Advertisement
E-Paper

সুরকার হিসেবেই তো মান্না দে-র আবির্ভাব

সেই সব শিল্পী খুবই সৌভাগ্যবান, যাঁরা মান্না দে-র সুরে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছেন। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীআমেরিকায় এসেছি কুড়ি দিন হয়ে গেল। বিস্তর ঘোরাঘুরি। ওয়েস্ট থেকে ইস্ট। ঘুরে এলাম স্যাকরেমন্টো, লস এঞ্জেলেস, লাস ভেগাস, ডিজনিল্যান্ড, ইউসিমিটি ন্যাশনাল ফরেস্ট, হলিউড, সানফ্রান্সিসকো।

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৫১

আমেরিকায় এসেছি কুড়ি দিন হয়ে গেল। বিস্তর ঘোরাঘুরি। ওয়েস্ট থেকে ইস্ট। ঘুরে এলাম স্যাকরেমন্টো, লস এঞ্জেলেস, লাস ভেগাস, ডিজনিল্যান্ড, ইউসিমিটি ন্যাশনাল ফরেস্ট, হলিউড, সানফ্রান্সিসকো। সামনের সপ্তাহে অন্য দিক—নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, বোস্টন, ফিলাডেলফিয়া, নায়গ্রা ফলস। এর মধ্যে প্রায় প্রত্যেক উইকএন্ডে বাঙালি বন্ধুদের বাড়িতে ডিনার সহযোগে নিখাদ বাঙালি আড্ডা। দাদা এখানে আছেন ৪০ বছরেরও বেশি। খুব অল্প দিনের মধ্যে দাদার বন্ধুরাও আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহে আড্ডা জমে উঠেছিল মিতা-প্রদোষের বাড়িতে। বোম্বের বিখ্যাত মিউজিক অ্যারেঞ্জার এবং সুরকার বাসু চক্রবর্তীর মেয়ে মিতা। এক সময় ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে কাছাকাছি থাকত মিতা ও রমাদি (মান্নাদার বড় মেয়ে সুরমা)। কথায় কথায় সে প্রসঙ্গ এলো। মিতার বাড়িতে একদিন সপরিবার এসেছিলেন মান্নাদা। মিতার রান্না করা পোস্ত এবং ইলিশ মাছ খেয়ে মান্নাদা কী খুশি! প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। মিতার স্মৃতিতে তা এখনও অমলিন।

এখানে এসে দেখলাম, সবাই মান্নাদাকে নিয়ে আনন্দবাজারের এই ধারাবাহিক পড়ছেন। সুনন্দা এখানকার নামকরা ডেন্টিস্ট। ওর বর বরুণ ‘ইনটেল’-এ আছে। সুনন্দার বাড়িতে আড্ডা চলছে। অবধারিত ভাবে এলো মান্নাদা প্রসঙ্গ। বরুণ বলল, ‘দেবপ্রসাদদা, আপনার লেখা পড়ে মান্নাদা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারছি। কিন্তু সুরকার মান্না দে সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চাই।’ ভাবলাম, সত্যিই তো! সুরকার মান্না দে-ও তো অসাধারণ। আসলে গায়ক হিসেবে মান্না দে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যে, তার সুরকার সত্তা অনেক সময় আড়ালেই থেকে গেছে। কিন্তু সুরকার মান্না দে-র কাছেও আমরা প্রবল ভাবে ঋণী।

মান্নাদার গায়ক-জীবনে সুরকার শঙ্কর-জয়কিষেনের যে বিরাট ভূমিকা তা আগে বলেছি। সুরকার মান্নাদার জীবনেও এঁদের একটা ভূমিকা থেকে গেছে। মান্নাদাই একমাত্র গায়ক, যাঁর ভিতটাই তৈরি হয়েছিল সুরকারদের আঁতুড় ঘর থেকে। সহকারী হয়ে কাজ করেছেন বিখ্যাত সব সুরকারের সঙ্গে। এঁরা হলেন—কৃষ্ণচন্দ্র দে, শচীনদেব বর্মন, হরিপ্রসন্ন দাস, অনিল বিশ্বাস, ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ। এঁদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে করতে মান্নাদার মধ্যেও যে সুর করার খিদে জন্মাবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি তখন টুকটাক সুরের কাজও করছেন। ইতিহাস বলছে, মান্নাদার আবির্ভাবই সুরকার হিসেবে। ১৯৪২ সালে তাঁর সুরে সুপ্রীতি ঘোষ গাইলেন ‘বালুকাবেলায়’। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও সুর করেছেন—সতী তোরাল, বীরাঙ্গনা, তমসা, চমকি... ইত্যাদি। সঙ্গে চলছে নিজের প্লেব্যাক। মুম্বইতে গায়ক ও সুরকার হিসেবে দুটো দিক সামলাতেন। খুবই কঠিন ছিল। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যেমন, শচীনদেব বর্মন, কিশোরকুমার, হেমন্তকুমার, বাপী লাহিড়ি, রাহুলদেব বর্মন। কিন্তু তাঁরা নিয়মিত ভাবে গায়ক বা সুরকার হিসেবে কাজ করেননি। মান্নাদা যখন দ্বিধাবিভক্ত, সুরকার শঙ্কর-জয়কিষেন মান্নাদাকে সেই ঐতিহাসিক সাজেশন দিলেন— একসঙ্গে দুটো কাজ হয় না মান্নাদা। যে কোনও একটাকে বাছুন।

মান্নাদাও বুঝতে পারছিলেন, দুটো দিক সামলানো যাবে না। তিনি গায়ক সত্তাটাকেই বেছে নিলেন। এ জন্য আমরা শঙ্কর-জয়কিষেনের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু যখন আমরা মান্নাদার সুর করা গানগুলো শুনি, একটা আফশোস তো হয়—ইস, আমরা কত অসাধারণ সুর থেকে বঞ্চিত হলাম।

তবু মান্নাদা যতটুকু সুরের ভাণ্ডার রেখে গেছেন, প্রতিটি গানই অসীম ধনে ধনী। মান্নাদার নিজের গাওয়া বাংলা গানের কথা ধরুন। শুরু সেই ১৯৫৩ সালে। নিজের সুরে প্রথম বাংলা বেসিক গান। আর শেষ করেছেন ২০১০ সালে নিজের সুরে। অন্যান্য গানের কথা বাদ দিলেও দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে মান্নাদা নিজের গাওয়া অসংখ্য কালজয়ী গানে সুর করেছেন নিয়মিত ভাবে। খুব বিব্রত ভাবে একটা কথা বলি। মান্নাদার গাওয়া বেশ কিছু গানের সুরকার হিসেবে অন্য সুরকারের নাম লেখা আছে। বাস্তব ঘটনা হল, সেই অধিকাংশ গানের সুরকার মান্নাদা নিজেই। মান্নাদা সুরগুলো ভেঙেচুরে এমন ভাবে তৈরি করে নিতেন যে তা একটা নতুন সুরই হয়ে যেত। আড্ডার সময়ে মান্নাদা অনেক গানের সুরের গল্প বলতেন। মাঝে মাঝে বলেই ফেলতাম, এই গানে কিন্তু অন্য সুরকারের নাম লেখা আছে। মান্নাদা মুচকি হেসে বলতেন, ‘তাই বুঝি! জানতাম না তো!’ এখানেই মান্নাদার মহত্ত্ব। শুধু তাঁর জন্যই অনেকে প্রতিষ্ঠিত সুরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে কেউ কেউ নিজের সুরেই মান্নাদার গান বিখ্যাত করেছেন।

মান্নাদার বাংলা বেসিক গান কিন্তু মূলত মান্নাদার সুরের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ করে দেখুন, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী মান্নাদার জন্য এত ছবির গানে সুর করেছেন, অথচ বেসিক গান খুব বেশি নেই। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে তো মান্নাদার কোনও বেসিক গান নেই। মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুপর্ণকান্তি ঘোষ অবশ্য ব্যতিক্রম। সুর করতে মান্নাদা এত ভালবাসতেন যে নিজের বেসিক গান মন ভরিয়ে সুর করতেন। কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কিন্তু মূল লক্ষ্যটা রাখতেন গানগুলো যাতে সব ধরনের শ্রোতার ভাল লাগে। এ জন্যই মান্নাদার সুরে আমরা পেয়েছি অজস্র সব ভাললাগা গান—এই কূলে আমি, আমি সাগরের বেলা, ও আমার মন-যমুনার, এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি, খুব জানতে ইচ্ছে করে..., সুন্দরী গো, ও চাঁদ, শুধু একদিন ভালবাসা,.....আপনি এক এক করে গাইতে থাকুন, সারা দিনেও সঞ্চয় শেষ হবে না। আধুনিক গান অথচ বৈচিত্রে ভরপুর, মিষ্টি রোম্যান্টিক, কাওয়ালি, রাগপ্রধান, গজল, ব্যালে....কী নেই!

হিন্দি ছাড়া বেশ কিছু বাংলা ছবিতেও মান্নাদা সুর করেছেন। মুম্বইতে তিনি যে রকম ব্যস্ত, অনেক পরিচালক তাঁকে ধরতে পারেনি। না হলে তাঁর সুর-করা ছবির সংখ্যা অনেক বেশি হত। তবু বেশ কিছু ছবিতে মান্নাদা আমাদের অসাধারণ কিছু সুর উপহার দিয়েছেন। যেমন, বাবুমশাই, প্রেয়সী, শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন।

বাংলা নাটক ‘মরেও শান্তি নেই’-এ সুর করেছিলেন মান্নাদা। সেই নাটক যাঁরা দেখেছেন, শুনতে পেয়েছেন মান্নাদার সুর করা অপূর্ব সেই গান—সুন্দর হে সুন্দর, এবং বিচার হয় আদালতে। জানা না থাকলে অনেকে হয়তো বিশ্বাসই করবেন না যে মান্নাদা একটি যাত্রাতেও সুর করেছিলেন। সেই পালায় একটি গান তো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল—‘নিভে গেল চাঁদ রাতের প্রথম লগনে।’

মান্নাদার সুর করা প্রতিটি গীত-গজল মূল্যবান মণিমুক্তোর মতো। হিন্দি বেসিক গান। মান্নাদার সুর আর গায়কিতে এখনও ধাক্কা দিয়ে যায়—দর্দ উঠা ফির, জানে কহাঁ খোয়ি, মেরি ভি এক মুমতাজ থি, শুনশান যমুনা কিনারা, তকদির মেরি, অভি হ্যায় চাঁদ,...আরও কত গান।

শুধু নিজের গানই বা কেন, বলতে দ্বিধা নেই, সেই সব শিল্পী খুবই সৌভাগ্যবান, যাঁরা মান্নাদার সুরে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছেন। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সুমন কল্যাণপুর, হৈমন্তী শুক্লা প্রমুখ। আশাজি কত বাংলা গান গেয়েছেন। আর ডি বর্মন তাঁর গানে একটা আলাদা আঙ্গিক দিয়েছেন, অনেকটা সুধীন দাশগুপ্তও। আশাজির জন্য মান্নাদার সুর করা গান তৈরি হয় প্রায় ৫০ বছর আগে। কিন্তু আজও চিরনতুন মান্নাদার সুরে আশাজির সেই সব গান—‘যখন আকাশটা কালো হয়’, ‘আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম’, ‘যে-গান তোমায় আমি’, ‘আমায় এত যে ভালবেসেছ’। কিংবা সুমন কল্যাণপুর। এখনও যখন শুনি মান্নাদার সুরে সুমনের গান—‘কান্দে কেন মন আজ’, বা ‘শুধু স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলেছে’, মনে হয় আরও বহু বার শুনি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্য মান্নাদা অসাধারণ দুটি গানে সুর করেছিলেন। সন্ধ্যার খুব প্রিয় এই দুটি গান—‘একটা ছোট্ট দ্বীপ’, ‘সবার চেয়ে দামি’। উৎপলা সেন গেয়েছিলেন আজও ভাললাগা সেই গান— ‘আমি ভুল করেছি’। সুদেব দে-ও মান্নাদার সুরে বহু বিখ্যাত গান গেয়েছেন। ‘দময়ন্তী দময়ন্তী’ গানের জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন। ভাল লাগে ‘মিঠে মিঠে কথায়’, ‘কুঁড়ির স্বপ্ন হবে ফুল’। মান্নাদার সুরে দারুণ দারুণ সব গান গেয়েছেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। কী অসাধারণ সব কম্পোজিশন—‘আহা পরিয়ে দিলে’, ‘এই পলাশের দেশে’, ‘আজ রাতে চাঁদের কি অসহ্য আলো’। মান্নাদার সুরে, মান্নাদা ছাড়া সব থেকে বেশি গান গেয়েছেন হৈমন্তী শুক্লা। হৈমন্তীদির সুরকার ভাগ্য সত্যিই ঈর্ষণীয়। পণ্ডিত রবিশংকর, উস্তাদ আলি আকবর খান, নৌশাদ, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সর্বোপরি মান্নাদা। মান্নাদার সুর ও সান্নিধ্য এখনও হৈমন্তীদির গর্বের কারণ। মান্নাদাও বলতেন— ও একজন প্রকৃত শিক্ষিতা গায়িকা। এই বিরল যুগলবন্দিতে বাংলা সঙ্গীত পেয়েছে অপূর্ব সব গান— ‘কে আলেয়া’, ‘কেন নয়নে আবির ছড়ালে’, ‘ঠিকানা না রেখে’, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘আমি অবুঝের মতো’।

মান্নাদার সুর নিয়ে আরও কিছু বলার ইচ্ছে আছে। সে সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। না বললে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

manna dey manna dey musician manna dey singer manna dey exclusive debaprasad chakraborty ananda plus web edition
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy