E-Paper

আবেগ ও অভিনয়ের অব্যর্থ জুটি

১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মিনি আর কাবুলিওয়ালার গল্প সাজিয়েছেন সুমন। এ শহরে সওদা করতে আসা কাবুলিকে বার বার বলতে হয়, “আমি পাকিস্তানি নই, আফগানিস্তানের পাঠান।”

সায়নী ঘটক

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৫৪
Kabuliwala

‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির একটি দৃশ্যে মিঠুন চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলার ‘ক্লাসিক’ সাহিত্য, তার উপর যদি তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি হয়, তা হলে সেটি নিয়ে ছবি তৈরির আগে সাতপাঁচ ভাবতে হয় বইকি। কিন্তু পরিচালক সুমন ঘোষ দ্বিধাহীন ভাবেই নিজের মতো করে ‘কাবুলিওয়ালা’ তৈরি করেছেন, সততার সঙ্গে। নিয়েছেন মিঠুন চক্রবর্তীর মতো এক জাত অভিনেতাকে, যাঁকে ছবি বিশ্বাস, বলরাজ সাহনির জুতোয় পা গলাতে হয়েছে। ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর অভিনেতা এ বার রহমত খান হয়ে পর্দায় ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা দিচ্ছেন দেখলে ফের বিশ্বাস জন্মায়, যে দলেরই হোন, শিল্পীর আসলে কোনও জাত-ধর্ম-রং থাকে না। অপত্যস্নেহের চিরকালীন আবেগকে পুঁজি করে তৈরি এই ছবিকে হৃদয় অবধি পৌঁছে দিয়েছে মিঠুনের অভিনয়।

১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মিনি আর কাবুলিওয়ালার গল্প সাজিয়েছেন সুমন। এ শহরে সওদা করতে আসা কাবুলিকে বার বার বলতে হয়, “আমি পাকিস্তানি নই, আফগানিস্তানের পাঠান।” এতগুলো বছর পরেও ঘৃণার চোরাস্রোত মাথাচাড়া দিয়েছে বলেই হয়তো এমন প্রেক্ষাপট বেছে সমন্বয়ের বার্তা দিতে হল পরিচালককে। বিষয়ের সঙ্গে খাপ খেয়ে গেলেও কোথাও কোথাও এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা মোটাদাগের পারদ ছুঁয়েছে। বিশেষ করে যেখানে মিনির বাবা-মায়ের ঘরোয়া কথোপকথনে কাবুলিওয়ালার খাদ্যাভ্যাস, জাত-ধর্মের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রহমতের ভালমানুষি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যতখানি, ততটা বিশদে উঠে আসেনি তার ব্যবসায়িক লেনদেনের বিষয়। এ দেশে আসামাত্র সদ্য চেনা বাঙালির ভাষা সে কী করে অত তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলল, তা-ও বিস্ময়কর! গল্পে যে অপরাধে রহমতের সাজা হয়েছিল, সেখানে মিনির প্রসঙ্গ ছিল না। এখানে মিনিকে নিয়ে এক দুর্জনের কটূক্তির জেরেই মাথা ঠিক রাখতে পারে না রহমত। এ ছবির ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছে বিষয়টি। ১৫ বছর পরে যখন জেল থেকে বেরোয় সে, চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। মিঠুনের চেহারায় এই সময়ের ফারাকটা ধরা সহজ হলেও বিসদৃশ লেগেছে মিনির বাবা-মায়ের ভূমিকায় আবীর চট্টোপাধ্যায় ও সোহিনী সরকারের বয়স্ক মেকআপ। ১৫ বছরের তফাত প্রায় কিছুই ধরা পড়েনি তাঁদের চেহারায়। যদিও অভিনয়ে তাঁরা সেটা পুষিয়ে দিয়েছেন। বড় বয়সের মিনি এখানে সঙ্কোচহীন, হাসিমুখে রহমতকে বলে ‘আসছি’। অথচ ১৯৬৫-র কনেরা স্বভাবলাজুক হবে, অচেনা কাবুলির ‘সসুরবাড়ি’ সংক্রান্ত মশকরায় সে অপ্রতিভ হয়ে উঠবে, এমনটাই দস্তুর ছিল হয়তো... তবে এই দৃশ্যে মিঠুনের অভিনয় মন ছুঁয়ে গিয়েছে। গল্পের গুণে আর মিঠুনের বলিষ্ঠ পারফরম্যান্সের জোরেই সুমন ঘোষের ‘কাবুলিওয়ালা’ বুকে এসে ধাক্কা দিতে পারে।

মিনির সঙ্গে রহমতের রসায়ন এই গল্পের মেরুদণ্ড। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’র বদলে মিনি ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’ নেচেগেয়ে দেখায় রহমতকে। শিশুর নিষ্পাপ সারল্য তার অসমবয়সি বন্ধুর পাশাপাশি ছুঁয়ে যায় দর্শককেও। মিনির চরিত্রে অনুমেঘা কাহালির নির্বাচন যথার্থ। এতটুকু বাড়াবাড়ি বা ‘পাকামি’ করেনি সে। মিঠুনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব যে পর্দার বাইরেও জমে উঠেছিল, তা ছবিটি দেখলে আঁচ করা যায়। আবীর চট্টোপাধ্যায় ও সোহিনী সরকার মিনির বাবা-মায়ের চরিত্রে যথাসাধ্য করেছেন, চিত্রনাট্য অনুযায়ী। ভোলার চরিত্রে সুমিত সমাদ্দার, মোক্ষদার চরিত্রে গুলশনারা খাতুনও লাগসই।

ছবির শুরুতে রুক্ষ মরুপ্রান্তরের প্রেক্ষাপটে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কণ্ঠে ‘কাবুল মানুষ’ গমগমিয়ে ছবির মেজাজ তৈরি করে দেয়। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের আবহ ও সঙ্গীতনির্মাণ ছবির চলনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। ‘খুশি কী ইদ’ গানটির সঙ্গে নেচে উঠলেন মিঠুন চক্রবর্তীর ফ্যানক্লাবের সদস্যরা— শহরের মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা ছবি চলাকালীন এমন দৃশ্য বহু দিন পরে দেখা গেল! ’৬৫ সালকে ধরতে সে সময়কার সমাজ, সিনেমা, রাজনীতি, খেলা... বহু অনুষঙ্গই ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে। পাশাপাশি এ ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং পোশাক পরিকল্পনাও প্রশংসনীয়।

মেয়ে রাজ়িয়ার ভুষো কালিমাখা হাতের ছাপ কাগজে তুলে বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় রহমত। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, সওদা মাথায় ওঠে সন্তানকে কাছে না পাওয়ার কষ্টে। নামী অভিনেতাদের সঙ্গে তুলনা না টেনেও বলা যায়, নিজের মতো করে মিঠুন যে ভাবে রহমতকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর শরীরী ভাষা ও অভিব্যক্তিতে, তার জুড়ি মেলা ভার। তাঁর মতো করে রহমতকে জ্যান্ত করে তুলতে পারতেন আর কোন অভিনেতা, ভাবতে বেগ পেতে হবে।

শতাধিক বছর আগে লেখা এই রবীন্দ্র-রচনা আরও একবার চেনা আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, অনুভূতির গভীরে গিয়ে নাড়া দেবে, সেই উদ্দেশ্যেই ২০২৩ সালে ফের তৈরি হয়েছে ‘কাবুলিওয়ালা’। পরিচালককে ধন্যবাদ, তাঁর সেই উদ্দেশ্য বিফলে যায়নি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mithun Chakraborty Bengali Movie Tollywood Movie Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy