Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Rituparno Ghosh

চলে গিয়েও বারে বারে ফিরে আসে ‘ঋতু’রাজ

কলকাতার যাবতীয় কন্ডাক্টেড ট্যুরের মধ্যে ১৮/এ ইন্দ্রাণী পার্ক নেই। ঋতুপর্ণ ঘোষ নেই,কেমন আছে বাড়ির ভেতরটা?ঘোষ-পরিবারের অনুমতি নিয়ে সেই সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ল আনন্দবাজার ডিজিটাল। কলকাতার যাবতীয় কন্ডাক্টেড ট্যুরের মধ্যে ১৮/এ ইন্দ্রাণী পার্ক নেই। ঋতুপর্ণ ঘোষ নেই,কেমন আছে বাড়ির ভেতরটা?ঘোষ-পরিবারের অনুমতি নিয়ে সেই সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ল আনন্দবাজার ডিজিটাল।

এই বাড়িই ঋতুপর্ণ ঘোষকে আগলে ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি। নিজস্ব চিত্র।

এই বাড়িই ঋতুপর্ণ ঘোষকে আগলে ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি। নিজস্ব চিত্র।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২০ ১৩:২৪
Share: Save:

"এই বাড়িতেই ঋতুদা আমাকে হাঁটা শিখিয়েছিল", রাইমা সেন

বাড়ির আধ খোলা কালো গেটের সামনে দাঁড়াতেই অর্ধ গোলাকৃতি বারান্দা থেকে সাদা শার্ট আর ব্লু জিনস পরা একজন পুরুষ বললেন, “এ দিকে, উপরে।”

ঘরে ঢুকে দেখা গেল, নীচের তলার অ্যান্টিক আসবাবে ঘেরা সেই ঘরের জৌলুস আজ নেই। সে ছিল এমন ঘর যেখানে শর্মিলা ঠাকুর থেকে বাংলার তাবড় অভিনেতা, প্রযোজক, টেকনিশিয়ান, গানের জগতের মানুষ ভিড় করতেন। রাইমা সেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘ঋতুদা ওর বাড়িতেই আমায় হাঁটা শেখায়।’’ তাঁর নিজের বসার ঘরে বা বেডরুমে জোরে দুটো এসি চালিয়ে সাতসকালেও লাইট জ্বালিয়ে ‘নৌকাডুবি’ থেকে ‘চোখের বালি’-র স্ক্রিপ্ট সেশন করতেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ

“কারওর ঠান্ডা লাগছে বলার জো ছিল না! এক একজনকে এক একটা গরম চাদর দিয়ে বলত, ‘এই নে পশমিনা, ঠাণ্ডা লাগবে না।’ ঠাণ্ডায় কেঁপে কেপেই নতুন ছবির চিত্রনাট্য পড়া হত”,দাদার চলে যাওয়ার দিনে দাদার কথা বলে উঠলেন পরিচালক, শিল্প নির্দেশক ইন্দ্রনীল ঘোষ।

ইন্দ্রাণী পার্কের অর্ধগোলাকৃতি ঋতুর প্রিয় বারান্দা যা তাঁর কৈশোর থেকে যৌবনের নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে

শর্মিলা ঠাকুরের মেকআপ রুম হল ঋতুর বাড়ি

দাদা পরিচালক আর ভাই আর্ট ডিরেক্টর, কী না হতে পারে? বড় বড় চোখ করে বললেন ঋতুপর্ণ ঘোষের বন্ধু এবং ইন্দ্রনীলের স্ত্রী দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়।“মা একদিন ফোন করেছেন। তাঁর দুই ছেলের ঝগড়া। চিঙ্কু ‘শুভ মহরত’-এর সেট করবে না।মা বলছেন আমাকে সামলাতে। আমি বললে হবে নাকি?বলেছিলাম, মা তোমার দুই ছেলে পরিচালক আর আর্ট ডিরেক্টর হলেও, ঝগড়া হলেও দিনের শেষে তোমার ছেলেই থাকবে।” লিখেছিলেন ঋতুপর্ণ, ‘চিঙ্কু আর আমি পিঠোপিঠি না হলেও মান-অভিমানে, খুনসুটিতে, অনাবশ্যক ক্ষণিক অভিমানের বোমাবর্ষণ কাটাতে কাটাতে দিব্যি হাত ধরে চলেছি।’’

পুরনো আসবাবপত্রের প্রতি তাঁর বরাবরের আকর্ষণ। তাঁর পছন্দের আয়না লাগা সাবেকি আমলের মেহগনি খাট

শুভ মহরত-এর বাজেট কম ছিল। ঋতুপর্ণ ঘোষ মেকআপ ভ্যানের ব্যবস্থা করতে না পারায় ইন্দ্রাণী পার্কের এই বাড়িতেই নিয়মিত শর্মিলা মেক আপ করতেন।পরিচালকের রুচিবোধ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন শর্মিলা।

বইয়ের ঘরে ঋতু ভূত দেখেছিল!

নীচের ঘর ছেড়ে সরু সিড়ি দিয়ে উঠতেই মাঝ তলার মুখোমুখি ঘর।ইন্দ্রনীলের বিয়ের পর ঋতুপর্ণ এই ঘরেই থাকতেন। গুচ্ছ বই ঘেরা বেডরুম। খাটের পাশে বইয়ের র‌্যাক। দেওয়ালের শরীরে বইয়ের র‌্যাক। কাঠের দেরাজেও উপরে পেতলের মোমদান, জাগ, সরস্বতী, নানা অ্যান্টিক জিনিসপত্র।“ঋতু যেখানেই যাক সেখান থেকে বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী, বই কিনবেই।পরে এক বই ছ’বার পেয়েছি এই বাড়িতে, পাগলের মতো জিনিস কিনত”,বললেন দীপান্বিতা।

বই কেনার মতোই ছিল বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী কেনার শখ, বাড়িটা যেন আস্ত একটা মিউজিয়াম

অন্য ঘরে দেখা গেল, ঘরের একটা অংশ কেটে ফলস সিলিং করে বই রাখার জায়গা করেছিলেন ঋতুপর্ণ।“সব প্ল্যান নিজেই মন থেকে বের করত! এইখানেই তো একবার দুলালদার ভূত দেখেছিল ঋতু”, উত্তেজিত দীপান্বিতা।

সাধের বইয়ের ঘরে ভূত দেখেছিলেন ঋতুপর্ণ? দুলাল নামে এক ভাড়াটে থাকতেন ঋতুপর্ণর ওই বাড়ির একতলায়। আচমকাই তাঁর মৃতদেহ পাশের পুকুরে পাওয়া যায়। তার বেশ কিছু দিন পরে রাতের বেলা ওই ঘর বাড়ানো ঝুলন্ত বইঘরে ঋতুপর্ণ নাকি দেখেন দুলালদা বইয়ের তাক থেকে বই বের করছেন। তখনই একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে চোখ চলে যায় পরিচালকের।আবার ফিরে তাকিয়ে দেখেন, দুলালদা নেই!

আয়না ঘেরা ঘরে ঘুম ভেঙে আগে নিজের মুখ দেখতেন

বিয়ের কিছু দিন পরে ইন্দ্রনীল-দীপান্বিতা গল্ফ ক্লাব গার্ডেনে চলে যান। ঋতুপর্ণ উঠে আসেন দোতলায়। বাবা-মা চলে যাওয়ার পরে পাঁচটা ঘর নিয়ে থাকতেন পরিচালক। এই ঋতু একা!এ ঘর সে ঘর ঘুরতেন।ইচ্ছে হলে ঘরের দেওয়াল ভাঙতেন। আসবাব সরাতেন।যখন যেমন মন...

সিড়ি দিয়ে বাঁ হাতের দ্বিতীয় ঘরে বিশাল উঁচু খাট, চিক দেওয়া পর্দা, চওড়া মেহগনি কাঠের আলমারি আর অভিনেতাদের মেকআপ রুমের মতো তৈরি করা লাগোয়া ঘর নিয়ে এই ‘সত্যান্বেষী’ তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।চারিদিকে বইয়ের তাক। আর বইয়ের র‌্যাকের মতো পাল্লা দিয়ে আয়নার ভিড়। বেডরুমেই দুই দেওয়ালে মেহগানি কাঠের আয়না। ঘুম ভেঙে সবচেয়ে আগে নিজেকে দেখবেন বলে খাটের মুখোমুখি আয়না। এই ঋতু তো পরিবর্তনশীল। স্থবির নয়। তাই শরীরের পরিবর্তনকে কাচের মায়ার ভেতর দিয়ে দেখে নিতেন ঋতু!

৩০ মে, ২০১৩, এই ঘরেই শেষ ঘুমের কাছে নিজেকে সঁপে দেন ঋতুপর্ণ

কনকনে এসি-র মধ্যেই শুরু হল ‘চিত্রাঙ্গদা’র চিত্রনাট্যের পাঠ

সব ঘরেই কমপক্ষে দু থেকে তিনটি নানা ধাঁচের আয়না। কোনও আয়নায় লেগেছে মেহগানি কাঠের চওড়া বর্ডার তো কোনও আয়নার মাথায় প্রাচীন ডিজাইনের নকশা করা। কোনও আয়নার ঠাঁই হয়েছে খাটের লাগোয়া বইয়ের র‍্যাকের মাঝে। দুই ঘরের মাঝের কোনও দেওয়ালও ফাঁকা নেই। কোথাও সরস্বতী বিরাজ করছেন তো কোথাও পিকাসোর ছবি। কোথাও রামকিঙ্করের দুর্গা তো কোথাও বুদ্ধ।পিকাসোর ছবি ব্যবহার হয়েছিল ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিতে। নিজের বেডরুমে কনকনে এসি-র মাঝে ‘চিত্রাঙ্গদা’-র চিত্রনাট্য পড়ছেন ঋতুপর্ণ। স্মৃতিচারণ করছিলেন ইন্দ্রনীল,“সে দিন আমি, অভীক, দেবুদা আছি। দেবুদা (দেবজ্যোতি মিশ্র) খুব উত্তেজিত। ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওর চিত্রনাট্য। আমি শুনছি, এটা ওটা বলছি।তাতে যে দাদা খুশি হচ্ছে তেমন নয়! অভীক (মুখোপাধ্যায়) চুপ। এমন সময় দাদা অভীকের মত জানতে চাইল, অভীক বলল,‘দর্শকের ভাল লাগতে পারে, খারাপও লাগতে পারে’,বলেই পালাল! দাদা বলল, আজ আর পড়ব না। সবাই যাও।”

আবার লিখলেন তিনি ‘চিত্রাঙ্গদা’।

সূর্যের আলো ঘরে ঢুকতে দিত না!

শুধু চিত্রনাট্য নয়। ভাঙাগড়া চলেছে তাঁর সমস্ত জীবন জুড়ে। “২০১০-এর পর থেকে বদলাতে আরম্ভ করল ঋতু।বাড়ির মধ্যে মিশে যেতে লাগল। সম্পর্কে জটিলতা, মানুষের সঙ্গে বিরোধ। সমানে ঘর ভাঙত। রং বদলাত। চারিদিকে দেওয়াল তুলে দিচ্ছিল। ঘর ছোট করে ধূসর রং করে সকালে জানলা না খুলে আলো জ্বালিয়ে কাজ করত! কিছুতেই রোদের আলো বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।” বলছিলেন দীপান্বিতা।

এই সেই চেয়ার, যেখানে বসে তিনি লিখেছেন অজস্র ছবির চিত্রনাট্য

অথচ, তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পরেও ইন্দ্রাণী পার্কের এই ‘তাসের ঘরে’ তিনি আলো করে আছেন। দৃঢ় দৃষ্টিতে আজও দোতলার আড্ডাঘরের কোণে দক্ষিণ ভারত থেকে আনা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অর্ধনারীশ্বরের মূর্তি চেয়ে আছে অমলিন।উপর তলার লম্বা প্যাসেজ জুড়ে বাংলা আর ভারতের ইতিহাসের বই।রবীন্দ্রনাথের লেখা, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা যাবতীয় বই তাঁর সংগ্রহে।বই জড়িয়েই থাকতেন একলা ঋতু। দর্শন, সঙ্গীত, মহাভারত-বইয়ের কত যে বিষয়বৈচিত্র! তাঁর বাবা-মায়ের ঘরে দেখা হল এক রাজকীয় চেয়ারের সঙ্গে।এই চেয়ারে বসে খাটের ওপর পা ছড়িয়ে লিখতেন তিনি। “ছোটবেলা থেকেই ভোরে উঠে দাদা আমাকে জোর করে ডেকে এক গুচ্ছ লেখা পড়াত। সে দিন ভোরেই লিখেছে।সারাক্ষণ লিখে যেত”,কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ মাখা অর্ধ গোল বারান্দায় দাঁড়িয়ে যেন আবার ছোটবেলা দেখলেন ইন্দ্রনীল। বাবা-মায়ের পাশে কিশোর ঋতুর ছবি। আর রাখা তাঁর অগুনতি বিশ্বজোড়া পুরস্কার। পুরস্কার সাজিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন না ঋতুপর্ণ কোনও দিন!

ছবির দৃশ্যে খাবার টেবিল থাকলেও নিজে খেতেন ছোট্ট টেবিলে

খেতে ভালবাসলেও দোতলার একটা ঘরেও খাবার টেবিলের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ‘‘খাটে বসেই ছোট্ট টেবিলে খাবার রেখে খেত’’, স্মৃতি থেকে বললেন দীপান্বিতা। মাঝের তলার ঘরে যদিও একটা বাহারি খাবার টেবিল রাখা আছে। অথচ ‘উনিশে এপ্রিল’ থেকে ‘আবহমান’, ‘তিতলি’, এমনকি ‘সত্যান্বেষী’-র মতো ছবিতেও খাবার টেবিলের রুচি, সাজ, নান্দনিকতা চোখে পড়ার মতো।ঋতুপর্ণের সাধআরতাঁর সংসার ঘেরা সাধ্যের মাঝে এক আকাশ ফাঁক বড় মনকেমনের। তাঁকে কোনও দিন দেখেননি। কথা বলেননি। শুধু ছবির মাধ্যমে পরিচয় আছে এমন বহু মানুষ আজও তাঁর জন্য মন খারাপ করেন। এই মনখারাপের আলাদা কোনও দিন নেই। রাত নেই। হয়তো তাঁদের না পাওয়া ঋতুপর্ণের বড় জীবনের ছোট না পাওয়ার মধ্যে তারা মিলিয়ে দেখেন!

তাঁর চিত্রনাট্যের খসড়া, অর্ধনারীশ্বর আর আয়না

আড্ডাঘরের অর্ধনারীশ্বর

ঋতুপর্ণ বলে গিয়েছেন,‘‘চলে যাবার ভয় আমাদের নিরন্তর। সবই তো চলে যায়। জীবন, যৌবন,ধনমান-তো ছেড়েই দিলাম।নিজের মধ্যে থেকে কত কিছু চলে যায়...’’

চলে গিয়েছেন তিনি, জাগতিক চোখের বাইরে, কিন্তু বাড়ির গায়ে লেগে থাকা চাঁপার গন্ধে মিশে আছেন। এই বাড়িই তাঁকে আগলে ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি। তাঁর আড্ডাঘরের ওই অর্ধনারীশ্বর বার বার মনে করিয়ে দেয় এ বাড়ি যেমন এক পুরুষের, তেমনই এক নারীর ইচ্ছার ছবি।

মানুষ আজ অন্ধকার আর আগুনকে বড় ভয় পায়।

কিন্তু এই মানুষ? আলো নয়, অন্ধকারের পথে আগুন ফেলে চলে গিয়েছেন।বার বার ফিরে আসবেন এই ঋতুরাজ।

অন্য বিষয়গুলি:

Rituparno Ghosh Death Anniversary ঋতুপর্ণ ঘোষ Death Sharmila Tagore Tollywood Bollywood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy