Advertisement
০২ মে ২০২৪
Movie Review Of Barbie

প্লাস্টিকের পুতুলই কি ঘোচাবে পিতৃতন্ত্রের পরম্পরা? গ্রেটা গারউইগের ‘বার্বি’ ছবিতে মিলবে উত্তর?

‘লেডি বার্ড’, ‘লিটল উইমেন’-এর পর এ বার ‘বার্বি’। নিজে আদ্যোপান্ত ‘ফেমিনিস্ট’ বলে পরিচিত গ্রেটা গারউইগ। তাঁর তৃতীয় ছবি ‘বার্বি’ কি নারীবাদের ধ্বজা ওড়াতে পারল? জানাচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন।

Margot Robbie in Barbie.

‘বার্বি’ ছবিতে মার্গো রবি। ছবি: সংগৃহীত।

স্নেহা সামন্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ১৮:১৭
Share: Save:

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে মুক্তি পাওয়া ‘বার্বি’ গানটা মনে আছে? ডান্স-পপ গ্রুপ ‘অ্যাকোয়া’র ওই গান মুখে মুখে ঘুরত নব্বইয়ের কচিকাঁচাদের। জন্মদিনের উপহারের ঝুলিতে আর কিছু থাক না থাক, খান কয়েক ‘বার্বি’ পুতুল থাকতই। গোলাপি জামা পরা অপূর্ব সুন্দরী একটি পুতুল, চোখেমুখে তার নিখুঁত রূপটান। অথচ সে বাক্সবন্দি। তার সমস্ত সৌন্দর্য যেন খাঁচাবন্দি এক পাখির মতো। বাক্স থেকে বেরিয়ে আসল দুনিয়ায় পা রাখলেই যেন মলিন হয়ে যাবে সে। ছোটবেলায় উপহারে পাওয়া সেই বার্বি পুতুল নিয়ে খেলাও ছিল অনেকটা নিয়মমাফিক, ওই পুতুল নিয়ে বেশি খেললে যে তার নিখুঁত সাজপোশাক নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সেই বার্বিই যদি এক দিন পরিপাটি গোলাপি বাক্স থেকে বেরিয়ে পা রাখে আসল দুনিয়ায়? যে দুনিয়া প্লাস্টিকে নয়, আগাগোড়া পিতৃতন্ত্রে মোড়া। সেই দুনিয়ার সঙ্গে কী করে যুঝবে সে?

Margot Robbie in Barbie movies.

‘বার্বি’ ছবিতে মার্গো রবি। ছবি: সংগৃহীত।

হলিউড অভিনেত্রী মার্গো রবি তথা বার্বি, ‘বার্বিল্যান্ড’-এর সব থেকে সুন্দরী বার্বি। ‘বার্বিল্যান্ড’-এর গতে বাঁধা বার্বি পুতুল সে, যার চুলের রং থেকে পোশাকের দৈর্ঘ্য সবটাই গ্রাহকের মন ভরানোর কথা মাথায় রেখে হিসাব করা। এই বার্বির রূপে মুগ্ধ হয়ে এত বছর ধরে নারীর তথাকথিত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা সাজিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। নারী মানেই তাকে হাসিখুশি হতে হবে, অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী হতে হবে, কিন্তু তার মাথায় বেশি বুদ্ধি থাকলে চলবে না। কারণ বেশি বুদ্ধিমতী হয়ে গেলেই তো সে বুঝে ফেলবে, সমাজের বোনা এই খাঁচার থেকে অনেক বড় এই পৃথিবী। যেখানে পিতৃতন্ত্র নারীদের জীবন ও যাপনে থাবা বসায় না। যেখানে নারীরা শুধু রূপের ধ্বজাধারী নয়, বরং তাদের বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতা তাদের সৌন্দর্যের মাপকাঠি। ‘বার্বিল্যান্ড’ তেমন একটা দুনিয়া, যেখানে পিতৃতন্ত্রের লেশমাত্র নেই।

বরং সেই দুনিয়া যে মাতৃতন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, এ কথা বললে ভুল বলা হয় না। সেখানে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও বার্বি। সেখানকার চিকিৎসক থেকে শুরু করে শ্রমিক— সবাই বার্বি। কারণ বার্বি মানেই তো নারী। সব নারীই যে আদপে বার্বিই। আর তারা কোনও সামাজিক সংজ্ঞায় বাঁধা দম দেওয়া পুতুল নয়। তাদের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা আছে, নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। তারা যে ভাবে চায়, সে ভাবেই নিজেদের গড়েপিটে নিতে পারে। নিজের ছবিতে বার বার একাধিক দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সেই দাবিই রাখতে চেয়েছেন পরিচালক গ্রেটা গারউইগ।

Margot Robbie and Ryan Gosling in Barbie movie.

‘বার্বি’ ছবিতে রায়ান গজ়লিং ও মার্গো রবি। ছবি: সংগৃহীত।

বার্বিল্যান্ডে হেসেখেলে দিন কাটাতে কাটাতে এক দিন হঠাৎ করেই বার্বির মনে মৃত্যুর চিন্তা জাগে। তার দিন কয়েকের মধ্যেই সে দেখে, তার পায়ের পাতার ধরন বদলে গিয়েছে, উরুর দিকে জমেছে মেদ। তার নিখুঁত সৌন্দর্য বাঁচাতে ‘উইয়ার্ড বার্বি’র শরণাপন্ন হয় সে। উইয়ার্ড বার্বি (কেট ম্যাককিনন) তাকে নিজের সৌন্দর্য ফিরে পাওয়ার উপায়ও বাতলে দেয়। বাস্তব দুনিয়ায় গিয়ে তাকে খুঁজে বার করতে হবে সেই মানুষকে, যে এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে তার সঙ্গে খেলা করছে। রংচঙে প্লাস্টিকের দুনিয়া ছাড়ার ইচ্ছে তেমন না থাকলেও বাস্তবের মাটিতে পা রাখে বার্বি। তার সঙ্গী হয় কেন (রায়ান গজ়লিং)। বার্বির প্রতি বরাবরই কিছুটা দুর্বল সে, ভাবে এই সুযোগে যদি বার্বির কাছে আসতে পারে!

Margot Robbie and Ryan Gosling in Barbie movie.

‘বার্বি’ ছবিতে সিমু লিউ, মার্গো রবি ও রায়ান গজ়লিং। ছবি: সংগৃহীত।

বাস্তবের দুনিয়ার পা রেখে কান্নার মতো আবেগের সঙ্গে পরিচিত হয় বার্বি। আর কেন পড়তে শুরু করে পিতৃতন্ত্রের প্রথম পাঠ। কী সেই পাঠ? যোগ্যতা থাক বা না থাক, স্রেফ পুরুষ হওয়ার জোরেই গোটা সমাজের মাথা হয়ে উঠতে পারবে সে। তার চলাফেরাতেও আস্তে আস্তে ধরা পড়তে থাকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া এই আত্মবিশ্বাস। বাস্তব দুনিয়ায় বার্বির লক্ষ্য পূরণ হোক বা না হোক, বার্বিল্যান্ডে ফিরে পিতৃতন্ত্র চালু করবে সে— মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করে কেন। অন্য দিকে বার্বি খুঁজে পায় সেই মা-মেয়ে জুটিকে, যাদের কারণে তাঁর নিখুঁত সাজপোশাকে বদল এসেছে। বার্বির প্রণেতা, ‘ম্যাটেল’ সংস্থার হাত থেকে বাঁচতে ওই মা-মেয়ে জুটিকে নিয়েই বার্বিল্যান্ডে ফেরে বার্বি।

Kate Mckinnon in Barbie movie.

‘বার্বি’ ছবিতে কেট ম্যাককিনন তথা ‘উইয়ার্ড বার্বি’। ছবি: সংগৃহীত।

বার্বিল্যান্ডে ফিরে তো অবাক বার্বি। বাস্তব দুনিয়া আর বার্বিল্যান্ডের মধ্যে আর কোনও ফারাকই নেই। বার্বিল্যান্ডেও এখন রাজ করছে কেন-রা। গুরুত্বপূর্ণ সব পদ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বার্বিদের। তাদের বদলে সেখানে বসেছে একঝাঁক কেন। এক সময় গোলাপি আভায় ভরা বার্বিল্যান্ড এখন জৌলুস হারিয়ে প্রায় মলিন। প্লাস্টিকের বদলে সেখানে এখন শুধুই পিতৃতন্ত্র। এই সর্বগ্রাসী পিতৃতন্ত্র থেকে বার্বিল্যান্ডকে কী ভাবে রক্ষা করবে বার্বি? সে তো একটা সুন্দর দেখতে পুতুল মাত্র, এত ভারী কাজই বা সে করবে কী করে?

A scene from Barbie movie.

‘বার্বি’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

ছবির গল্পের সারবত্তা এইটুকুই। তবে সহজ-সরল, কিছুটা একরৈখিকও। তবে সেই সারল্যের মোড়কেই গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন গ্রেটা। এখন পর্যন্ত মাত্র দু’টি মূলধারার ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি, ‘লেডি বার্ড’ এবং ‘লিটল উইমেন’। ‘বার্বি’ তাঁর তৃতীয় ছবি। তৃতীয় ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই যে ভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছেন গ্রেটা, তা তাঁর বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় বহন করে। ছোটবেলায় নাট্যকার ও নির্দেশক হওয়ার ইচ্ছা ছিল গ্রেটার। রুটম্যাপে কিছুটা বদল এনে চিত্রনাট্যকার হিসাবে হলিউডে কাজ করা শুরু করেন তিনি। ‘ফ্রান্সেস হা’ ছবি থেকে প্রেমিক নোয়া বমবাখের সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করছেন গ্রেটা। ওই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।

Greta Gerwig with the Barbies.

‘বার্বি’ ছবির অভিনেত্রীদের সঙ্গে পরিচালক গ্রেটা গারউইগ। ছবি: সংগৃহীত।

চিত্রনাট্যও নোয়ার সঙ্গেই জুটি বেঁধেই লিখেছেন তিনি। গুরুগম্ভীর জ্ঞান বিতরণের থেকে সহজ ভাবে সহজ কথা বলায় বিশ্বাসী গ্রেটা। গত দু’টি ছবিতেই বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের মাধ্যমে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছিলেন। ‘বার্বি’তেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আদ্যোপান্ত ‘স্যাটায়ার’-এর মাধ্যমে ফেমিনিজ়মের গম্ভীর ও বিতর্কিত বিষয় নিয়ে খেলেছেন গ্রেটা। যেই ইজ়মে পিতৃতন্ত্র বা মাতৃতন্ত্রের জায়গা নেই, সম-অধিকারের দুনিয়ায় নিজেকে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা আছে। যেখানে গতে বাঁধা লিঙ্গবৈষম্যের কচকচানি নেই, বরং সেই দুনিয়ায় নারীদের সমুদ্রসৈকতে ভলিবল খেলা ও পুরুষদের চিয়ারলিডিং করার মধ্যে লেশমাত্র অস্বাভাবিকতা নেই। সমানাধিকারের এক পৃথিবীতে সম্ভাবনা আর স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে কল্পনায় শান দিয়েছেন গ্রেটা। ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, ছবির গল্প ঋদ্ধ হয়েছে সেই কল্পনায়।

‘বার্বি’র অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় ছবির ‘মুডবোর্ড’। বার্বিল্যান্ডে বার্বিদের ‘ড্রিম হাউস’ থেকে শুরু করে সমুদ্রসৈকত— সবটাই যেন ‘মেক-বিলিভ’-এর এক মন ভাল করা দুনিয়া। সেই হাসিখুশির দুনিয়ায় বলিউডি ছোঁয়াও রয়েছে ভরপুর। ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’ ছবির ‘ডিস্কো দিওয়ানে’ গানের কথা মনে আছে? নাচগানের দিক দিয়ে আলিয়া ভট্ট, বরুণ ধওয়ান, সিদ্ধার্থ মলহোত্রের থেকে কিছু কম যান না মার্গো রবি, রায়ান গজ়লিং, সিমু লিউরা। শেষ পাতে রায়ান গজ়লিং ও সিমু লিউয়ের ‘ফেস অফ’ ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ ছবিতে মাধুরী দীক্ষিত ও করিশ্মা কপূরের নাচের ফেস অফের দৃশ্যের কথা আপনাকে মনে করাবেই। নেহাত, গানে গানেই সব কথা বলা হয়নি এই ছবিতে। না হলে নিশ্চিন্তে ‘বার্বি’কে ‘মিউজ়িক্যাল স্যাটায়ার’ তকমা দেওয়াই যেত।

মাত্র ১১৪ মিনিটের ছবি ‘বার্বি’। এত কম সময়ের ছবি হওয়ার সত্ত্বেও ছবির শেষের দিকে এসে কিছুটা ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে দর্শকের। শেষের দিকে যখন ‘অল ইজ় ওয়েল’ হল বলে, সেই সময় ছবির সম্পাদনা আরও একটু টানটান হলে ক্ষতির বদলে লাভই হত বরং। ছবিতে অভিনেতাদের মধ্যে মার্গো রবি, রায়ান গজ়লিং মুখ্য ভূমিকায় থাকলেও নজর কেড়েছেন কেট ম্যাককিনন, সিমু লিউ, আমেরিকা ফেরেরা ও অ্যারিয়ানা গ্রিনব্ল্যাট। মা ও মেয়ের জুটিতে অনবদ্য আমেরিকা ও অ্যারিয়ানা। তবে ‘বার্বি’ ছবিতে ফেমিনিজ়মের যে একরৈখিক ছবি এঁকেছেন গ্রেটা, তা নজর এড়িয়ে যায় না কোনও ভাবেই। যেমন বার্বিল্যান্ডে বিভিন্ন চেহারা ও বিভিন্ন রঙের বার্বি থাকা সত্ত্বেও তাদের উপর তেমন ভাবে আলো ফেলতে পারেননি গ্রেটা। বার্বিল্যান্ডের কালো চামড়ার রাষ্ট্রপতির গল্প ছবিতে একটুও পাত্তা পায়নি। পাত্তা পাওয়া তো দূর, সেই বার্বির রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠার নেপথ্যেই গল্পই নেই ছবিতে।

শুধু তাই-ই নয়, আধুনিক সমাজে ফেমিনিজ়মের অন্যতম নির্যাস শ্রেণি সংগ্রাম ও তা থেকে আত্মীকৃত শিক্ষা। বিশেষ করে ‘বার্বি’র ভাবনা যে পুঁজিবাদী ও ভোগসর্বস্ব পরম্পরার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে একরৈখিকতা একেবারেই যথেষ্ট নয়। গ্রেটা গারউইগের ‘বার্বি’ পিতৃতন্ত্রের গলদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় বটে, তবে যে কোনও তন্ত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে জাতি-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সম-অধিকারের সমাজ কী ভাবে তৈরি করা সম্ভব, সেই প্রশ্নকে সযত্নে এড়িয়েই যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE