জয় গোস্বামীর সঙ্গে লেখক। নিজস্ব চিত্র।
সেটা আশির দশকের শেষ দিক। রবীন্দ্রসদনে দেখতে গেছি ‘চৈতালি রাতের স্বপ্ন’। রবীন্দ্রসদনের বারান্দায় দেখা অরুণ মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে। বললেন ‘তুমি কৌশিক না?’ আমি বললাম ‘হ্যাঁ স্যার।’ বহরমপুরে নাট্য আকাদেমির ওয়ার্কশপে অরুণবাবু ছিলেন আমাদের ক্যাম্প ডিরেক্টর। অরুণবাবু বললেন ‘তুমি সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপে চান্স পেয়েছ।’ আমার তখন মনে হচ্ছে আমি উড়ছি। তারপর গিরিশ মঞ্চে নাট্য আকাদেমির কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিলাম আমি। আর স্বপ্নের মতো খুলে যেতে লাগল এক একটা দরজা। তাপস সেন, খালেদ চৌধুরী, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, মনোজ মিত্র— সে এক নক্ষত্র সমাবেশ। আজ স্বীকার না করলে অন্যায় হবে, বহরমপুর আর কলকাতার সেই ওয়ার্কশপে যোগ না দিলে আমি হয়তো নাটকের মানুষ হয়ে উঠতামই না। থিয়েটার যে কত বড়, কত ঐতিহ্যশালী সে বোধ আমাকে তৈরি করে দিয়েছিল কলকাতার সেই ওয়ার্কশপ।
নব্বই-এর দশকে নাট্যরঙ্গ আয়োজন করেছিল নাট্যরচনা বিষয়ক এক প্রশিক্ষণ শিবির। সেখানে দেবাশিস মজুমদার ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের বোঝাতেন নাট্যরচনার কৃৎকৌশল আর দর্শন। সেখানেই প্রথম লেখা ‘নতুন বাড়ির পলেস্তারা এবং ‘তিরিশ বছর আগের একজন।’ আনন্দবাজার লিখেছিল বাংলা নাটকের সবচেয়ে বড় নাম। এই নাটকের সূত্রেই ১৯৯৯ এ সুন্দরম আমাকে দিলেন পার্থপ্রতিম স্মারক পুরস্কার। তার কিছু দিনের মধ্যেই থিয়েটার ওয়ার্কশপ আমাকে আর ব্রাত্য বসুকে যৌথভাবে দিলেন সত্যেন মিত্র পুরস্কার। তারপর স্বপ্নসন্ধানী’র শ্যামল সেন স্মৃতি সম্মান, নটধা’র সুতপা স্মারক সম্মান, অন্য থিয়েটার-এর অন্য থিয়েটার সম্মান ... আরও অনেক পেরিয়ে এ বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিলেন শম্ভু মিত্র পুরস্কার।
পাঠক হয়তো ভাবছেন পুরস্কারের ফিরিস্তি শোনাচ্ছি কেন ? অনেকেই বলেন মহানগর আমাকে স্বীকৃতি দিল না। তাই নিয়ে রয়ে যায় হা-হুতাশ। আমার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। পুরস্কার আর সম্মান আমাকে অনেক দিয়েছে কলকাতা। কিন্তু মজাটা হচ্ছে নাটক করতে ডেকেছে খুব কম। হাতে গোনা। কলকাতার নাট্যজনেরা বেশির ভাগই আমার কাজ তেমন দেখেননি বা দেখার সুযোগ করে উঠতে পারেননি। তার একটা বড় কারণ তিরিশ বছরে একবার ছাড়া আমাদের দল ‘শান্তিপুর সাংস্কৃতিক’ কোনওদিন নিজের উদ্যোগে কলকাতায় হল বুক করে অভিনয় করেনি। কিন্তু উল্টো পথ কি খোলা ছিল না ? শান্তিপুরে আসতে পারতেন না তারা ? কিন্তু সে ধকল নেওয়ার মন-মানসিকতা মহানগরের থাকে না। একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম অরুণ মুখোপাধ্যায়। যিনি আমার প্রায় সব কাজ দেখেছেন। জলে, ঝড়ে, মাটিতে, খড়ের উপর বসে তিনি দেখে গেছেন আমাদের একের পর এক কাজ। কখনও কেউ কেউ হঠাৎ এসে পড়েছেন ঠিক। কিন্তু যে ধারাবাহিকতায় আমরা একশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে থিয়েটার দেখে আসছি কলকাতায়, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মধ্যরাতে নির্জনে বাড়ি ফিরেছি রাতজাগা কুকুরের সঙ্গে গল্প করতে করতে— এর উল্টো ছবিটা দেখাবার সাহসই হয়নি কলকাতার।
নটধা হাওড়ার দল হলেও কলকাতায় অভিনয় করে। সেই সূত্রেই এই শতকের গোড়ার দিকে জেলা কলকাতা মিলিয়ে তারা নির্মাণ করেছিলেন মহাভারত। সেই আমার প্রথম কলকাতায় অভিনয় করতে যাওয়া। আমার জেলার বন্ধুদের সাথে বিভাসদা, দ্বিজেনদা, মেঘনাদদা, সীমাদি, সাধনাদি’র সাথে একসাথে অভিনয়। আমি দুর্যোধন। বিভাসদা ধৃতরাষ্ট্র। সীমাদি গান্ধারী। কলকাতার অনেকেই মুখটিপে হেসেছিলেন হয়তো সেই প্রযোজনার মান দেখে। সামনে প্রশংসা, পিছনে বিদ্রুপ। কিন্তু আমার বা শ্রাবণী বণিক (দ্রৌপদী) বা গৌতমদা (শকুনি) মানে গৌতম মুখোপাধ্যায় এর কাছে এ প্রযোজনা ছিল এক উজ্জ্বল স্মৃতি। সেই ভোরের ট্রেনে এসে মাঝরাতে ফিরতাম মহলা দিয়ে। সেই সূত্রেই কেউ কেউ বলেছিলেন আমার অভিনয় নাকি মন্দ হয়নি। তারপরও অভিনয় করেছি সুরঞ্জনাদি’র সঙ্গে, বেলঘরিয়া এথিক-এর সঙ্গে। কিন্তু যাকে বলে কলকাতার হয়ে যাওয়াটা কোনোওদিনই হয়নি। কারণ মহানগরে রয়ে যেতে গেলে শিকড় কেটে আসতে হয়। আমি তা পারিনি। বলা ভালো পারতে চাইনি। আমি শান্তিপুরের কৌশিক নামেই অন্যের ফোনবুকে রয়ে যেতে চেয়েছি। অন্য থিয়েটার তাদের নাট্যস্বপ্নকল্পে প্রখ্যাত জনদের সাথে আমাকেও অনেকবার ডেকেছেন প্রযোজনা করতে। জান লড়িয়ে করেছিও সেই প্রযোজনা। দর্শক সমুদ্রগর্জনের মতো উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিয়েছে বছর শেষের রাতের রবীন্দ্রসদন। পরে কাগজে রিভিউ পড়ে দেখেছি কোনও কারণে আমাদের নামটাই উল্লেখ হয়নি। আর তাই প্রতিদিন জেদ বেড়েছে নিজেকে প্রমাণ করবার। তাই সায়ক আয়োজিত পূর্ণাঙ্গ নাটক প্রতিযোগিতায় চারবার পুরস্কৃত হয়েছে আমাদের দল- শান্তিপুর সাংস্কৃতিক। আজ কলকাতা আমাকে ডাকে বক্তৃতা দিতে। করুণা করে নয়। আমি পারি বলে।
কলকাতা আমার শহর নয়। আমার শহর নদে জেলার শান্তিপুর। কিন্তু শান্তিপুর থেকে যে রেললাইন কলকাতায় আসে তার একপ্রান্তে শান্তিপুর আর অন্যপ্রান্তে শিয়ালদহ। জেলায় থিয়েটার করি বলে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। কিন্তু হিসেব করে দেখেছি যদি একশোবার শান্তিপুর থেকে ট্রেনে চেপে থাকি তবে আশিবারই কেমন করে যেন পৌঁছে গেছি কলকাতায়। আমি কলকাতাকে অস্বীকার করতে চেয়েছি। পেরেওছি। আবার আমি কলকাতার কাছে হাঁটু মুড়ে শিখেছিও। ব্রাত্য বসু আমাকে ডেকেছিলেন মিনার্ভা রেপার্টরির হয়ে চন্দ্রগুপ্ত করতে। আমি কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম। সে ছিল আমার স্বপ্ন, থিয়েটারের এক আশ্চর্য নির্মাণ। আরও আশ্চর্য সবার পঞ্চমুখ প্রশংসাতেও অল্প কিছু অভিনয়ের পর বন্ধ করে দেওয়া হল চন্দ্রগুপ্তের অভিনয়। মনোজ মিত্র আমাকে ডেকেছিলেন তাঁর দলে ‘পরী’ নাটকটি করার জন্য। দুটি অভিনয়ের পর সেটিও বন্ধ। বেলঘরিয়া অভিমুখ আমাকে দিয়ে করিয়েছেন কোজাগরী। ধার দেনা করে নিঃস্ব হয়ে অভিনয় করছেন ওরা। খুব শিগগিরই বোধহয় বন্ধ হবে। অনেকেই বলছেন এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ কোজাগরী আর প্রতিদিন প্রেক্ষাগৃহে মাছি তাড়াচ্ছে লোক। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। বোধহয় আমারই ব্যর্থতা। এক একজন থাকে না ? যারা কিছুতেই গুছিয়ে নিতে পারে না কোনও কিছুই, আমার বোধহয় সেই দশা। আমি নাট্য আকাদেমির মেম্বার হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছুই হয়ে উঠতে পারিনি। তাই কলকাতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসার আর অভিমানের। কাছের আর দূরের। তবে সব ছাপিয়েও মনে থাকে সর্বক্ষণ- আমার প্রথম নাটক ছেপেছিলেন দেবাশিস মজুমদার শূদ্রকে। আমার প্রথম বড় পুরস্কার আমাকে দেওয়ার আগে আমাকে ব্যক্তিগত চিঠি লিখে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মনোজ মিত্র। আর কলকাতায় থাকে আমার প্রিয় বান্ধবীরা। তাদের সঙ্গে গনগনে দুপুরে কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ায় কিংবা বিকেলের পড়ন্ত আলোয় টালাপার্কে হেঁটে যাওয়া অথবা মেঘ করা হাওড়ার ব্রিজের নীচে হাতে জয় গোস্বামী নিয়ে অপেক্ষা করা অথবা মধুসূদন আর হেনরিয়েটার কবর ছুঁয়ে বসে থাকার উথাল পাথাল সুযোগ কে দিত আমাকে কলকাতা ছাড়া ?
আমি তাই শান্তিপুর লোকাল হয়েই থাকতে চাই। যে সকালে কলকাতা গিয়ে মাঝরাতে চুপ করে এসে দাঁড়ায় নির্জন শান্তিপুর স্টেশনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy