Advertisement
E-Paper

চুম্বকের নতুন নাম ঋদ্ধি

উথালপাথাল নস্টালজিয়ায় মনে পড়ল কত কথা। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীসম্ভবত ঋদ্ধি সেন-ই বছরের সেরা আবিষ্কার। শাশ্বত, ঋত্বিক, আবির সকলের কথা মাথায় রেখেই লাইনটা লিখতে বাধ্য হলাম। ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবিতে ঋদ্ধির অভিনয় আসলে চুম্বকের মতো। যে চুম্বকের এক মেরুতে আমাদের ফেলে-আসা পাড়া-সংস্কৃতি, খেপ খেলা, প্রথম সিগারেট, প্রথম চুমুর নস্টালজিয়া।

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১

সম্ভবত ঋদ্ধি সেন-ই বছরের সেরা আবিষ্কার। শাশ্বত, ঋত্বিক, আবির সকলের কথা মাথায় রেখেই লাইনটা লিখতে বাধ্য হলাম। ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবিতে ঋদ্ধির অভিনয় আসলে চুম্বকের মতো। যে চুম্বকের এক মেরুতে আমাদের ফেলে-আসা পাড়া-সংস্কৃতি, খেপ খেলা, প্রথম সিগারেট, প্রথম চুমুর নস্টালজিয়া। অন্য মেরুতে বয়ঃসন্ধির অ্যাংগ্স্ট (angst)। জার্মান ভাষা থেকে নেওয়া এই ইংরেজি শব্দের কোনও বিকল্প নেই। রাগ, হতাশা, অভিমান, ক্ষোভ গোছের সব বাংলা শব্দই ওই অনুভূতির কাছে হেরে ভূত। পর্দা-উপস্থিতি, অভিব্যক্তি সব দিক দিয়েই যে বালক দুই মেরুকে এ ভাবে সমান তালে প্রকাশ করতে পারে, তাকে সেরা আবিষ্কার কেন, সেরা নায়ক বললেও অত্যুক্তি হয় না!

ঋদ্ধির পাশাপাশি রয়েছে আরও কিছু সপ্রতিভ কিশোর-কিশোরী। ঋতব্রত, ধী, রাজর্ষি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব? এসএমএস প্রজন্মের এই ছেলেমেয়েরাই মধ্যবয়স্ক সমালোচককে মনে পড়িয়ে দিয়েছে সেই বয়সটা, যখন বন্ধুর হয়ে প্রেমপত্র লিখে দেওয়া যেত। এ-মার্কা ‘বডি’ বা ‘ব্লু লেগুন’ সিনেমা দেখার জন্য স্কুল পালিয়ে দেড় টাকার টিকিটের জন্য লাইন দেওয়া যেত। রিগাল সিনেমার ফুটপাথে থরে থরে হলুদ সেলোফেনবন্দি পর্নোসম্ভার। উথালপাথাল নস্টালজিয়ায় গজাল মাছ ঘাই মেরে আরও মনে পড়িয়ে দিল, পাড়ায় লোডশেডিং-এর অন্ধকারে এক বার বিপর্যয়ও ঘটেছিল। বন্ধুর প্রেমিকাকে দিতে গিয়ে চিঠি পড়েছিল তার দিদির হাতে! যে দৃশ্যে সুরঙ্গমা ট্যাক্সি চেপে ফুটবল খেলার মোক্ষম দিনে ফিরে এল পুরনো পাড়ায়, অজান্তে ঈর্ষার দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এল। আমাদের জীবনে কত জন যে পাড়া ছেড়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর ফেরেনি! তার পরই তো জীবনানন্দে আশ্রয় নিয়েছিলাম, ‘এই সব নারীদের অপর পুরুষেরা নিয়ে যায়!’

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ছবির চমৎকারিত্ব এখানেই। বিশেষ কোনও সময়কে ধরেন না তিনি, আমাদের সময়ে উত্তম-সুচিত্রা-হেমন্ত-সন্ধ্যার স্বর্ণযুগ ছিল, সকলই ছিল বটগাছ, আজি সবে শ্যাওড়াগাছ গোছের সন্দর্ভ খাড়া করেন না। সন্ধ্যার অন্ধকারে রেডিয়োতে খবর পড়ার আওয়াজ ভেসে আসা, পাড়ার মাঠে ৭২ ঘণ্টাব্যাপী সাইকেল চালানো, বন্ধুদের সঙ্গে প্রিন্সেপ ঘাট, মগডালে চড়ে পাশের বাড়ির দাদা-বৌদির প্রতি উঁকিঝুঁকি, পাড়ার মাঠে জিলিপি-রেস সত্তর থেকে নব্বই সব যুগেই বিদ্যমান ছিল। নস্টালজিয়ার সেই কোলাজ থেকেই এ ছবি তুলে আনে বাছাই কিছু ইমেজারি।

আর এই সব দৃশ্যকল্প মল-সংস্কৃতি, ঝাঁ-চকচকে রাজারহাট, বাইপাসের আধুনিক কলকাতাকে পাশ কাটিয়ে নিয়ে আসে অন্য শহর, অন্য কিছু চরিত্র। যেখানে আইএসডি-তে বাবা ছেলের ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান নিয়ে কথা হয়। পাড়ার ছেলেদের কোচিং করান, গ্যালারিতে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসেন, ‘ভেবেছিলাম ছেলেটা ফুটবল খেলবে। কিন্তু হয়ে গেল অঙ্কে ভাল।’ পাড়ার ছেলেবুড়ো সকলের কাছেই তিনি গোপেশ্বরদা। পার্টির দাদারা নন, পাড়ার এই সর্বজনীন দাদারাই একদা ছিলেন বাঙালি বালকের অভিভাবক।

এই ছবিতে পাড়ার ক্যাবলা ছেলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় নাইট-স্কুল চালানো সুন্দরী মেধাবিনীর। হস্টেল-ফেরত ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় রকে বসা অন্য ছেলের, বন্ধুদের সঙ্গে পুজোমণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে শালপাতায় ঘুগনি আর কুলফি-মালাই নিয়ে আসে অন্য স্বাদ। মায়ের ভূমিকায় সুদীপ্তা চমৎকার। অনিন্দ্যর প্রথম ছবি নিছক নস্টালজিয়ার কথা বলে না, একঘেয়ে পিৎজা-বার্গার-পাস্তাকে পাশ কাটিয়ে সে তুলে ধরে বিকল্প শহর, বিকল্প এক সংস্কৃতির কথা। সেখানেই তাঁর জিত!

শান্তনু মৈত্রের সুরে ‘বন্ধু চল’ বা প্রসেনের সুরে ‘পাগলা খাবি কি’ গানগুলো চমৎকার। গোপী ভগতের ক্যামেরা এবং অর্ঘ্যকমল মিত্রের সম্পাদনা প্রায় নিখুঁত ভাবে উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু বাই লেনকে ধরেছে। প্রসঙ্গত প্রযোজক সুজিত সরকার এবং পরিচালক দু’জনেই উত্তর কলকাতার পাড়ায় একদা খেপ খেলা ভেটেরান! দু’জনের নস্টালজিয়া কি একই ভাবে কোথাও মিলে গিয়েছিল?

তবে, কোলাজ সর্বত্র সমান ভাবে রং ফেলেনি। ছবির প্রথমার্ধ দীর্ঘায়িত। দ্বিতীয়ার্ধ সিনেমাটিক, কিঞ্চিৎ অতিনাটকীয়। উত্তর কলকাতার এঁদো গলিতে কোন কুমারী মেয়ে আরাধনার শর্মিলা ঠাকুরের মতো কুমারী অবস্থার সন্তানকে নিয়ে বাস করত? শেষে যে ঋদ্ধিই গোল দেবে, তার মা মাঠে এসে গো-ও-ল বলে চেঁচাবে, প্রত্যাশিত। নস্টালজিয়ার ছবিতে পাড়া-ফুটবলের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক, খেলতে খেলতে সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়া-গোছের আধা-দার্শনিক সংলাপ যে বাংলা ছবিতে থাকবে, সেটিও প্রত্যাশিত। প্রথম ছবিতে পরিচালকের এই জাতীয় দুর্বলতা থাকতেই পারে, প্রত্যাশিত সেটিও।

শুধু ঋদ্ধি সেন-ই এই বাংলা বাজারে চরম অপ্রত্যাশিত!

riddhi sen open tee bioscope gautam chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy