এক দশক আগে এমনই এক শীতের দুপুরে ঢাকা হজরত শাহ জালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল বিশেষ বিমান। তাতে ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জ়িয়ার কনিষ্ঠপুত্র তথা তারেখ রহমানের ভাই আরাফত রহমান কোকো। সে দিনও বিমানবন্দরের সামনে ছিল বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভিড়। কিন্তু ছিল না বৃহস্পতিবারের মতো উচ্ছ্বাস। কারণ, সে দিন মালয়েশিয়া থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল খালেদার কনিষ্ঠপুত্রের কফিনবন্দি দেহ!
কিংবদন্তী প্যালেস্টাইনি নেতা ইয়াসের আরাফতের নামে জিয়া দম্পতি নামকরণ করেছিলেন তাঁদের কনিষ্ঠপুত্রের। নিহত পিতা ‘বীরবিক্রম’ (বাংলাদেশ সেনার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা) মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতোই দুর্জয় সাহস আর ক্রীড়াপ্রেমের জন্য পরিচিত ছিলেন কোকো। সেই সঙ্গে ছিলেন বিতর্কিত। বিএনপি সাংগঠনিক কার্যকলাপ তারেক সামলালেও আর্থিক দিকটি দেখভাল করতেন কোকোই। খালেদা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জমানায় দুর্নীতির অভিযোগে মায়ের সঙ্গেই জেলের সাজা হয়েছিল তাঁর।
আরও পড়ুন:
কোকোর জন্ম ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে। তাঁর বাবা জিয়া তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার যোগদানের পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মা খালেদার সঙ্গে গৃহবন্দি ছিলেন কোকোও। ১৯৮১ সালে সেনার বিদ্রোহী অফিসারদের হামলায় জিয়া যখন চট্রগ্রামে নিহত হয়েছিলেন, তখন তিনি নেহাতই শিশু। দাদা তারেকও নাবালক। সেই অবস্থাতেই স্বামীর গড়া দল বিএনপির দায়িত্ব নিয়েছিলেন খালেদা। সেনা একনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদের সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতে খালেদা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে দাদা তারেকের সঙ্গে ধীরে ধীরে নজর কাড়়তে শুরু করেছিলেন কোকো। বিশেষত ‘দক্ষ ক্রীড়া প্রশাসক’ হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি।
বস্তুত, কোকোর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সংগঠন। খালেদার প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফায় ২০০৪ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ করিয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলে খালেদা। সে সময় থেকে দু’ভাইয়ের বিরুদ্ধেই নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবরে খালেদার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষের পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। এর পরেই জিয়ার পরিবারের তিন জনের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছিল একাধিক মামলা। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কোকোকে তার মা খালেদার সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জমানাতেই ২০০৭ সালে অর্থ পাচারের মামলায় কোকোকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত।
২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের অভিযোগে তাঁকে ছ’বছরের কারাদণ্ড এবং ৩৮ কোটি ৮৩ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। দেড়় বছরের বেশি সময় জেলে কাটানোর ২০০৮ সালের পরে ১৭ জুলাই স্বাস্থ্যের কারণে কোকোকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। চিকিৎসার জন্য প্রথমে তাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে এবং তার পরে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুরে গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে কুয়ালা লামপুরের ‘মালয়েশিয়া জাতীয় মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়েছিল কোকোকে। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে তখন আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় কোকোর মৃত্যু নিয়েও দানা বেঁধেছিল জল্পনা। উঠেছিল নানা প্রশ্ন।