Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মন ভাল করার সোনার পাহাড়

‘সোনার পাহাড়’ এ রকম একটা ছবি। যে ছবির পেয়ালায় চুমুক দিলে ঊষ্ণ আরাম নামে গলা বেয়ে। মানুষ হয়ে বাঁচার কিছু কিছু গ্লানি মুছে যায়।

অন্তরা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

কিছু ছবি আছে, কেন জানি না, মানুষের ভিতরের ‘ভাল’গুলোকে খুঁটে বার করে আনে। একটা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু এক বারও ‘জাজ’ করে না। এই ছবিগুলো, বা বলা ভাল এই ছবি-করিয়েরা জানেন, মানুষের দুর্বলতার কথা। জীবনের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ার যন্ত্রণার কথা। কিন্তু ‘হেরে যাওয়া’ জায়গাগুলোর চার পাশে কালো দাগ টেনে দেন না! বরং ক্লান্ত দিনের শেষে এক কাপ গরম চায়ের মতো এসে মেজাজটা ভাল করে দেন। ‘সোনার পাহাড়’ এ রকম একটা ছবি। যে ছবির পেয়ালায় চুমুক দিলে ঊষ্ণ আরাম নামে গলা বেয়ে। মানুষ হয়ে বাঁচার কিছু কিছু গ্লানি মুছে যায়।

ছবির পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের আগের তিন ছবি ‘জিও কাকা’, ‘হাওয়া বদল’ এবং ‘লড়াই’-এর চেয়ে ‘সোনার পাহাড়’ যোজন দূরের। এই ছবির সম্বল একটা অদ্ভুত সারল্য। যার পরতে পরতে মায়া জড়িয়ে আছে। ভালবাসার, বন্ধুত্বের, বন্ধনের। এ রকম ছবি তো সাধারণত পরিবারের সকলের সঙ্গে বসে দেখার ছবির ব্র্যাকেটে পড়ে যায়। কিন্তু ‘সোনার পাহাড়’ এই ব্র্যাকেটে বসেও দর্শককে নিজের সঙ্গে একা হওয়ার জায়গাটা করে দেয়। বাঙালি পেশাদার গৃহস্থ বাড়ির চেনা গল্প এটা। কিন্তু পরমব্রত সেই চেনা গল্পটাকেই এমন ভাবে সিনেমার ক্যানভাসে এঁকেছেন যে, মায়াবী মনে হবে তাকে। ভবানীপুরের এক পুরনো বা়ড়িতে একা একা থাকে উপমা (তনুজা)। ছেলে (যিশু সেনগুপ্ত) এবং ছেলের বউ (অরুণিমা ঘোষ) আলাদা। চাকরির কারণে, বনিবনা না হওয়ার কারণে, জেনারেশনের ফারাকের কারণে... যেমনটা হয়। উপমার শূন্য রোজনামচা ভরিয়ে দিতে তার জীবনে হাজির হয় বিটলু (শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়)। অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া এক খুদে। এই দু’জনের মধ্যেকার সখ্যই ছবির বেশিটা জুড়ে। আর এই সখ্যই দর্শককে একটা নিষ্পাপ সত্যির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়— মায়ায় জড়ানোর বয়স হয় না!

তাই যখন কোনও শটে ভাতের থালা কোলের কাছে নিয়ে বসে বিটলু আলগোছে নিজের নাকটা মুছে নেয়, কোনও শটে সন্ধি করতে আসা বউমা খিটখিটে শাশুড়ির পাশের চেয়ারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে প়ড়ে কিংবা ছেলের ছোটবেলার ‘আবোল তাবোল’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘টুনটুনির গল্প’ ধুলো ঝেড়ে উপমা বিটলুকে দিয়ে দেয়— গলার কাছটা ধরে আসে। ছবিটা খুব সহজেই চেনা ছক মেনে ছেলে-ছেলের বউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারত। কিন্তু পরমব্রত সেটা হতে দেননি। উল্টো দিকের ভালমন্দও বিচার করেছেন— কিন্তু কাউকে অপরাধী না করে, কোনও মেলোড্রামা না টেনে, অযথা দর্শকের বিবেক নিয়ে টানাটানি না করে। একটা খুব সহজ উপলব্ধি বুনে দিয়েছে ‘সোনার পাহাড়’— নিন্দুকরা হয়তো বলবেন আপস করে নেওয়ার উপলব্ধি। কিন্তু আমরা তো রোজই অফিসে, বাজারে, রাস্তায়, দোকানে কারও না কারও সঙ্গে সস্তা আপস করে কাটিয়ে দিচ্ছি। কী আছে, যদি সেই দামি লোকগুলোর সঙ্গেও একটু আপস করে নেওয়া যায়, যারা এক ছাদের তলায় ভাল থাকা-খারাপ থাকাগুলোকে জড়িয়ে-জাপ্টে একসঙ্গে বেঁচে আছি!

সোনার পাহাড় পরিচালনা: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনয়: তনুজা, সৌমিত্র, শ্রীজাত, যিশু, পরমব্রত, অরুণিমা ৭/১০

তনুজা গোটা ছবি জুড়ে আরও এক বার মনে করিয়ে দিলেন তিনি কেন ক্লাসিক অভিনেত্রী। ছোট পরিসরে সৌমিত্রও তাই। যিশু, অরুণিমাও আগাগোড়া ভাল। কিন্তু ছবির সেরা পাওনা শ্রীজাত। সহজাত স্মার্ট অভিনয় ওইটুকু বয়সে সে কী করে করল, ভাবতে হয় বসে! সিনেম্যাটোগ্রাফি, সঙ্গীত, আর্ট— ছবিতে কিন্তু কিছুই বাড়তি নয়। মাপ মতো। বাংলা ছবিকে সেই মাপটা আর এক বার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বোধহয় একটা ‘সোনার পাহাড়’-এর দরকার ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Soumitra Chatterjee Shonar Pahar Tanuja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE