Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Nandikar

মাটিতে বসে ডাল-রুটি খাচ্ছেন অমল পলেকর, রতন থিয়াম! বাড়িময় উৎসব আশৈশব দেখে আসছেন সোহিনী

৩৯ বছরে পা রাখছে নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলা। আগেকার আয়োজন আর এখনকার মধ্যে কতটা তফাত? ছোটবেলার গল্প শোনালেন নাট্যপরিচালক সোহিনী সেনগুপ্ত।

স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির ছবিটা বরাবর এমনই দেখেছেন সোহিনী সেনগুপ্ত। সে ছবি কয়েক দশকেই যে বদলে যাবে, এমনটা ভাবেননি।

স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির ছবিটা বরাবর এমনই দেখেছেন সোহিনী সেনগুপ্ত। সে ছবি কয়েক দশকেই যে বদলে যাবে, এমনটা ভাবেননি। নিজস্ব চিত্র

তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৩৬
Share: Save:

উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে ছোট্ট একটি বাড়ি। ছোট হলে কী হবে, তাতেই ধরে যেত গোটা পৃথিবী। সদর দরজা সব সময় খোলা। ঢালাও বিছানা পাতা মেঝেতে। সেখানেই আধশোয়া হয়ে আড্ডা দিচ্ছেন শ্রীরাম লাগু, রতন থিয়াম, অমল পলেকরের মতো তাবড় সব অভিনেতা। দরাজ কণ্ঠে হেসে উঠছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। হরদম এসে পড়ছেন সুইডিশ, ফরাসি নাট্যব্যক্তিত্বরাও। স্টোভে রান্না চাপিয়ে দিতেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। এত জন লোকের রান্না করা যেন কোনও ব্যাপারই নয়। অনায়াসে ডাল-রুটি পরিবেশন করছেন, তা-ই তৃপ্তি করে খাচ্ছেন শ্রীরাম লাগু। কিছু ক্ষণ খুন্তি নেড়ে এসে বেহালায় ছড় টানছেন স্বাতীলেখা। বলছেন নাটকের সংলাপও। সেই সঙ্গেই আবার গবেষক ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন। স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির ছবিটা বরাবর এমনই দেখেছেন সোহিনী সেনগুপ্ত। যেন উৎসব রোজ রোজ! সে ছবি কয়েক দশকেই যে বদলে যাবে, এমনটা ভাবেননি।

নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলার বীজ নিহিত ছিল রোজকার আড্ডায়। ঘরের ভিতর যা নিয়ে চর্চা, সে সব যদি মেলে ধরা যায় বাইরেও?

নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলার বীজ নিহিত ছিল রোজকার আড্ডায়। ঘরের ভিতর যা নিয়ে চর্চা, সে সব যদি মেলে ধরা যায় বাইরেও? ছবি-সংগৃহীত

সোহিনীর কথায়, “খুব কম পয়সা, কম জায়গা, কিন্তু বিশাল বড় জগৎ। এই দেখেই বড় হয়েছি আমি। বাড়ি ভর্তি লোকজন। আড্ডা-গান-থিয়েটার চর্চা, সবই চলত পুরোদমে। আমাদের বাড়িটা ছিল মেসবাড়ির মতো। কিন্তু এখন সব কিছু অনেকটাই আলাদা।”

১৯৮২ সাল। সোহিনীর তখন দ্বিতীয় শ্রেণি। ‘নান্দীকার’-এর রমরমার দিনগুলি তবু তাঁর স্মৃতিপটে ভাসে। একে একে ‘নান্দীকার’-এর সঙ্গে জুড়তে শুরু করলেন দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, সুব্রত পাল, প্রকাশ ভট্টাচার্যের মতো নাট্যব্যক্তিত্বরা। থিয়েটার ঘিরে অবিরাম একত্রযাপন। ছোট্ট বাড়ি দিনরাত উৎসবমুখর। তখনই মাথায় আসে, বড় করে অনেক মানুষকে নিয়ে একটা উৎসব করলে কেমন হয়!

নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলার বীজ নিহিত ছিল সেই ভাবনাতেই। ঘরের ভিতর যা নিয়ে চর্চা, সে সব যদি মেলে ধরা যায় বাইরেও? কলকাতার দর্শক যাতে সারা ভারতের নাটক দেখতে পান— সেই স্বপ্ন নিয়েই নাট্যোৎসব করার কথা ভাবা হয়েছিল। রুদ্রপ্রসাদ তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে গৌতম, সুব্রত থেকে শুরু করে ‘নান্দীকার’ পরিবারের সব সদস্যই এই প্রস্তাব লুফে নেন। সারা ভারতে ছড়িয়ে-থাকা থিয়েটারের বন্ধুরাও এই আনন্দযজ্ঞে শামিল হন। বিভিন্ন প্রদেশের নাট্যদল তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা নিয়ে উপস্থিত হয় ‘নান্দীকার’-এর আহ্বানে। টাকাপয়সার প্রশ্ন কখনওই সেখানে বড় হয়ে ওঠেনি। অনেক সময় নাট্যদলের সদস্যরা থেকে যেতেন রুদ্রপ্রসাদ-স্বাতীলেখার সেই বিবেকানন্দ রোডের বাড়িতেই।

নান্দীকারের নিজস্ব প্রযোজনায় চারটি নাটক থাকছে এ বারের উৎসবে।

নান্দীকারের নিজস্ব প্রযোজনায় চারটি নাটক থাকছে এ বারের উৎসবে। ফাইল চিত্র

সোহিনীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল, হাবিব তনবীরের মতো নাট্যব্যক্তিত্বও নাটক করতে এসে থাকতেন সাধারণ হোটেলে। তারকাসুলভ বায়নাক্কা ছিল না তাঁদের। সোহিনীর কথায়, ‘‘শ্রীরাম লাগু, সদাশিব অম্রপুরকর বা অমল পলেকরের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বের মধ্যেও তথাকথিত তারকার ছটা দেখিনি। মা হয়তো ডাল-রুটি বানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, শ্রীরাম লাগু সেটাই খাচ্ছেন। এমনকি, শম্ভু জেঠুও (মিত্র) জানতে চেয়েছেন সুবিধা-অসুবিধার কথা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।’’

সবাই মিলে হইহই করে ভাল নাটক করার ও দেখার মন নিয়েই আসতেন সকলে। সোহিনীর মনে পড়ে, ‘চরণদাস চোর’ বা ‘ঘাসিরাম কোতোয়াল’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা কলকাতার দর্শক টিকিট কেটে দেখেছেন নান্দীকার নাট্যমেলায়। শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। সেই থেকে ৩৮ বছর পার, বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে আগামী ২০ ডিসেম্বর স্বমহিমায় শুরু হতে চলেছে এ বছরের নাট্যোৎসব। এ বারের আয়োজন পাঁচ দিনের।

তখন তো সমাজমাধ্যম নেই। চটজলদি বিজ্ঞাপনী প্রচারের সুবিধা নেই। কী ভাবে লোকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এই নাট্যোৎসবের খবর? সোহিনী বললেন, ‘‘প্রথম দিকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, যেটা তৈরি করে দিয়েছিলেন খালেদ চৌধুরীর মতো মানুষ। তা ছাড়া অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতিচর্চার একটা পরিমণ্ডল তৈরিই ছিল। তাই ধীরে ধীরে লোকমুখেই ছড়িয়ে পড়েছিল এই নাট্যোৎসবের খবর।’’

তবে কাউকে এই উৎসবে আলাদা করে আমন্ত্রণ জানাতে হত না। নিজেদের উৎসব মনে করেই আসতেন সবাই। আর এখন?

গত কয়েক বছরে কী কী বদল ঘটেছে নাট্যোৎসবে তা-ও জানালেন সোহিনী। তাঁর কথায়, ‘‘সর্বভারতীয় স্তরে আগের মতো অসাধারণ প্রযোজনা আর তেমন বোধ হয় হচ্ছে না। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা শহরে ও শহরতলিতে অসামান্য কাজ হচ্ছে।’’ সোহিনীর মতে, সারা ভারতের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারেই এই মুহূর্তে সেরা কাজ হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারে দলগুলির পারস্পরিক একাত্মতাও অনেক বেশি বলে মনে করেন তিনি।

তাঁর আক্ষেপ, মুম্বইয়ের তারকাখচিত থিয়েটারের দলগুলি যে বিপুল অর্থ দাবি করে, তা ‘নান্দীকার’-এর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। নাট্যমেলার আয়োজনে ঘর থেকে রুদ্রপ্রসাদ-স্বাতীলেখাকেও টাকা দিতে হয়েছে বলে জানালেন তিনি। সরকারি সাহায্যের ব্যাপারেও সোহিনী তেমন আশাবাদী নন।

উৎসবে নাট্যদলের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে কিছু বদল ঘটেছে। বিভিন্ন নাট্যদলকে ভিডিয়ো জমা দিতে বলা হয়েছিল নাট্যোৎসবের জন্য। খুব ভাল প্রযোজনার সন্ধান সেখানেও মেলেনি। জানালেন, অসম, ওড়িশা থেকে ভাল ভাল দল এসেছে শেষ কয়েক বছরে। বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও শহরতলির দলগুলির কাজের উপর। কোভিড-পরবর্তী সময়ের অর্থনীতির প্রভাবও পড়েছে নাট্যোৎসবে। প্রয়োজন বেড়েছে নানা রকম। সোহিনী বললেন, কমিয়ে আনতে হয়েছে উৎসবের দিনসংখ্যা। তবে হলভাড়া বৃদ্ধি, স্পনসরশিপের সমস্যা ইত্যাদি সত্ত্বেও উৎসব একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবেনি ‘নান্দীকার’। সোহিনী বললেন, ‘‘ সারা পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারের বন্ধুবান্ধব বলেছে, এই উৎসব তাদেরও। তারা এই উৎসবে ভালবেসে অংশ নিয়েছে, নানা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই একাত্মতা প্রেরণা জুগিয়েছে।’’

কমিয়ে আনতে হয়েছে উৎসবের দিনসংখ্যা। তবে হলভাড়া বৃদ্ধি, স্পনসরশিপের সমস্যা ইত্যাদি সত্ত্বেও উৎসব একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার কথা কখনও ভাবেনি ‘নান্দীকার’।

কমিয়ে আনতে হয়েছে উৎসবের দিনসংখ্যা। তবে হলভাড়া বৃদ্ধি, স্পনসরশিপের সমস্যা ইত্যাদি সত্ত্বেও উৎসব একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার কথা কখনও ভাবেনি ‘নান্দীকার’। নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nandikar festival Sohini Sengupta theatre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE