Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কাশ্মীরি মাত্রেই জঙ্গি নয়

কিন্তু হিদায়াত এক জন সিক্রেট এজেন্ট। সালটা ১৯৭১, ভারত-পাকিস্তানের আকাশে যুদ্ধের মেঘ। হিদায়াতের ফুসফুসে টিউমার, দেশের কাজ আর তার করা হবে না।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৮ ০০:৫৫
Share: Save:

গু প্তচর কি শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযানশেষে বিধ্বস্ত ও অচেতন হয়ে পড়ে? সুপারগার্লরা কি ধারাস্নানেও কান্নায় ফুলে ফুলে ওঠে?

মেঘনা গুলজারের ‘রাজ়ি’তে আলিয়া ভট্টকে মনে থাকবে এই কারণেই। এখানে তিনি সেহমত নামে এক কাশ্মীরি কন্যার চরিত্রে। বাবা, ঠাকুর্দা স্বাধীনতা-সংগ্রামী। বাবা হিদায়াত (রজিত কপূর) ব্যবসা সূত্রে প্রায়শই পাকিস্তানে যাতায়াত করে। সে দেশের সামরিক বিভাগের উপরমহলে তার অনেক বন্ধু আছে। লাহৌর, রাওয়ালপিণ্ডিতে সকলেই তাকে বিশ্বাস করে।

কিন্তু হিদায়াত এক জন সিক্রেট এজেন্ট। সালটা ১৯৭১, ভারত-পাকিস্তানের আকাশে যুদ্ধের মেঘ। হিদায়াতের ফুসফুসে টিউমার, দেশের কাজ আর তার করা হবে না।

তাই দিল্লির কলেজে পাঠরতা কন্যাকে শ্রীনগরে ডেকে পাঠায় হিদায়াত। তার বন্ধুপুত্র, পাকিস্তানি সেনা-অফিসার মেজর ইকবাল সৈয়দকে (ভিকি কৌশল) বিয়ে করতে হবে সেহমতকে। পাকিস্তানি সেনা-ছাউনি হবে তার শ্বশুরবাড়ি। সেখান থেকে গোপন তথ্য পাঠাতে হবে ভারতীয় সেনাবিভাগকে। ভুলচুক হলেই মৃত্যু। কিন্তু দেশপ্রেম অতি বিষম বস্তু! মেয়েকে দাবার বোড়ে করতেও সে পিছপা হয় না।

অতএব শত্রুপক্ষের অন্তঃপুরে বাড়ির বউ হয়ে ঢুকে পড়া! কখনও সে মেয়ে গোপনে ‘বাগিং ইনস্ট্রুমেন্ট’ দিয়ে টেলিফোনে আড়ি পাতার ব্যবস্থা করে, কখনও নিজেকে বাঁচাতে বাড়ির বয়স্ক ভৃত্যকে গাড়ি চাপা দিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে। আবার কখনও স্বামী অন্য ঘরে শুতে গেলে ঠোঁটে অভিমানী পাউটিং: একা শুতে ভাল লাগে না। এই বিপন্ন ভঙ্গুরতা আলিয়া ভট্টের মতো মেঘবালিকা ছাড়া কেই বা তুলে ধরতে পারত!

রাজি পরিচালনা: মেঘনা গুলজার অভিনয়: আলিয়া ভট্ট, ভিকি কৌশল, রজিত কপূর ৭.৫/১০

কিন্তু এ শুধুই উপরিতলের খেলা। ভবানী আইয়ারের চিত্রনাট্য আর মেঘনার পরিচালনায় রয়ে গেল আরও কিছু নীরব অন্তর্ঘাত। কাশ্মীরি মাত্রেই জঙ্গি এবং পাক-সমর্থক নয়। ’৭১-এর যুদ্ধে মানববোমার মতোই তারা কেউ কেউ স্বেচ্ছায় শত্রুদেশে অভিযান বেছে নিয়েছিল।

এই ছবিতে তিন বার আলিয়ার কান্না আছে। প্রথমে বিশ্বস্ত গৃহভৃত্যকে গাড়ি চাপা দিয়ে, দ্বিতীয় বার ভাসুরের পায়ে বিষমাখা সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে, আর তৃতীয় বার ভারতীয় গুপ্তচর-সংস্থার সৌজন্যে তার স্বামী বোমায় উড়ে গেলে। তৃতীয় কান্নাটি প্রায় হাউহাউ করে, একটু মেলোড্রামাটিক লাগছিল। কিন্তু তখনই পর্দায় ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা তাকে বোঝায়, ‘যুদ্ধে মরতেই হয়। দোষী, নির্দোষ কারও না কারও প্রাণ যায়।’ জাতীয়তাবাদ নামক প্রতিষ্ঠানটি সর্বদা অনড়, অটল। এক মেয়ের দ্বিধা থরথর, অশ্রু-ছলছল চোখে তার কিছু যায় আসে না।

‘রাজ়ি’র বৈশিষ্ট্য এখানেই। হাল আমলের জাতীয়তাবাদী পাক-বিরোধী জিগিরে অন্তর্ঘাত! আলিয়া তো শুধুই সিক্রেট এজেন্ট নন, ভিকিও নন শুধুই পাকিস্তানি সেনা-অফিসার। সেহমত ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত শুনতে ভালবাসে বলে সে ওই গানের রেকর্ড নিয়ে আসে। ছবির শেষ দিকে ইকবাল বলে, ‘আমরা যেমন আমাদের দেশের জন্য অপারেশন করছি, সেহমতও তাই।’ তার একটু আগেই দু’জন ভেসে গিয়েছে শরীরী সংশ্লেষে, মানসিক সংরাগে। শেষ অবধি ‘আন্ডারকভার এজেন্ট’-এর খোলস খসে পড়েছে, তবু কোথায় যেন দু’জনের পরস্পরের প্রতি ‘মায়া রহিয়া গেল’! শেষ দৃশ্যে তাই পাথরপ্রতিমার মতো আলিয়া মাটির কুঁজোর পাশে বসে। সামনে তার মা (সোনি রাজদান)।

অন্তর্ঘাত কি একটাই? শঙ্কর-এহসান-লয়ের সুরে ‘অ্যায় ওয়াতন’ বলে একটা গান আছে ছবিতে। দেশপ্রেমের গান। একটি অনুষ্ঠানের জন্য পাকিস্তানি শিশুদের গানটি শেখায় সেহমত। অনুষ্ঠানের দিন শিশুদের পাশাপাশি মঞ্চের কোণে তারও ঠোঁট নড়ে ওঠে। গান একই, কিন্তু দেশপ্রতিমা দুই রকম।

এই চমৎকার ছবিতে চোখে লাগে দু’-তিনটি ভুল। ভারতীয় সিক্রেট সার্ভিস অনেক তালিম দিয়ে সেহমতকে পাকিস্তানে পাঠাল, কিন্তু ঘরে সামান্য এক মই বেয়ে নামতে গিয়ে তার পা মচকে গেল! পাশে খোলা জানালা থাকলে কোন গুপ্তচর ঘরে বাগিং মেশিন লাগাবে? একটি দৃশ্যে সেহমতের টেবিলে ভিজে চুল শোকানোর ড্রায়ার। সত্তর দশকে পাকিস্তানে হেয়ার ড্রায়ার এত সহজলভ্য ছিল?

খুঁত নিয়ে খুঁতখুঁতুনিতে লাভ নেই। নিখুঁত শিল্প আর সোনার পাথরবাটি প্রায় এক। কিন্তু মহিলা চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকের নায়িকাপ্রধান ছবি নিরুচ্চারে একটা কথা বুঝিয়ে দিল। পাকিস্তান নিয়ে ৫৬ ইঞ্চি ছাতির বিকাশপুরুষের বয়ানটিই সব নয়, তার বাইরে আরও অনেক কিছু আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Raazi Movie Release
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE