Advertisement
E-Paper

নারীকেন্দ্রিক ছবি মানেই সরব বিদ্রোহ নয়, বরং এক অন্য সংগ্রামের গল্প বলে ‘অন্নপূর্ণা’

বহু কাল বাদে, এমন নারীপ্রধান এক ছবি নির্মিত হয়েছে, যেখানে এক রমণীকে কেন্দ্র করে গল্প বিস্তারিত হয়েছে এবং সে রমণীও যৌবন পার করে ফেলা এক নারী।

অদিতি বসু রায়

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০৪
‘অন্নপূর্ণা’ ছবিতে অনুষা বিশ্বনাথন, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, দিতিপ্রিয়া রায়।

‘অন্নপূর্ণা’ ছবিতে অনুষা বিশ্বনাথন, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, দিতিপ্রিয়া রায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে দাঁড়ানো এক নারীর কর্মজীবনের শুরু, বিলেতে ঝাঁ-চকচকে লোকেশন, স্মৃতির শিকল কেটে নিজেকে বার করে আনা, স্বনির্ভরতার পাঠ শুরু— এই কয়েকটি বিষয় ‘অন্নপূর্ণা’র অন্যতম উপজীব্য। ছবিতে অন্নপূর্ণা, মানে অন্নপূর্ণা দাসশর্মার কাহিনি।

শুরুতেই এক তুমুল ধাক্কা দেন পরিচালক। বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল অন্নপূর্ণা। সেই সঙ্গে স্বামীর সঙ্গে খুনসুটির যে দৃশ্য দেখে দর্শক তাঁদের রোম্যান্সের পরিচয় পেয়ে নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন দাম্পত্য প্রেমের মধুর ছায়াছবি দেখার জন্য, পরের দৃশ্যেই তাঁদের সপাটে আছড়ে ফেলা হয় বাস্তবের মাটিতে। অন্নপূর্ণা সিঁদুর পরতে গিয়েও তা মুছে ফেলে। বিদেশ থেকে মেয়ে-জামাই আসে। স্বামী চলে যাওয়ার পর, যৌথ আবাসটিকে আঁকড়ে ধরে দু’বছর ছিল সে। মেয়ে সে বার মাকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে ফেরে। প্রথম কয়েক দিন পরেই, পরিবারের আবহাওয়া বদলে যায়। নিঃসঙ্গ অন্নপূর্ণা বহু কাল আগে মৃত পুত্রের কথা ভেবে অনাথ রনিকে সন্তানস্নেহে গ্রহণ করে। রনি কলকাতা থেকে লন্ডনে গিয়ে জীবিকার কারণে লড়াই চালাচ্ছে। অন্নপূর্ণা প্রকৃত জননীর মতো তার পাশে দাঁড়ায়। এর পর চিত্রনাট্য নিজস্ব গতিতে এগোয়। অন্নপূর্ণা, তার কন্যা আনন্দী, জামাই অতনু, রনি, রনির বাগ্‌দত্তা নিকোলের জীবন উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যে ভাবে যায়— ছবির গল্প আসলে সেটাই। তা পর্দায় দেখাই কাম্য।

এক ফ্রেমে অনন্যা-দিতিপ্রিয়া।

এক ফ্রেমে অনন্যা-দিতিপ্রিয়া। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রথমে ‘অন্নপূর্ণা’ গল্পের যে কয়েকটা উপজীব্য বিষয়ের কথা লেখা হয়েছিল, সেগুলো পড়ে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই ছবিতে যে ভাবে চরিত্রগুলোকে তুলে ধরা, তারাও সে পথ অনুসরণ করেছে। প্রথম যেটা বলার, তা হল— এখানে সবাই একেবারে সাদা-কালোর বাইনারির ধারায় চলেন। মেয়ে-জামাই খারাপ মানে একেবারেই খারাপ। আবার রনি বা নিকোলের চরিত্র ঠিক তার উলটো। ফলে, মেয়ের লন্ডনের বাড়িতে থাকাকালীন তাকে একেবারে অন্ধকারে রেখে অন্নপূর্ণার রনির সঙ্গে ফুড ডেলিভারির ব্যবসা চালানোর বিষয়টি, পরিচালকের আবেগকে মথিত করলেও যুক্তিবোধকে কিন্তু বিচলিত করার কথা। এবং একেবারে অচেনা দেশে, সামান্য আলাপের পরেই পুত্রস্নেহে কেবল বাঙালি বলেই তাকে নিজের হাতে পায়েস খাওয়ানোর ব্যাপারটিও অত্যন্ত অতিনাটকীয়। চলচ্চিত্রে মেলোড্রামাকে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ এবং পরিবেশন করলে, তার থেকে জোরালো ও তীব্র অভিঘাত আর হয় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে, তার অভাব দেখা যায়।

আনন্দীর সঙ্গে অন্নপূর্ণার সম্পর্কের রসায়ন, যা কিনা মা-মেয়ের জৈবিক টান, হৃদয়ের বন্ধন, তা-ও সে ভাবে দানা বাঁধেনি ছবিতে। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে, অন্নপূর্ণা দেখার প্রাপ্তি, এই অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে রক্তের সম্পর্ক ছাপিয়ে মানবিক সম্পর্কগুলিকে জিতে যেতে দেখা। অভিনয় এ ছবির সম্পদ। লন্ডনের বাঙালি ব্যবসায়ী বিনয় বিশ্বাস (কাঞ্চন মল্লিক), মুন্নি (অনুষ্কা)-কে যত বার পর্দায় দেখা গিয়েছে, তত বার দর্শকের মনে মোলায়েম বাতাস বয়ে গেছে। এদের সারল্য, উচ্ছলতা মন ভাল করে। আনন্দীর ভূমিকায় দিতিপ্রিয়া যথাযথ। মায়ের সঙ্গে তার মান-অভিমান, স্বামীর কাজে বিরক্তি— সবই তিনি যথার্থ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার স্বামী অতনুর চরিত্রে কাজ করেছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়। অর্ণ অত্যন্ত সুঅভিনেতা। কিন্তু তাঁর চরিত্রটি চিত্রনাট্যকারের দাক্ষিণ্যের অভাবে একমাত্রিক এবং করুণার যোগ্য হতে পারেনি। তবে তাঁর কাজ চমৎকার। অন্নপূর্ণার মৃত স্বামী হিসেবে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়কে ভাল লাগে। নানা ক্রাইসিসে বা আনন্দে তিনি পাশে আছেন ভেবে অন্নপূর্ণার কথোপকথন এই ছবিকে ভিন্ন মাত্রা দেয়।

সেই সঙ্গে অন্নপূর্ণার একাকিত্বের করুণ চিত্রকেও সামনে আনে। রনি ও নিকোলের ভূমিকায় ঋষভ বসু এবং আলেকজান্দ্রা টেলর ভাল করেছেন। মুখ্য চরিত্র, অন্নপূর্ণার ভূমিকায় অনন্যা চট্টোপাধ্যায় অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। প্রতিটি দৃশ্যে তিনি নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করেছেন। বহু কাল বাদে, এমন নারীপ্রধান এক ছবি নির্মিত হয়েছে, যেখানে এক রমণীকে কেন্দ্র করে গল্প বিস্তারিত হয়েছে এবং সে রমণীও যৌবন পার করে ফেলা এক নারী। এ কারণে পরিচালকের ধন্যবাদ প্রাপ্য। এবং অনন্যা এই ছবির প্রাণ। সম্পূর্ণ ছবিটি, তাঁর কাজের ওপরেই এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে, উল্লিখিত সামান্য দুর্বলতা অতিক্রম করে গিয়েছে।

‘অন্নপূর্ণা’ ছবির রেটিং চার্ট।

‘অন্নপূর্ণা’ ছবির রেটিং চার্ট। ছবি: আনন্দবাজার ডট কম।

অন্নপূর্ণা আদতে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। কেবল স্লোগানে নয়, রান্নাঘরেও মেয়েরা যে বিপ্লব এনে নিজের শক্তির প্রদর্শন করতে জানেন, সেই কাহিনি বলে এই ছবি। মাতৃত্ব যে দুনিয়ায় স্নেহের রাজপাট কায়েম করতে সক্ষম, সে গল্প জানায় অন্নপূর্ণা। জানায়, যে মেয়ে সামনের দিকে তাকাতে চায়, সে তার কাজের দোসর পেয়ে যায়ই।

ছবিটির পরিচালক অংশুমান প্রত্যুষের কাছে, ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও ভিন্ন ভাবনার ছবির প্রত্যশা রইল।

Annapurna Ananya Chatterjee Ditipriya Roy Rishav Basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy