একান্নবর্তী পরিবার এখন অতীত। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কর্মরত হলে, সন্তান ও পরিবার সামলান গৃহসহায়িকা। কিন্তু কোনও দিন গৃহসহায়িকা অনুপস্থিত থাকলে সমাধান বলতে রয়েছে শিশুদের ক্রেশ। আজকাল বিভিন্ন আবাসনে এবং কিছু অফিসেও শিশুদের ক্রেশের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরিবারে বৃদ্ধ বাবা বা মা থাকলে সে ক্ষেত্রে কী হবে? হয়তো কোনও এক দিন গৃহসহায়িকা আসতে পারেননি। তখন সেই বৃদ্ধ বাবা বা মা কি বাড়িতে একা থাকতে পারবেন? প্রশ্ন তুললেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
২০১৩ সালে আমেরিকার সংস্থা লিঙ্কডইন একটি বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল। ‘ব্রিং ইয়োর পেরেন্টস টু ওয়ার্ক’, অর্থাৎ অফিসেই বাবা-মাকে নিয়ে আসুন। তবে এই সমাধান এখনও ভারতের সংস্থাগুলি নিয়ে আসতে পারেনি। জানান শিবপ্রসাদ। আনন্দবাজার ডট কমকে তিনি বলেন, “বেশির ভাগ বাবা-মা জানেন না, তাঁদের ছেলেমেয়েরা অফিসে কী কাজ করেন, অফিসটা দেখতে কেমন, সহকর্মীরা কেমন ইত্যাদি। ২০১৩ সাল থেকে লিঙ্কডইন একটি নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রতি বৃহস্পতিবার বাবা-মায়েদের অফিসে নিয়ে আসার কথা বলা হয়। গোটা অফিস ঘুরে দেখানোর পাশাপাশি তাঁদের জন্য চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয় প্রতি বৃহস্পতিবার করে।”
আজও বহু মানুষের বাড়িতে রক্তচাপ, ব্লাড সুগার মাপার যন্ত্র অথবা অক্সিমিটার নেই। কিন্তু একটা বয়সের পরে নিয়মিত এগুলি মাপা প্রয়োজন। তাই অফিসে তাঁদের জন্য এই ধরনের ছোট পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলে তা অত্যন্ত সুবিধাজনক, মনে করেন শিবপ্রসাদ। তিনি বলেন, “এক যুগ আগে আমেরিকায় এটা হয়ে গিয়েছে। সেখানে প্রায় ১০০টি সংস্থায় এই ব্যবস্থা রয়েছে। সংস্থার কর্মীদের মাথা থেকে চাপ কমানোই এই উদ্যোগের নেপথ্যের কারণ। হতেই পারে, কোনও একদিন বাড়ির ট্যাংক সারানো হচ্ছে বা বিদ্যুতের সমস্যা হচ্ছে। এমন নানা ধরনের প্রতিকূলতা থাকে। তখন বাবা-মাকে একা বাড়িতে রেখে আসা যায় না। সে ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ কার্যকর। সংস্থার কর্মীদের মাথা থেকে এই চাপগুলি কমে গেলে তাঁরা আরও ভাল ভাবে কাজ করতে পারে।”

মায়ের সঙ্গে শিবপ্রসাদ। ছবি: সংগৃহীত।
হঠাৎ এ ভাবে ভাবলেন কেন শিবপ্রসাদ?
শিবপ্রসাদ নিজেও বাস্তবে তাঁর মায়ের খুব কাছের। ইন্ডাস্ট্রির অধিকাংশ পার্টি বা আড্ডায় তিনি রাত অবধি থাকতে চান না। কারণ তাঁর একলা মা। পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মা থাকলে কী কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে তিনি অবগত। অভিনেতা তথা পরিচালক তাই বলেছেন, “এই জন্যই আমি আমার সংস্থার কর্মীদের বাবা-মায়ের খোঁজ রাখি। আমাদের তরফ থেকেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। কারও পরিবারে বিপদ-আপদ হলে, আমি নিজেই পরামর্শ দিই। এমনও হয়েছে, কেউ হয়তো বাবা-মাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাবেন। তাঁরা বাবা-মাকে অফিসে এনে রেখেছেন। আমি নিজের মাকে দিয়েই এই বিষয়গুলো আরও বুঝেছি। আসলে রোজ তো নয়। একটা দিন মা বা বাবা বায়না করতেই পারেন। সেই বায়না একদিন রাখলে, বাকি দিনগুলো পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক থাকে।”
এমন ভাবনা থেকেই বয়স্ক বাবা-মায়ের বিশেষ দিনে অফিসে যাওয়ার কথা উঠে এসেছে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘আমার বস্’-এ। অফিসে বাবা-মাকে নিয়ে এলে সংস্থা তার প্রত্যেক কর্মীর পরিবার, জীবনযাপন সম্পর্কে অবগত হবে। শিবপ্রসাদের কথায়, “বাবা-মা অফিসে এলে, সংস্থা নিজের চোখে দেখতে পাবে, কতটা বৃদ্ধ বাবা-মা, তাঁদের শারীরিক অবস্থা কেমন, তাঁরা কী কাজ করতেন, তাঁদের জন্য কর্মীকে কতটা দায়িত্ব বহন করতে হয়। আবার হয়তো কোনও কর্মীর পরিবারে কেউ নেই। তাঁদের পরিস্থিতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহল থাকবে সংস্থা। কর্মীদের পরিবার ও জীবনযাপন জানার এই ব্যবস্থা আজকের দিনে প্রবল ভাবে জরুরি।” এই ধরনের ব্যবস্থা অতি শীঘ্র বাংলা-সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন শিবপ্রসাদ।
এমনও হয়েছে, শিবপ্রসাদকে তাঁর মা বায়না করে বলেছেন, “আজ অফিস যেয়ো না।” শিবপ্রসাদ তখন মায়ের মন বুঝে মাকে অফিসে নিয়ে গিয়েছেন। মায়ের চলাফেরায় হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হয়। তাই তাঁর সুবিধা মেনেই অফিসে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন পরিচালক। বাস্তবের এই বিষয় নিয়ে ‘আমার বস্’ ছবির চিত্রনাট্য যখন রাখি গুলজ়ার শুনেছিলেন, তার গলা ধরে এসেছিল। চোখের পাতাও নরম হয়ে এসেছিল। তিনিও তো একা! বলেছিলেন, “এই ছবিটা কিন্তু বহু মায়ের মনের কথা হয়ে উঠবে।”