Advertisement
E-Paper

ভাসান গেল পুজোর গান

এক সময় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজত ‘দুরন্ত ঘূর্ণি’... ‘ও মোর ময়না গো’। আজকে আইটিউনস, ইউটিউবের যুগে সবই যেন ধূসর স্মৃতি। লিখছেন সংযুক্তা বসুএক সময় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজত ‘দুরন্ত ঘূর্ণি’... ‘ও মোর ময়না গো’। আজকে আইটিউনস, ইউটিউবের যুগে সবই যেন ধূসর স্মৃতি।

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

কোনও মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে ‘সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি বসে আছি দু’জনায়,’ কোনও মণ্ডপ থেকে ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মউ গো।’ কোথাও বাজছে, ‘প্রখর দারুণ দগ্ধ দিন’ কোথাও বা ‘নয়ন সরসী কেন’....পুজো মানে ছিল পুজোর গান। সারা বছর ধরে সেই গানেরই প্রস্তুতি নিত রেকর্ড কোম্পানিগুলো। প্রস্তুতি নিতেন শিল্পীরা।

এই বছর বেশ কিছু সিডি কোম্পানি চলে যাচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে। পুজোর বাকি মাত্র দেড় মাস, কিন্তু রেকর্ডিং সংস্থাগুলো এখনও পর্যন্ত সিডি প্রকাশের সঠিক পরিকল্পনা করে উঠতে পারেনি। ডিজিটাল রিলিজের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়াতেই এই গড়িমসি। সিডি বিক্রি করে বিনিয়োগের টাকাটুকুও যে অনেক সময় ঘরে আসছে না।

এক সময় পুজোর জামা-জুতোর সঙ্গে সমান তালে কেনা হত পুজোর গান, এখন পুজো আছে গান নেই। ইউটিউবে, আইটিউনস, ইন্টারনেটের যুগে তাই সিডি বাজারে বিক্রি হয় না—বলছিলেন সারেগামা ইন্ডিয়া লিমিটেডের কর্তা ফাজলে করিম। এক সময় ‘এইচ এম ভি’ নামে পরিচিত ছিল সারেগামা। পুজো এলে লং প্লেইং রেকর্ড, সঙ্গে গানের বই নিয়ে হাজির হত এইচ এম ভি। আকাশ-বাতাস ধ্বনিত হত পুজোর গানে।

সে সব দিন এখন শুধুই স্মৃতি।

২০০৯ সালের পর আর পুজোর রেকর্ড বেরোয়নি শ্রীকান্ত আচার্যের। বেদনাহত গলায় বললেন , ‘‘আজকাল সিডি প্লেয়ার প্রায় বাজারে কিনতেই পাওয়া যায় না। গান শোনার কোনও যন্ত্র নেই। লোকে ল্যাপটপে, মোবাইলে গান শুনছে। আগে রেডিওতে পুজোর গান বা বেসিক বাংলা গান শোনা যেত। এখন এফ এম চ্যানেলে শুধুই সিনেমার গান বাজে। এবং সেখানে সাঙ্ঘাতিক প্রতাপ বলিউড-টলিউড প্রযোজকদের। যে প্রযোজক যত বেশি টাকা দেবে, তত বেশি তার ছবির গান বাজবে। এটাই এখন দস্তুর। আর এদের দ্বারাই বাংলা আধুনিক গান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু করার ইচ্ছে জাগে না।’’

এক সময় সেরার থেকে সেরা পুজোর গান প্রকাশ করত আশা অডিও। আজ পুজোর অ্যালবাম প্রকাশে এত দ্বিধা কেন? সংস্থার কর্ণধার মহুয়া লাহিড়ি বললেন, ‘‘যে টাকা বিনিযোগ করে সিডি তৈরি হচ্ছে, বিক্রিবাটার মাধ্যমে তার অর্ধেক টাকাও ঘরে আসছে না। নিষিদ্ধ সাইট থেকে লোকে বিনে পয়সায় গান ডাউনলোড করে শুনছে। তা হলে কী করে সেই ভরসায় আমরা সিডি প্রকাশে জোর দেব?’’

ঠিক সেই কারণেই এই বছর পুজোয় কোনও গান প্রকাশ করছেন না শুভমিতা। বলছেন, ‘‘কোনও কোনও সিডি কোম্পানির খরচ করতে উৎসাহ যথেষ্ট। কিন্তু সিডি বের হওয়ার পর তা দোকানের তাকেই থেকে যায়। লোকে ডিজিটাল মাধ্যমে গান শুনতে চাইছে। তাই সিডি তৈরির পয়সা ঘরে ফেরে না। আমার খুব খারাপ লাগে এই পরিস্থিতিটা। তাই এই বছর আর কোনও পুজোর গান নয়। গত বছর বেরিয়েছিল ‘তোমায় ভালবেসে’ বলে একটা সিডি। আমার ধারণা, ওই অ্যালবামে বেশ কিছু ভাল গান আছে যার আর্কাইভাল মূল্য আছে। আমি চাই, আরও বেশ কিছু কাল লোকে ওই পুরনো অ্যালবামটাই শুনুক। তার পরে আবার নতুন পুজোর গান গাইব সামনের বছর।’’

লোপামুদ্রা মিত্র এ বার পুজোয় কোনও বড় সংস্থার হয়ে পুজোর গান রেকর্ড করছেন না। কারণ সেই একই। তাঁর বক্তব্য, বড় কোম্পানির থেকে রেকর্ড বের হলেই যে ভাল বিক্রি হবে, ভাল প্রচার হবে এমনটা নয়। বললেন, ‘‘সেই জন্য আমি নিজের কোম্পানি থেকেই দুটি রেকর্ড বের করছি।’’

রাঘব চট্টোপাধ্যায়ও এ বার ডিজিটালি গান রিলিজের দিকে ঝুঁকেছেন। তাঁর মতে, লোকজনের গান শোনার অভ্যেস পাল্টেছে। তাঁরা ইন্টারনেটে, আইটিউনসে, ইউটিউবে গান শোনেন। এই অবস্থায় প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে গান ডিজিটাল মাধ্যমে রিলিজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এই বার পুজোয় রাঘর দুটো গানের মিউজিক ভিডিয়ো বাজারে আনছেন। সেই সব গান শোনা যাবে ইউটিউবে, স্মার্টফোনে। তাঁর কথায়, এই সব মাধ্যমে গান শোনানো হলে আন্তর্জাতিক বাজার ছোঁওয়া যাবে। যে সব বাঙালি সিডি হাতে পান না, তাঁরাও গান শুনতে পারবেন ডিজিটাল মাধ্যমে।

আইটিউনসের মতো ডিজিটাল মাধ্যমে গান রিলিজ নিয়ে খুশি কিন্তু রূপম ইসলামও। বলছেন ‘‘সিডির আকারে গান না বেরোলেও কোনও ক্ষতি নেই। লোকজন ডিজিটাল মাধ্যমে গান শুনছে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে গান। হন্যে হয়ে দোকানে দোকানে গিয়ে গানের অ্যালবাম খুঁজতে হচ্ছে না।’’ পুজোতেও যদি রূপমের গান বেরোয়, তবে সেটা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই রিলিজ করাবেন। তার প্রথম কারণটা যদি নেট স্যাভি জেনওয়াই শ্রোতা হন, তবে আর একটা কারণ আইনি সাইটগুলোতে গান শুনলে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা পান শিল্পীরা।

অন্য দিকে, গায়ক রূপঙ্করের পুজোয় একটি সিডি বেরোলেও তিনি পুজোর গানের বাজার নিয়ে খুবই হতাশ। বললেন ‘‘বেআইনি সাইট থেকে গান ডাউনলোড করে শোনা যদি বন্ধ না হয়, তা হলে পুজোয় সিডি করে লাভ কী?’’ জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের আটটি গান নিয়ে মনোময় ভট্টাচার্যেরনতুন অ্যালবাম এই বার পুজোয় প্রকাশিত হতে চলেছে। তবুও তিনি আশাহত।
‘‘শুধু আমার একার সিডি দিয়ে তো মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে না। বাদবাকি শিল্পীদেরও এগিয়ে আসতে হবে সিডি প্রকাশের জন্য। শুধু তাই নয়, শ্রোতাদেরও সচেতন হতে হবে গান শোনার ব্যাপারে। তাঁরা যেন ন্যায্য মূল্য দিয়ে গান শোনেন। সেটা ইন্টারনেটেই হোক বা আস্ত সিডি কিনেই হোক।’’

সিডি-র বাজার মন্দা হলেও বেশ কিছু সংস্থা এই প্রতিকূলতার মধ্যেও পুজোর গান অডিও সিডির আকারে প্রকাশ করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে সাগরিকা মিউজিক প্রাইভেট লিমিটেড। এই সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা বরুণ নন্দী বলছেন, ‘‘ আজও সিডি বিক্রি হয়। যাঁদের বয়স ৪৫-এর উপরে, তাঁরা এখনও সিডি কিনে শোনায় অভ্যস্ত। এ বছরও আমাদের চব্বিশটা সিডি বেরোবে।’’

সিডির বিক্রি কমলেও কোনও কোনও সংস্থার মধ্যে এখনও সিডি প্রকাশ করার যে উদ্যম রয়েছে সেটাই এই বাজারে বড় ব্যাপার। তবে তারা কিন্তু সংখ্যালঘু।

এক সময় পুজো আসত বাংলা গান নিয়ে, ঠিক শরতের শিউলির মতোই। ইউটিউব-আইটিউনসের জমানায় কোথায় যেন হারিয়ে গেল বাংলা গানের সেই উজ্জ্বল অধ্যায়।

pujo songa puja celebration immersion sanjukta basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy