশনাল গায়কদের কেউ মানুষ হিসেবেই দেখে না। ইচ্ছে হলে মাথায় তোলে। ইচ্ছে হলে নীচে নামায়... আমি মাটির কাছের মানুষ হতে চাই।

আনাচে কানাচে

চেনা চাঁদ চলে যায় রিক্সায়: পাওলি। ছবি: কৌশিক সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE