এমনিতেই বলিউডে পরিচালকদের খ্যাতি নাকি নায়কদের চেয়ে কম। কিন্তু সেই ‘মিথ’ যেন ভেঙেছেন তিনি। কাস্টিং ডিরেক্টরের পরিচয়ে সাফল্য, খ্যাতি সব পেয়েছেন। তিনি মুকেশ ছাবড়া। সদ্য কলকাতায় এসেছিলেন অভিনয় প্রশিক্ষণের ‘মাস্টার ক্লাস’ করাতে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনচিত্রের একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে তাঁর উপর। সেই সুবাদেও কলকাতায় যাতায়াত বেড়েছে তাঁর। বলিউডের প্রথিতযশা পরিচালক থেকে খ্যাতনামী তারকা— সবার কাছেই তাঁর মতামতের গুরুত্ব আজ অনস্বীকার্য। টলিপাড়ার মিমি চক্রবর্তী থেকে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে অকপট তিনি। বাংলা সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাদের উপর নজর আছে তাঁর, আনন্দবাজার ডট কমকে জানালেন মুকেশ ছাবড়া।
প্রশ্ন: কলকাতায় যাতায়াত বেড়েছে আপনার।
মুকেশ: হ্যাঁ, গত কয়েক বছর থেকে বেড়েছে। চণ্ডীগড় ও কলকাতা, এই দুটো শহর আমার খুব প্রিয়।
প্রশ্ন: এ শহরে ‘মাস্টার ক্লাস’ করাতে এসে নতুন কাউকে চোখে পড়ল?
মুকেশ: ক্লাস খুব ভাল হয়েছে। প্রীতিময়দা (পার্পল স্টুডিয়োর কর্ণধার) আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দুর্দান্ত সময় কাটালাম। নতুন ছেলেমেয়েরা ছিল। মনে হয়, তাঁদের অন্তত একটা ধারণা দিতে পেরেছি যে, কী ভাবে অডিশন দিতে হবে, কী ভাবে নিজেকে মানসিক ভাবে দৃ়ঢ় ও স্থির রাখতে হবে এ সব নিয়ে।
প্রশ্ন: সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনীচিত্রের কাজ খানিকটা পিছিয়েছে। কোনও নির্দিষ্ট কারণ?
মুকেশ: নাহ্, সব ঠিক আছে। খুব শীঘ্রই শুরু হবে।
প্রশ্ন: সৌরভের চরিত্রে রাজকুমার রাওকেই নিলেন কেন?
মুকেশ: ও ছাড়া আর করবেই বা কে? দারুণ অভিনেতা! যে কোনও চরিত্র দেবেন, সেটাই করে দেবে। আমি নিশ্চিন্ত, দারুণ করবে।
প্রশ্ন: ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য তা হলে মিমি চক্রবর্তীকেই চূড়ান্ত করলেন?
মুকেশ: এখনই কিছু প্রকাশ্যে আনতে চাইছি না। অনেকে অনেক কথা বলে। আমি আমার ছবি কাস্টিং নিয়ে চমকটা রাখতে চাই। কোনও কিছুতে এখনই সম্মতি দিচ্ছি না। লোকে আগেও অনেক কিছু ভুলভাল গুজব ছড়িয়েছে।
প্রশ্ন: সৌরভকে নিয়ে ছবি, সেখানে গ্রেগ চ্যাপেল কে হবেন, সেটাও তো জানতে চায় সকলে?
মুকেশ: এখনই বলব না। এটা একটা বড় চমক রাখছি বলতে পারেন। কিছু চমক রেখে দিতে চাই দর্শকদের জন্য।
প্রশ্ন: ‘দঙ্গল’, ‘এম এস ধোনি’-সহ একাধিক স্পোর্টস ড্রামা করেছেন। এ ধরনের ছবির অভিনেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মূলত কী দেখেন?
মুকেশ: অনেকগুলো দিক মাথায় রাখতে হয়। চরিত্রটাকে পর্দায় খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে হবে। যাঁকে কাস্ট করছি, মূল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর আচরণগত সাদৃশ্য থাকতে হবে। বয়সে মিল থাকতে হবে। চেহারার সাদৃশ্য থাকতে হবে। আমি আসলে চিত্রনাট্যে লেখা চরিত্রদের খুঁজি, অভিনেতা খুঁজতে যাই না।
প্রশ্ন: হিন্দি সিনেমায় কোন অভিনেতাদের সঙ্গে সহজে কাজ করা যায়?
মুকেশ: সুশান্ত সিংহ রাজপুত ছিলেন। রাজকুমার রাও, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, ফাতিমা সানা শেখ, ভিকি কৌশল, জ়িশান আউব, সান্য মলহোত্র— এঁদের সঙ্গে কাজ করার একটা আলাদা আরাম আছে।
প্রশ্ন: অনুরাগ কাশ্যপ থেকে রাজকুমার হিরানি— বড় বড় পরিচালকদের ছবিতে কাস্ট করেছেন আপনি। কাস্টিং ডিরেক্টরের কতটা স্বাধীনতা থাকে?
মুকেশ: আমাকে যখন কোনও পরিচালক তাঁদের ছবির দায়িত্ব দেন, আমার মতামতকেও গুরুত্ব দেন। আমিও তো কম কাজ করিনি। আমি পরিচালকদের ‘ইয়েস ম্যান’ হয়ে থাকি না। আমার পরিচালককে আমি বেছে নিই। পরিচালক আমাকে বাছেন, তেমনটা নয়। চিত্রনাট্য পড়ি তার পরে সিদ্ধান্ত নিই, আদৌ কাজটা করব কি না। আমি আমার জীবনের এতটা সময় দেব, আমারও দেখে নেওয়ার অধিকার আছে। পরিচালকেরা যখন অভিনেতা-অভিনেত্রী বাছাই করেন তখন তাঁদের অহংবোধ খাটো হয় না তো!
প্রশ্ন: আপনি বাংলা সিনেমা দেখেন?
মুকেশ: না, দেখি না। কেউ কোনও সিনেমা দেখতে বললে দেখি। তবে এখনকার বাংলার অভিনেতাদের প্রায় সবাইকেই চিনি আমি।
প্রশ্ন: বাংলা সিনেমার অভিনেতাদের মধ্যে কাদের অভিনয় ভাল লাগে আপনার?
মুকেশ: রজতাভ দত্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, মিমি চক্রবর্তী, টোটা রায়চৌধুরী, যিশু সেনগুপ্তের অভিনয় ভাল লাগে। সম্প্রতি জিতের সঙ্গে দেখা হল। দারুণ মানুষ। কিছু একটা করব আমরা একসঙ্গে।
প্রশ্ন: মিমির মধ্যে কোন জিনিসটা ভাল লেগেছে?
মুকেশ: পর্দায় ওর উপস্থাপনা। ভীষণ ঝকঝকে একটা মেয়ে। অভিনয়টা ভাল জানে।
প্রশ্ন: সম্প্রতি বাংলা ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মুম্বইয়ে যাতায়াত বেড়েছে। কী মনে হয়? বলিউডে ভিড় বাড়ছে?
মুকেশ: আসলে শুধু কলকাতা থেকে নয়। তামিল, তেলুগু, পঞ্জাবি বিভিন্ন ভাষার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কাজ করছেন মুম্বইয়ে, যেটা খুবই ভাল একটা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। একজোট হয়ে কাজ করাটা খুব দরকার। দক্ষিণ ভারত থেকে পরিচালকেরা মুম্বইয়ে এসে ছবি বানাচ্ছেন। আমি চাই মুম্বই থেকে পরিচালকেরা গিয়ে ওখানে ছবি বানান। তবেই না আরও বেশি ঐক্য বাড়বে!
প্রশ্ন: নিজের প্রথম ছবি ‘দিল বেচারা’ র পর স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে আর কোথাও কাস্ট করেননি কেন?
মুকেশ: একেবারে বাঙালি মায়ের চরিত্র দিয়েছিলাম। ভীষণ প্রতিভা রয়েছে ওঁর মধ্যে। কিন্তু, লোকে ওঁকে ‘সেক্সি আর হট’ হিসেবেই দেখে এসেছে। আমি ওঁকে একবারে সাদামাঠা একটা মায়ের চরিত্র দিয়েছিলাম। সেই কারণেই আমি কাস্টিং ডিরেক্টর। দর্শককে চমকে দেওয়া আমার কাজ।
প্রশ্ন: সিনেমায় বড় তারকা হতে গেলে কী প্রয়োজন?
মুকেশ: ভাল অভিনেতাই বড় তারকা। এই সময় দাঁড়িয়ে জয়দীপ অহলাওয়াতও কিন্তু বড় তারকা, ভিকি কৌশলও বড় তারকা। আগে তারকার যে ধারণা ছিল সেটা ভেঙেচুরে গিয়েছে। গল্প ভাল হলে এখন ছবি চলবে। আসলে বড় তারকা হতে গেলে সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে। সম্মান দিতে মানুষকে। বড় তারকা মানে লোককে ছোট করা, হেয় করা... ওই দিন আর নেই। ঠিকঠাক ‘পিআর’ (জনসংযোগ) দরকার। কী ভাবে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে নিজেকে তুলে ধরছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন, সেটাও সমান প্রয়োজনীয়। অনেক কিছু লাগে একজন তারকা হতে গেলে।
প্রশ্ন: বলিউডে তা হলে ‘লবি’তে শামিল হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ?
মুকেশ: কারা বলে এ সব কথা!
প্রশ্ন: লবি কিংবা স্বজনপোষণ নিয়ে এত এত বিতর্ক ও অভিযোগ, সব মিথ্যে?
মুকেশ: কোনও ‘লবি’ নেই এখানে। যাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তাঁরাই এমন কথা বলেন। এতই যদিও ‘লবি’ থাকত তা হলে বাইরে থেকে এসে এত ছেলেমেয়ে তারকা হতে পারত? সবাই ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে কাজ করতে চায়।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে আপনার বন্ধুত্ব কাদের সঙ্গে? নাকি সবাই সহকর্মী?
মুকেশ: না, না। কিছু ভাল বন্ধু আছে। যেমন কৃতি শ্যানন, ফারহা খান, রাজকুমার, ইমতিয়াজ় আলি। এঁরা আমার বন্ধু।
প্রশ্ন: আর শত্রু?
মুকেশ: সেটা সব পেশাতেই থাকে। কেউ পছন্দ করবে, আবার কেউ করবে না। অত ভাবলে চলবে না।
প্রশ্ন: মুকেশ ছাবড়াকে এই সাফল্যটা পেতে কত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে?
মুকেশ: ২০ বছর লেগেছে। এডি থেকে কাস্টিং ডিরেক্টর। প্রথম ছবি ‘চিন্টুজী’। আমাকে লোকে চিনতে শুরু করল ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’-এর পর থেকে। আমি গত কয়েক বছর ধরে শুধু কাজ করে গিয়েছি। সকালে উঠে কাজে চলে আসি। জীবনে যা-ই হয়ে যাক না কেন।
প্রশ্ন: কোনও কিছুই তো বেশি করা উচিত নয়...
মুকেশ: আমাকে লোকে ‘ওয়ার্কোহলিক’ বললে বলুক, ‘অ্যালকোহলিক’ না বললেই হল। যাঁদের কাজ নেই তাঁদের অবস্থা দেখুন। এই শহরে আমরা কাজ করতেই তো এসেছি।
প্রশ্ন: ‘কাস্টিং’ শব্দটা আশপাশেই ঘোরাফেরা করে ‘কাস্টিং কাউচ’ শব্দবন্ধ। শোনাও যায়। কতটা সত্যি?
মুকেশ: লোকের শোনা কথায় বিশ্বাস করি না। আমি এই দেশের সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। কখনও এমনটা শুনিনি, দেখিওনি।
প্রশ্ন: কোন অভিনেতাদের আরও বেশি কাজ পাওয়া উচিত বলে মনে হয়?
মুকেশ: রাধিকা আপ্তে, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকির আরও ভাল কাজ পাওয়া উচিত।
প্রশ্ন: সুশান্তকে মিস করেন?
মুকেশ: (এক নাগাড়ে সুশান্তকে নিয়ে বলতে শুরু করলেন) আমার প্রথম ছবির নায়ক, আমার প্রাণের প্রিয় বন্ধু…
প্রশ্ন: এগুলো সবাই জানে। কিন্তু প্রতিবার সুশান্তকে নিয়ে কথা বলতে হলে কী অনুভূতি হয়?
মুকেশ: আসলে আমি কথা বলতে চাই না। কারণ, যত বার ওকে নিয়ে কিছু বলি, নিজের কষ্ট হয়। তাই আমার প্রথম ছবি ‘দিল বেচারা’ নিয়েও কথা বলতে চাই না খুব একটা।
প্রশ্ন: এখন সিনেমার ভাল-খারাপ বিচার হয় কালেকশন দেখে, কোটির অঙ্কেই যেন বেশি মনোযোগ সবার...
মুকেশ: ছবি সফল হোক কিংবা ব্যর্থ, আমি তো পারিশ্রমিক কমাই না। যতটৈ পাওয়ার কথা ততটাই পাই। এখন দর্শকও তো ছবির কত কোটি ব্যবসা করল, সেটা দেখে সিনেমা দেখতে যান। তাই সবাই এখন এই নম্বর গেমে ফেঁসে গিয়েছেন।
প্রশ্ন: আপনি ‘বাহুবলী’র কাস্টিং করলে কাদের নিতেন?
মুকেশ: আমি করতামই না। ওই ছবির এর চেয়ে ভাল কাস্টিং কিছু হতে পারেই না।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে এত ছেলেমেয়ে প্রতিদিন আসে। তাঁদের ঠিক কী ভাবে এগোনো উচিত?
মুকেশ: নিজের অভিনয়ের দিকে মন দেওয়া উচিত। আমরা অভিনেতা চাই। যিনি পরিশ্রম না করে শুধু নেটওয়ার্কিং করবেন, বেশি পার্টি করবেন তাঁর কিছু হবে না। মন দিয়ে থিয়েটারটা করা উচিত।