Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পরম প্রাপ্তির ঝুলি ভরল কি?

নিজের অভিনীত রবি বর্মার চরিত্রে সংযোজন হোক কিংবা ব্যোমকেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ— শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মগ্নমৈনাক’কে পর্দায় আনতে গিয়ে অঞ্জন অনেকটাই স্বাধীনতা নিয়েছেন। যার মান রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সায়ন্তন, পরমব্রতরা। কতটা পেরেছেন, সেটা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ।

সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ ছবির একটি দৃশ্য।

সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ ছবির একটি দৃশ্য।

সায়নী ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৯ ০১:৩৫
Share: Save:

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী? না সায়ন্তন ঘোষালের? না কি অঞ্জন দত্তের? ছবিটা দেখার পর শেষ গোত্রে ফেলতে ইচ্ছে করবে ‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ’কে। এ প্রজন্মের সঙ্গে ব্যোমকেশকে পর্দায় পরিচয় করিয়েছিলেন যিনি, সেই অঞ্জন দত্ত এ ছবির স্ক্রিপ্ট ও ক্রিয়েটিভ উপদেষ্টার দায়িত্বে। তাই তাঁর ঘরানার ব্যোমকেশ কাহিনির লক্ষণগুলো এ ছবিতেও স্পষ্ট। নিজের অভিনীত রবি বর্মার চরিত্রে সংযোজন হোক কিংবা ব্যোমকেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ— শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মগ্নমৈনাক’কে পর্দায় আনতে গিয়ে অঞ্জন অনেকটাই স্বাধীনতা নিয়েছেন। যার মান রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সায়ন্তন, পরমব্রতরা। কতটা পেরেছেন, সেটা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ।

‘মগ্নমৈনাক’ আপাতদৃষ্টিতে পারিবারিক কেচ্ছা, অবিশ্বাস, খুনের জালে বোনা কাহিনি হলেও তার আধার দেশভাগ ও তৎকালীন রাজনীতি। তার সঙ্গে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, মুজিবুর রহমানের আন্দোলন, নকশালবাড়ির অনুষঙ্গ মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে চিত্রনাট্যে। আত্মপ্রকাশের দৃশ্যে ব্যোমকেশ লিনেন শার্ট আর ট্রাউজ়ার্সে, বঙ্গবন্ধুর চিঠি সযত্ন পৌঁছনোর ব্যবস্থা করছে দিল্লিতে। তবে শুরুতেই দেখানো এই ঘটনার সঙ্গে বাকি তদন্তের সম্পর্ক নেই। বরং এই দৃশ্য প্রতিষ্ঠা করে ব্যোমকেশের রাজনৈতিক ঝোঁক। ছবির শেষের দিকে যা ব্যোমকেশকে দিয়ে বলানোও হয়েছে। কংগ্রেসি সরকারের হয়ে কাজ করা ব্যোমকেশের নকশালদের সিমপ্যাথাইজ় করার প্রসঙ্গ রয়েছে। এবং অজিতের লেখনীতে তা এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা নিজের মতো করে সাজিয়েছেন নির্মাতারা। এই রাজনৈতিক ব্যোমকেশকে খানিক আরোপিতই লাগে, বাঙালিয়ানাতেও যেন ঘাটতি রয়েছে। আর বিপ্লবী অরবিন্দকে ‘টেররিস্ট’ না বললেই বোধহয় ভাল হত!

এত রকমের ব্যোমকেশকে দেখে দর্শকের অভ্যস্ত চোখ পরমব্রতকে কোন নিক্তিতে মাপবেন, বলা মুশকিল। পরমের ব্যোমকেশ স্মার্ট, চালাকচতুর। তবে সত্যান্বেষণ, তার বিশ্লেষণ ও চিন্তাশীলতার কোনও মুহূর্ত সে ভাবে তৈরি হল না। অজিতের সঙ্গে কেমিস্ট্রিতে পরমব্রত-রুদ্রনীলের অফস্ক্রিন রসায়ন ধরা পড়লেও তাদের আলোচনা কোনও সমাধানসূত্রে পৌঁছে দেয় না। আর এই অজিতকে লেখক বলে ভাবা একটু কঠিন। রুদ্রনীল তাঁর ম্যানারিজ়ম থেকে বেরিয়ে এলে ভাল লাগত। সত্যবতীর এক ঝলক উপস্থিতি দেখিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন পরিচালক। সুকুমারীর চরিত্রে গার্গী রায়চৌধুরীর মুখে ‘আমি সন্তোষকে সত্যিই ভালবাসি’ সংলাপটির অতি ব্যবহার কানে লাগে। তবে উদয়ের চরিত্রটিকে পুরোমাত্রায় জাস্টিফাই করেছেন সুপ্রভাত। স্বরূপা ঘোষ, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ও প্রশংসনীয়। স্বল্প পরিসরে মাপসই কাজ করেছেন আয়ুষী তালুকদার। অঞ্জন দত্ত এ ছবিতেও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। শুধু ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হোটেলের ঘর থেকে বেরিয়ে যে ভাবে বন্দুক তাক করলেন তিনি, তা বেশ হাস্যকর। রবি বর্মাকে ইন্টেলিজেন্সের লোক হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টাটা চোখে পড়েছে।

কাহিনি যখন ১৯৭১ সালের, তখন ডিটেলের দিকে আর একটু নজর দিলে ভাল হত। সাজানো বৈঠকখানা, অজিতের হাতে দৈনিক যুগশঙ্খ, ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্লিফ রিচার্ডের ‘সামার হলিডে’ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু প্রায় ৫০ বছর আগের বাঙালি যুবকের শার্ট-প্যান্টের ফিটিং এমন হালফ্যাশনের কেন? হেনা মল্লিকের ঘরের ড্রয়ার হাতড়ানোর সময়ে বেরিয়ে পড়ে একটি সানস্ক্রিন পাউডারের গোল কৌটো। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে হলেও চোখে পড়ে হালের চেনা বিউটি প্রডাক্টটি। গল্পে সন্তোষবাবুর বাড়ি চৌরঙ্গী চত্বরে, কলকাতার নামীদামি ক্লাবে তাদের আনাগোনা। ছবিতে ক্লাবগুলি থাকলেও সন্তোষবাবুর বাড়ির পিছনে বালি ব্রিজ ও গঙ্গা দেখে ধন্দ লাগে।

ছবির আবহে ফিরে ফিরে আসা সুরটি মনকে গ্রাস করে। সম্পাদনা ছিমছাম হলেও হেনা মল্লিকের মৃত্যু সম্ভাবনার একাধিক দৃশ্য ছবির স্মার্টনেসে চোনা ফেলেছে। পরের ছবিতে যে ব্যোমকেশ কাহিনির ইঙ্গিত রয়েছে, তা নিয়ে আগ্রহ থাকবে। সঙ্গে পরিচালক সায়ন্তন ঘোষালের কাছ থেকে এ প্রত্যাশাও থাকবে, এই ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি যেন তাঁর সিগনেচারে স্বকীয় হয়ে ওঠে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Satyanweshi Byomkesh Film Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE