১৭ বছর পর বাংলাদেশে ফিরেছেন সে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান। আঠারো মাসের কয়েদবাসের পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। এত দিন ব্রিটেনেই স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন। দীর্ঘ ১৭ বছর বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেননি জিয়া-পুত্র।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় (যা ১/১১ নামেই পরিচিত)। তার পরেই বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা যায় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। সেই সময়েই দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হন তারেক। ১৮ মাস জেলে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। জেলে খালেদা-পুত্রের উপর অত্যাচার করারও অভিযোগ ওঠে।
সেই সময়ে বাংলাদেশ জুড়ে খবর ছড়িয়েছিল যে, বাংলাদেশের সেনাকর্তাদের সঙ্গে একরকম আপসরফা করেই দেশ ছেড়েছিলেন তারেক। প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার ‘কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-২০০৮)’ বইতে লিখেছেন, “এমনও হতে পারে তিনি (খালেদা জিয়া) জেনারেলদের সাথে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এই মর্মে তারেক রহমান কোনেও সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন।” খালেদা বা তারেকের তরফে কখনওই আনুষ্ঠানিক ভাবে এমন কোনও শর্তের কথা স্বীকার করা হয়নি। তবে সেই সময় খালেদা জানিয়েছিলেন, তারেক পড়াশোনা এবং চিকিৎসার জন্যই লন্ডনে গিয়েছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়, তাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। সেই সময় তারেকের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলা হয়। ২০০৪ সালের ২১ অগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলা হয়। নিহত হন ২৪ জন। আহত হন হাসিনা-সহ ৩০০ জন। এই ঘটনাতেও তারেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০২৪ সালের অগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের পর সব মামলা থেকে তারেককে মুক্ত করা হয়। তার পরেই তাঁর দেশে ফেরার পথ প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেন অনেকেই।
বিএনপি নেত্রী খালেদা অসুস্থ হয়ে ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরার জন্য তারেকের মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরাও। গত নভেম্বরে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে তারেক লেখেন, “এখনই দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তাঁর জন্য অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।” তবে এর কারণ ব্যাখ্যা করেননি তারেক। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে ব্রিটেনে বিএনপির এক আলোচনাসভায় তারেক জানিয়ে দেন যে, ২৫ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশে ফিরছেন। সেইমতো বুধবার সন্ধ্যায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমান ধরেন তিনি। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৩৯ মিনিটে (স্থানীয় সময় অনুসারে) ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে তারেকের বিমান।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন খালেদা। সেই সময়ে তারেকের নেতৃত্বে একটি সমান্তরাল ক্ষমতাবলয় তৈরি হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন অনেকেই। তারেক দলের কাজ পরিচালনা করতেন দলের বনানী অফিস থেকে, যা হাওয়া ভবন নামেই পরিচিত ছিল। অভিযোগ উঠেছিল, এই হাওয়া ভবন থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা তুলে তা বিদেশে পাচার করতেন তারেক। যদিও তারেকের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেয় বিএনপি।
দীর্ঘ দিন বিদেশে থাকলেও দলের নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখেছিলেন তারেক। ২০১৮ সালে দুর্নীতি মামলায় খালেদা কারাগারে যাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে লন্ডন থেকেই দল পরিচালনার কাজ শুরু করেন তিনি। অশান্ত বাংলাদেশে ফেরার আগে একাধিক বার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা শোনা গিয়েছে তারেকের মুখে। হাসিনার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পুরনো দলগুলির মধ্যে একমাত্র বিএনপি-ই নির্বাচনী ময়দানে নামছে। আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের আশা দেখছে বিএনপি।
তারেকের প্রত্যাবর্তন এবং কার্যকলাপের দিকে নজর রেখেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল। নজর রেখেছে নয়াদিল্লিও। ভারতের কূটনৈতিক মহলের একাংশও মনে করছে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী কট্টরপন্থী দল ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র (‘জামাত’ নামেই যা পরিচিত) প্রভাব এবং প্রসার রুখতে আপাতত তারেকের উপর ভরসা করা ছাড়া গতি নেই। তবে অশান্ত বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ তারেক কতটা করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।