Advertisement
E-Paper

সলিলদা পাগলা হাওয়ার মতো, ওঁর মতো নির্ভীক সুরকার আর আসেননি

আজও কতটা প্রাসঙ্গিক সলিল চৌধুরী? জন্মশতবার্ষিকীতে সলিলকে স্মরণ করলেন আর এক বাঙালি সুরকার।

শান্তনু মৈত্র

শান্তনু মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:০৫
সলিল-স্মরণে আর এক সুরকার।

সলিল-স্মরণে আর এক সুরকার। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

সলিল চৌধুরী আজ কতটা প্রাসঙ্গিক? প্রতি ১০ বছরে এই প্রশ্নটা বার বার ওঠে। এই ভাবেই কেটে গেল ১০০ বছর। আজ, ১৯ নভেম্বর ওঁর জন্মদিন। আমরা ওঁর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করছি এ বছর। প্রত্যেক ১০ বছরেই আমরা উপলব্ধি করি, উনি কতটা প্রাসঙ্গিক। তবে আমার কাছে কী ভাবে ও কেন প্রাসঙ্গিক, সেটাই আজ বলি।

আমি প্রবাসী বাঙালি। সেইসময় বাইরে থেকে বাংলা গান শোনার তেমন সুযোগ ছিল না। কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা। ফলে বাংলার ছেলেমেয়েদের মতো বাংলা গান শোনার সুযোগ পাইনি দুর্ভাগ্যবশত। প্রথম শুনেছিলাম ‘মধুমতী’ ছবিতে সলিলদার সুর করা গান। তখন আমি স্কুলে পড়ি। তখনই মনে হয়েছিল, এই মানুষের সুর সকলের থেকে অনেকটাই অন্য রকম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, পার্থক্যটা ঠিক কোন জায়গায়। তখন তো সুর নিয়ে তেমন কোনও জ্ঞান তৈরি হয়নি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ওঁর গানের সুর কোনও একটা কারণে আকর্ষণ করে।

৭০-এর দশক, আর একটু তখন বড় হয়েছি। নানা রকমের গান শোনার অভ্যাস হয়েছে। তখন আমি ‘বিটল্‌স’, জোন বায়েজ়ের গান শুনছি। একই সঙ্গে সলিলের গানও শুনছি। আমাকে কিন্তু কেউ বলে দেয়নি, সলিল চৌধুরীর গান শুনতেই হবে। তখন তো ইন্টারনেটও ছিল না। একমাত্র মাধ্যম রেকর্ড ও রেডিয়ো। কিন্তু আমার গান শোনার পরিসরটা বড় ছিল। বিঠোভেন, বিটল্‌সের সঙ্গে সলিল চৌধুরীও শুনেছি।

এই ভাবেই ক্রমশ সলিলদার সুরের বৈচিত্র আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। বুঝলাম, উনি শুধু ছবির গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। ওঁর গণসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় হল আমার। একটা গান আমাকে অবাক করে দিয়েছিল— ‘ও আলোর পথযাত্রী’। তার পর থেকেই সলিল চৌধুরীর বৈপ্লবিক সত্তাকে চিনতে শুরু করলাম। ৭০-এর দশকের শেষের দিকে বুঝতে পারলাম, শুধু সুর নয়। ওঁর গানের কথায় জোরালো মতামত রয়েছে, ক্রোধ রয়েছে, প্রতিবাদ রয়েছে। সলিলদাকে আবিষ্কার করার পদ্ধতিটাই দীর্ঘ। ধাপে ধাপে ওঁকে আবিষ্কার করতে লাগলাম।

সারা বিশ্বের শিল্পীর গান শুনতাম। তাঁদের থেকেও অনুপ্রাণিত হতাম। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, সলিল চৌধুরী ও মাইকেল জ্যাকসন, বিলি জোয়েল সহাবস্থান করছেন কোথাও গিয়ে। সেখানে কিন্তু কখনওই সলিলদার গান ‘আউট অফ প্লেস’ বা ‘বৃত্তের বাইরে’ বলে মনে হয়নি। মাইকেল জ্যাকসন তাঁর গানে বলছেন, ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড, মেক ইট আ বেটার প্লেস’। তার অনেক দিন আগে সলিলদা তাঁর ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গানে একই কথা বলেছেন।

ছাত্রজীবন পার করে আমার সুরকার হয়ে ওঠার সময়ের কথা বলি। শুভা মুদগলের গাওয়া ‘অব কে সওয়ান’ গানটি বেঁধেছি তখন। আমার কিন্তু কোনও ঘরানা ছিল না। সুরকার হয়ে ওঠার কোনও তথাকথিত প্রশিক্ষণ ছিল না। অগত্যা আবার ফিরতে হল সলিলদার গানের কাছে। ভাবতাম, সলিল চৌধুরী থাকলে এই গানটি নিয়ে কী করতেন? তখন অন্তরা (অন্তরা চৌধুরী) মুম্বইয়ে থাকতেন। ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ওঁর থেকে জানতে চাইতাম। এই তথ্যগুলি ছাড়া সুরকার হয়ে ওঠার কোনও আলাদা প্রশিক্ষণ ছিল না।

গ্রাফিক- আনন্দবাজার ডট কম।

এর পরে ‘পরিণীতা’র সুর করতে গিয়ে আর একটা বিষয় আবিষ্কার করলাম সলিলদাকে নিয়ে। সাধারণত বলা হয়, সুর সহজ হলে শ্রোতাদের বুঝতে সুবিধা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সলিল চৌধুরী একদম বিপরীত পথে হাঁটতেন। ‘না জিয়া লাগে না’, ‘কহী বার য়ুঁ হী দেখা হ্যায়’-এর মতো গানের কথাই বলা যাক। এগুলো মোটেই সরল গান নয়। এই ঝুঁকিটা নিতেই হবে। নিজের ভাবনাকে অনুসরণ করেই সৃষ্টি করতে হবে। নির্ভীক হওয়ার এই শিক্ষা আমি ওঁর থেকেই পেয়েছি। উনি বিপ্লবী বলেই এত নির্ভীক। ভয় পেলে সুরকার হওয়া যায় না। মানুষ বুঝতে পারবে না বলে একজন সুরকার তাঁর সৃষ্টি বদলে দিতে পারেন না। সলিলদা মনে করতেন, মানুষ সব বোঝেন। নিজের কাজের প্রতি এই দাপট, এই স্পর্ধাই হল সলিল চৌধুরী।

‘জানে মন, জানে মন’ গানটিও খুব প্রিয় আমার। গানের অন্তরাটা কী অসাধারণ! সুরের যে চলন রয়েছে, প্রশিক্ষিত কোনও শিল্পী ছাড়া গাওয়া সহজ নয়। ‘অন্নদাতা’ ছবির ‘গুজ়র যায়ে দিন’ গানটির ‘সা’ স্বরটি অনবরত পরিবর্তন হতে থাকে। উনি যদি ভয় পেতেন, তা হলে এই গানগুলোই তৈরি হত না। তা হলে উনি সলিল চৌধুরীও হতেন না। মানুষ কী চাইছে, তার সঙ্গে আপস করা ওঁর অভিধানে ছিল না। একজন স্রষ্টা সৃষ্টি করবেনই। আমার সৃষ্টি করতে ইচ্ছে করছে, তাই করছি। বাজারমূল্য আমার সৃষ্টি নির্ধারণ করবে না। এটাই ছিল ওঁর দর্শন।

আজকের যুগে একটা রিল-এই গানের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। একটা গানের আয়ু কত দিন, কেউ বলতে পারে না। কিন্তু সলিলদা তাঁর নির্ভীক সত্তার জন্যই আজও প্রাসঙ্গিক।

সলিল চৌধুরীর সুরও ভ্রাম্যমান। অসমের চা বাগানে বড় হয়েছেন। সেখানকার লোকসঙ্গীত, শ্রমিকদের গানবাজনা শুনেছেন। আবার বাড়িতে হয়তো তিনি পশ্চিমি সঙ্গীত, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনছেন। ব্যাপ্তিটাই বিরাট। বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন অঞ্চলের গান উনি শুনেছেন, তা ওঁর সৃষ্টি শুনলেই বোঝা যায়। ‘মধুমতী’ ছবির গানে মাদল ও বহু সাঁওতালি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। এর পিছনে কিন্তু ওঁর বিশদ গবেষণা ছিল।

লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে রেকর্ডিংয়ে সলিল।

লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে রেকর্ডিংয়ে সলিল।

সারা বিশ্বকে সুরের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারতেন। টেবিল টেনিস খেলতে খেলতে, কখনও আবার রান্না করতে করতে সুর করছেন। আদতেই তিনি পাগলা হাওয়ার মতো। এক জায়গায় ওঁকে আটকে রাখা যায়নি। এই জন্যই সলিলদা বরাবর ভীষণ ভাবে নবীন। আজকের যুগে ‘জেন জ়ি’রা যেমন নির্ভীক, উনিও তেমনই ছিলেন। নিজের পছন্দ, নিজের সৃষ্টির সঙ্গে আপস করেননি। এমন কয়েক জন অবাঙালি বাদ্যযন্ত্রশিল্পীকে দেখেছি, যাঁরা সলিলদার হিন্দি গানগুলি শুনেছেন এবং তাঁরা নতুন করে সঙ্গীতায়োজন করেছেন। সেই গানগুলো শুনলে মনে হবে, ঠিক যেন কোনও ‘জেন জ়ি’ শিল্পী গানটি বেঁধেছেন। এই ভাবেই সলিলদা আজও প্রাসঙ্গিক ও নবীন।

সলিল চৌধুরীর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বোধ ছিল। যে কোনও আন্দোলনের শরিক হতে চাইতেন তিনি। সেই আন্দোলনও তাঁর সৃষ্টিকে আলোকিত করত। মানুষের দারিদ্র, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ওঁর প্রতিবাদ করার মাধ্যম ছিল গান। সলিলের পরে আর কোনও সুরকারের মধ্যে এই বিষয়টা দেখা যায়নি। তারও সেই একটাই কারণ। ওঁর মতো নির্ভীক সুরকার আর আসেননি। উনি কিছু হারানোর ভয় পেতেন না। এখন তো গান শুধু ‘লাইক’ ও ‘ভিউ’ সংখ্যার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে।

শিল্পী সলিল চৌধুরী তো বটেই, মানুষ সলিল চৌধুরী একটা প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে। এক দিকে আইপিটিএ-র গণসঙ্গীত, আর এক দিকে বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গীত। দুটোই কিন্তু সমানতালে করেছেন। বিশেষ রাজনৈতিক দলের থেকে ‘নৈতিক স্খলন’-এর প্রসঙ্গ উঠলেও সলিলদাকে বেঁধে রাখা যায়নি। মানুষটা জনপ্রিয় বলেই কিন্তু ওঁর গণসঙ্গীতগুলোও জনপ্রিয়। প্রবাসী বাঙালি হিসাবে আমি ‘মধুমতী’র গান না শুনলে ওঁর গণসঙ্গীতও শোনা হত না। দুটোর সহাবস্থানে তাই কোনও বাধা থাকতে পারে না।

মহম্মদ রফির সঙ্গে সলিল।

মহম্মদ রফির সঙ্গে সলিল।

আমরাও আজ বলিউডে কাজ করি। কিন্তু ওঁর সম্মান, ওঁর অবস্থান অন্য ছিল। সলিলদা যখন দক্ষিণের বা বলিউডের ছবির গানের রেকর্ড করতে যেতেন, তখন ওঁর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন ছবির পরিচালকেরাও। সলিল চৌধুরীর উপস্থিতি তাঁদের কাছে একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। এই স্থান আমাদের কারও নেই।

সব শেষে আরও একটা বিষয় বলতেই হয়। শ্রেণিবিভাগে একেবারে বিশ্বাস করতেন না সলিলদা। সেই সময় বড়পর্দাই মূল মাধ্যম ছিল। কিন্তু ছোটপর্দার তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না। কিন্তু সেই সব ভেদাভেদ ওঁর কাছে কখনও গুরুত্ব পায়নি। ছবির পাশাপাশি ছোটপর্দার কাজও করেছেন। এমন ছবিও রয়েছে, যার মূল গানগুলি অন্য সুরকারের। উনি শুধুই আবহসঙ্গীত করেছেন। এটাও ওঁর থেকে পাওয়া একটা শিক্ষা। সেই একটা কথা ওঁকে নিয়ে বার বার বলতে হয়। সলিলদার সোজা শিরদাঁড়া ও নির্ভীক সত্তার জন্যই জন্মশতবর্ষেও তিনি একই ভাবে প্রাসঙ্গিক।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)

Salil Chowdhury Shantanu Moitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy